শেষ জন্মদিনের অনুষ্ঠানে ঝকমকে তারুণ্য নিয়ে তিনি তাঁর স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বলেছিলেন, আমি বাঁচতে চাই লালনের মত একশ ষোল বছর। কিন্তু তা আর হল কই! মাত্র আশি বছরের জীবন পার করে চলে যেতে হল বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গল্পকারকে। কবিকে। নাট্যকারকে। ঔপন্যাসিককে। ডাক নাম বাদশা। জীবনও পার করেছেন বাদশার মত। কোনকিছুকে পরোয়া করেননি। হাতের মুঠোয় জীবনকে নিয়ে বাদশার মতই দিগদারী করেছেন। বাংলা সাহিত্যের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। এক অলৌকিক মন্ত্রমুগ্ধের স্নিগ্ধতায় কাটিয়ে দিয়েছেন জীবনের উজ্জল সময়।
সৈয়দ শামসুল হক। অসামান্য প্রতিভাধর এই সাহিত্যিক তাঁর সারাজীবন এই বাংলার প্রতি কৃতজ্ঞ থেকেছেন। দায়বদ্ধ থেকেছেন। বাংলা, বাঙালি, বাংলাদেশ যার রক্তকণিকার ভেতর প্রবহমান ছিল। আদর্শ আর নীতিবোধের জায়গা থেকে সরে যাননি এক চুলও। বাংলাদেশের যেকোন আন্দোলন-সংগ্রামে তিনি নানাভাবে জড়িয়ে ছিলেন। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর আদর্শের প্রতি অবিচল থেকেছেন।
যার থাকার কথা পরানের গহীন ভিতর তিনি কিভাবে আমাদের ছেড়ে চলে যান! কিন্তু লক্ষ লক্ষ ভক্তের এরকম প্রশ্নকে প্রশ্নবিদ্ধ করে বাদশা আমাদের নিঃস্ব করে চলে গেছেন অন্য এক জগতে।
দুই।।
“আমার ঘরে জানালার পাশে গাছ রহিয়াছে
তাহার উপরে দুটি লাল পাখি বসিয়া আছে।”
এগার-বার বছরের এক টাইফয়েডে আক্রান্ত শয্যাশায়ী কিশোর রান্নাঘরের পাশে সজনে গাছে বসে থাকা একটি লাল টুকটুকে পাখি দেখে দুই লাইনের এই কবিতার আড়ালে লুকিয়ে থাকা একটি ‘কবিতা-গল্প’ লিখেছেন । সৈয়দ শামসুল হক। ডাক নাম বাদশা। বাবা সৈয়দ সিদ্দিক হুসাইন ও মা হালিমা খাতুন দম্পতির আট সন্তানের প্রথম সন্তান। পিতা সৈয়দ সিদ্দিক হুসাইন পেশায় ছিলেন হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার। ছেলের কাব্য প্রতিভায় বাবা-মা মুগ্ধ। তবে, প্রথম প্রকাশিত লেখা গল্প। ফজলে লোহানী সম্পাদিত ‘অগত্যা’ পত্রিকায় সৈয়দ শামসুল হকের প্রথম লেখা প্রকাশিত হয় ১৯৫১ সালের মে মাসে। গল্পের নাম উদয়াস্ত।
সৈয়দ শামসুল হকের কোন এক জন্মদিনে প্রয়াত নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ দৈনিক সংবাদের সাহিত্য পাতায় লিখেছিলেন, ‘অনেকেই বলেন বাংলাদেশের কথাসাহিত্যে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর আসনটিই সবার ওপরে, কিন্তু তার বিবেচনায় সৈয়দ হকের অবস্থানটিই সর্বোচ্চে হওয়া উচিত।’
তিন ।।
সাহিত্য সমালোচকরা বলছেন, রবীন্দ্রনাথের উত্তরকালের মুষ্টিমেয় বহুমাত্রিক প্রতিভাধরদের মধ্যে সৈয়দ শামসুল হক অন্যতম। তাঁর রচনা সম্ভার বাংলা সাহিত্যের প্রতিটি মাধ্যমকে সম্পদশালী করেছে। কবিতা দিয়ে শুরু হয়ে গল্প, উপন্যাস, নাটক, সমালোচনা, নিবন্ধ, প্রবন্ধ, ছড়া– সাহিত্যের সব শাখায় তাঁর সফল পদচারণা।
বাংলা ছোটগল্পের সীমাহীন ভূগোল অতিক্রান্ত হয়েছিল ‘কল্লোল’ গোষ্ঠীর অভিযাত্রায় । তাকে আরো বিস্তৃত, বিবৃত করেছিলেন তিন বন্দ্যোপাধ্যায় । ‘ছোটগল্প: নতুন রীতি’ নামে নিরীক্ষাধর্মী আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বিমল কর। কল্লোল গোষ্ঠীর সমান্তরালে বাংলাদেশের ছোটগল্পের অর্জন ছিল ছিল খুব সামান্যই। ত্রিশ দশকের শেষ ও চল্লিশ দশকের শুরুর দিকে বাংলা ছোটগল্পের যে শুভ সূচনা হয়েছিল সাহিত্য সমালোচকরা তাকে সংশয়সংকুল বলে অভিহিত করেছেন। সেই সন্ধিক্ষণে সৈয়দ ওয়ালী উল্লাহ ও শওকত ওসমানের আবির্ভাব সত্ত্বেও মূলত পঞ্চাশের দশকই এদেশী গল্পকারদের জুগিয়েছিল পায়ের তলার মাটি।
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের উত্তালতা আছড়ে পড়েছিল বাঙালির মননে, সৃজনে, জীবনে। সেই অভূতপূর্ব আত্মদর্শনে উদ্ভাসিত জাতীয়তাবাদী মনোভাবের ভিত্তিমূলে যে আধুনিকমনস্ক গল্পকারদের আবির্ভাব ঘটেছিল সৈয়দ শামসুল হক তাদের মধ্যে উজ্জ্বলতম নাম। সদ্য বিকশিত নাগরিক জীবনযন্ত্রণার নানা অভিক্ষেপ, মধ্যবিত্তের অস্তিত্বের অভিনব সংকট, জাতিসত্তার ক্রমবিবর্ধিত জাগরণ, মুক্তিকামী মানুষের বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর– সমকালীন সর্বাঙ্গীণ জীবনচেতনাকে সাঙ্গীকৃত করে সৈয়দ হক তাঁর গল্পকে নিছক সুখপাঠ্যের আত্মাহুতি থেকে বাঁচিয়ে চিরকালীন মর্যাদা প্রদান করেছেন।
তিনি তাঁর বিভিন্ন স্মৃতিকথায় পরম মমতায় তাঁর একান্ত বান্ধব ফজলে লোহানীর কথা কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করেছেন। তাঁর এই বর্ণাঢ্য সাহিত্যিক জীবনের উপক্রমণিকা ছিল বেদনাদায়ক। প্রবোধকুমার সান্যালের ‘ক্ষয়’ নামক গল্পের আদলে লেখা তাঁর প্রথম গল্পটি স্বভাবতই উপহাসিত হয়। সাহিত্যসভায় তাঁর গল্প পাঠের পর উপস্থিতজনেরা গল্প নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করেছিলেন। কিছুই হয়নি বলে তাঁকে প্রায় খারিজ করে দিয়েছিলেন। তিনি বেদনাহত হয়েছিলেন। তাঁর মন ভেঙ্গে গিয়েছিল এই ভেবে, তাহলে কিছুই হয়নি! সাহিত্যসভা থেকে বেরিয়ে যাবেন ঠিক সেই মন ভেঙ্গে যাওয়ার সময়ে তাঁর কাঁধে যে শীতল হাতটি এসে পড়েছিল সেটা ফজলে লোহানীর। সেদিন তিনি সামান্য স্নেহ পেয়েছিলেন ফজলে লোহনীর কাছে।
তাঁর দ্বিতীয় গল্পটিও বিজ্ঞজনের নজর কাড়তে ব্যর্থ হলে অশ্রুসজল তরুণ লেখকের পিঠে সমবেদনার হাত রেখেছিলেন সেই ফজলে লোহানীই। ভালবাসা আর স্নেহের কাঙাল হলে মানুষ কতটা পথ অতিক্রম করতে পারে সেদিনের সেই যুবক তার প্রমাণ। এরপর থেকে তাঁকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। একের পর এক গল্পে বহু বিচিত্র জীবনের দেখা, না দেখা অভিজ্ঞতার প্রকাশ পেয়েছে। একইসঙ্গে যাপিত জীবনের নির্মোহ আঁকিবুঁকি, আখ্যানভাগ তাঁর গল্পে হাতের রেখার মত পরিষ্কারভাবে চিত্রিত হয়েছে। আর এসবের মধ্যে দিয়ে তাঁর হাত ধরে দেশভাগোত্তর ছোটগল্পের বাঁকবদল ঘটেছে। তাস (১৯৫৪), শীত বিকেল (১৯৫৯), রক্তগোলাপ (১৯৬৪), আনন্দের মৃত্যু (১৯৬৭), প্রাচীন বংশের নিঃস্ব সন্তান (১৯৮২), সৈয়দ শামসুল হকের প্রেমের গল্প (১৯৯০), জলেশ্বরীর গল্পগুলো (১৯৯০) গল্পগ্রন্থ তাঁর শিল্পসার্থক রত্নআকর।
সৈয়দ হকের গল্প নিয়ে যারা কাজ করছেন তাঁরা নানাভাবে দেখিয়েছেন, সাহিত্যের বৌদ্ধিক প্রকাশই তাঁর আজীবনের উদ্দেশ্য। শুধু হৃদয়ের শান্তির জন্য নয়, বরং মগজের অক্লান্ত শ্রমের প্রতিদানে তিনি শিল্পকে সার্থকতা প্রদান করেছেন। করোটির বিশুষ্ক কারখানাই তাঁর গল্পের সূতিকাগার। শব্দের সচেতন ব্যবহারে, গল্পের কাঠামোগত বৈচিত্র্যে, বিষয়ভাবনার দুঃসাহসিকতা ও উপস্থাপনার সাবলীলতার মাধ্যমে এই লেখক একনিষ্ঠ জীবন পাঠ করেছেন। বিভাগ পরবর্তী বাংলাদেশের নাগরিক জীবনে পুঁজিবাদ ও বুর্জোয়াতন্ত্রের আগ্রাসন এবং পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থার আন্তঃসারশূন্যতা নবীন নাগরিক চেতনাকে অবসন্ন করে তুলেছিল। গ্রামবাংলা থেকে উঠে আসা সাধারণ মানুষের স্বপ্ন সাধনা নিমিষেই ধূলিসাৎ হয়ে গিয়েছিল। শেকড়-উন্মূল সেইসব মানুষের অস্থি-মজ্জায় অনুভূত হয়েছিল অস্তিত্বহীনতার আশঙ্কা। শিক্ষা, সংস্কৃতি, নীতি-নৈতিকতার চরম অবনতি মধ্যবিত্ত নাগরিক জীবনকে যে আত্মসংকটের মুখোমুখি হাজির করেছিল, তারই প্রামাণ্য দলিল গল্পগাঁথায় রূপায়িত হয়েছে তাঁর ছোটগল্পে।
সৈয়দ শামসুল হক এক আলাদা মানুষের নাম। এক আলাদা সত্তার উচ্চারণ।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল
আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)