মজুরি না দিয়ে ‘মারধর’ করে কয়েকজন শ্রমিককে বের করে দেয়ার অভিযোগ উঠেছে এসকে ফ্যাশন ওয়ার্ল্ড লিমিটেড নামক একটি তৈরি পোশাক কারখানার বিরুদ্ধে। এ বিষয়ে সহায়তা চেয়ে শ্রমিকরা কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরে অনলাইনে অভিযোগ করেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
এস কে ফ্যাশন কারখানাটি রাজধানীর পূর্ব রামপুরার ডিআইটি রোডের ১৭/১, মকবুল টাওয়ারের ৪র্থ তলায় অবস্থিত। কারখানাটিতে দুই-এক মাস পর পর নতুন নতুন শ্রমিকদের নিয়োগ দেয়া হয়। এরপর মজুরি না দিয়ে কৌশলে তাদের বের করে দেয়া হয়। মজুরি দাবি করলে বিভিন্নভাবে পুলিশের ভয় দেখানো হয় শ্রমিকদের।
অভিযুক্ত কারখানার মালিক বলছে, এসব মিথ্যা। শ্রমিকেরা নিজে থেকে চলে গেছে। তার ব্যবসার সুনাম নষ্ট করতে একজন ‘সন্ত্রাসী’ শ্রমিক তার বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লেগেছে।
এ বিষয়ে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর ও বিজিএমইএ বলছে, নিয়ম অনুযায়ী শ্রমিক ছাঁটাই করতে পারবে। কিন্ত অবশ্যই শ্রমিকের পাওনা পরিশোধ করতে হবে। মজুরি না দিয়ে কারখানা থেকে শ্রমিকদের বের করে দেয়া চরম অন্যায়।
মজুরি না দিয়ে বের করে দেয়ায় গত ১৮ মার্চ কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরে অনলাইনে অভিযোগ করেন ওই কারখানা চার শ্রমিক। এতে তারা উল্লেখ করেন, এসকে ফ্যাশন ওয়ার্ল্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের মাধ্যমে সুইং বিভাগে কোয়ালিটি পদে ৯ জানুয়ারি যোগ দেন শ্রমিক মহিমা। পরে ১৩ জানুয়ারি মহিমার মাধ্যমে কাটিং বিভাগে হেলপার পদে তার আত্মীয় শ্রমিক মোসকাত, মোসকাতের স্ত্রী তাসলিমা ও খালাতো বোন নাসরিন যোগ দেন।
ফেব্রুয়ারি মাসের ১০ তারিখের পরও তাদের জানুয়ারি মাসের মজুরি দেওয়া হয়নি। মজুরি চাইলে, দেয়া হবে বলে আশ্বাস দেয়া হয়। তারা অপেক্ষা করেন। কাজও করতে থাকেন। ১৯ ফেব্রুয়ারি মজুরি চাইলে তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন ওই কারখানার ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও মালিক মো. আবুল খায়ের মানিক।
তিনি তাদের হাজিরা কার্ড কেড়ে নিয়ে বের করে দেন। চাকরির শুরুতে তাদেরকে কোনও নিয়োগপত্র ও আইডি কার্ডও দেওয়া হয়নি। শুধু হাজিরা কার্ড দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে ওই কারখানা চার শ্রমিক।
ভুক্তভোগী ওই কারখানার শ্রমিক মোসকাত চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, ‘নদীতে ঘর-বাড়ি ভেঙ্গে যাওয়া অসহায় হয়ে কাজের সন্ধানে ঢাকায় এসেছি। কিন্তু এখানে চাকরি করে টাকা না পেয়ে খুব বিপদে পড়েছি। বেতন চাওয়ায় খারাপ ব্যবহার ও মারধর করে কারখানা থেকে বের করে দিয়েছে মালিক নিজেই। এখন দূর্বিসহ জীবন কাটাতে হচ্ছে আমাদের।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে এসকে ফ্যাশন ওয়ার্ল্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আবুল খায়ের মানিক বলেন, ‘আমি যুবলীগের একজন সক্রিয় কর্মী। লক্ষীপুর জেলার কমলনগর উপজেলা ইউনিয়নের যুবলীগের সভাপতি। আমার উঠাবসা উপরের লেভেলে। মূলত পুলিশ হেড কোয়ার্টারের কাজগুলোই করি। সেখানে আমার-যাওয়া আসা। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজন সব সময় আমার কারখানায় আসা-যাওয়া করে। এখনও আছে।’
শ্রমিকদের বেতন না দিয়ে বের করে দেবার অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘একটি ছেলে কারখানায় এসে আমার ব্যবসার সুনাম নষ্ট করেছে। ওই ছেলে গুলিস্তান এলাকায় সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজি, ছিনতাই করতো। তারা আমার মানহানি করেছে। তাদের নামে মামলা করবো। সব প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছি।’
সন্ত্রাসী হলে কেন চাকরি দিয়েছিলেন- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি বুঝতে পারিনি। আমি তাদের ভালোর জন্য করেছি। কিন্তু তারা না বলে চলে গেছে। নিয়ম অনুযায়ী তারা চাকরি থেকে অব্যাহতি দেবে। তারপর তাদের বেতন দেয়া হবে।
তাদের তো নিয়োগপত্র দেয়া হয়নি, অব্যাহতি কীভাবে দেবেন? এর জবাবে তিনি বলেন, পোশাক কারখানার নিয়ম অনুযায়ী কাজ শুরু করার তিন মাস পর নিয়োগপত্র দেয়া হয়। কিন্তু তারা তিন মাসের আগেই চলে গেছে। তবে পাশ কার্ড দেয়া হয়েছে। সেটা দিয়ে তারা অব্যাহতির জন্য আবেদন করার পর বেতন দেয়া হবে। যাই হোক দুই-একদিনের মধ্যে তাদের বেতন দিয়ে দেয়া হবে।
কারখানার মালিককে আরও প্রশ্ন করলে তিনি উত্তেজিত হয়ে কথা বলতে অস্বীকৃতি জানান এবং ওইসব বিষয় নিয়ে বেশি ভাবার টাইম নাই বলে উল্লেখ করেন। কারখানার মালিক হিসেবে তিনি সরকারকে যেভাবে নিয়ম মেনে ভ্যাট-ট্যাক্স দেন শ্রমিকের মজুরি পরিশোধ সেভাবেই হবে বলে জানান। শ্রমিকরা বিভিন্ন সময় আন্দোলন করলেও তাতে মালিকদের কিছু আসে যায় না বলেও জানান তিনি।
এ বিষয়ে গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্য ফোরামের সভাপতি মোশরেফা মিশু বলেন, শ্রমিকরা আন্দোলন করলে তাদের নামে মিথ্যা মামলা দেয়া হয়। এমনকি চুরির অভিযোগও তোলা হয়; যা অত্যন্ত বর্বরোচিত বিষয়। এর নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই। ওই মালিককে আইনের আওতায় এনে এর বিচারের দাবি জানাচ্ছি।
তিনি আরও বলেন, মালিকরা শ্রম আইনের কোনো তোয়াক্কা করে না। কথায় কথায় শ্রমিকদের উপর অত্যাচার চালায়। বিনা কারণে ছাঁটাই করে। মজুরি পরিশোধ না করে কারখানা থেকে বের করে দেয়া হয়। বিজিএমইএ এর দায় এড়াতে পারে না।
এ বিষয়ে বিজিএমইএর সহসভাপতি মাহমুদ হাসান খান বলেন, কারখানায় শ্রমিক না রাখলে আইন অনুযায়ী তার পাওনা বুঝিয়ে দেয়া উচিত। মজুরি না দেয়াটা চরম অন্যায়।
তিনি বলেন, যেহেতু ওই কারখানাটি বিজিএমইএর সদস্য নয়। তাই বিকল্প ব্যবস্থা হিসাবে সেখানে যেন সাব-কন্ট্রাক্টে কোনো ধরণের কাজ না দেয়া হয়, সে বিষয়ে বিজিএমইএর সদস্যদের নিষেধ করা হবে।
কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শক সামছুজ্জামান ভুঁইয়া বলেন, শ্রমিকদের মজুরি অবশ্যই পরিশোধ করা উচিত। তবু অভিযোগ শাখায় কথা বলেন।
এরপর অধিদপ্তরের ঢাকা জেলা কার্যালয়ের উপ-মহাপরিদর্শক জাকির হোসেনকে বিষয়টি অবগত করা হলে তিনি বলেন, তদন্ত করে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে।