ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে কারাগারে থাকা অবস্থায় লেখক ও কুমির চাষের পথিকৃৎ মুশতাক আহমদ কারাগারেই মৃত্যুবরণ করলো। এ নিয়ে বিক্ষোভ প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়লো শাহবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। সোশ্যাল মিডিয়ায় উঠেছে নিন্দার ঝড়। অনেকেই এ মৃত্যুর প্রতিবাদ করে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিচ্ছেন। যদিও এসব ক্ষোভ বিক্ষোভে মুশতাক আহমদের কিছু আসে যায়না। আর এসব প্রতিবাদ বিক্ষোভে তিনি আনন্দও পাবেন না। দুঃখও পাবেন না। কারণ তিনি আর এখন কোনো মানুষ নন। তিনি এখন লাশ। আজকাল যে মানুষ মানুষের পাশে দাঁড়ায়না দাঁড়ায় লাশের পাশে। এটা তারই আরও আরেকটি প্রমাণ। মুশতাক আহমেদকে কে চিনতো আগে? এত মানুষ উনাকে চেনে ও ভালবাসে এটা তিনি বুঝতে পারলে নিশ্চয়ই মনে সুখ পেতেন। কিন্তু জীবিতকালে যারা তাকে চিনতো কিভাবে চিনতো? অনেকেই তাকে চিনতো পাগল হিসাবে। তিনি যে পাগল নন এটি প্রমান করতেই লেগেছে তার ৮ টি বছর। পাগল নয়তো কি তিনি ঠিকাদার না হয়ে, মুদি দোকানদার না হয়ে, সুবিধাবাদী নেতা না হয়ে, চাকরিজীবী না হয়ে হয়ে গেলেন কুমির চাষী। যে কুমির মানুষকে ধরে গিলে খায়। অথচ তিনি এই ভয়ংকর প্রাণীটিকেই উৎপাদন ও বিদেশে রফতানি শুরু করে দিলেন।
গতানুগতিকতার বাইরে যে কোনো নতুন কিছু যারাই করেছেন, যুগে যুগে তাদের ললাটেই পাগল অভিধাটি জুটেছে। পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘুরে এই কথাটি প্রথম যিনি বলেছিলেন তার ললাটেও তাই জুটেছিল। শাস্তিও পেয়েছিলেন তিনি। প্রচলিত সমসাময়িক আচার ও প্রথার বিরুদ্ধে গেলেই সেটাকে অন্যরা পাগলামি বলতে শুরু করে। জগৎ বিখ্যাত জ্ঞানী সক্রেটিসকেও জীবন দিতে হয়েছে বিচারের রায়ে। তার মৃত্যুর বহুদিন পর গ্রীসের আদালত তাকে নির্দোষ ঘোষনা করলো। আরেকটা বিষয় হলো সকল সৃজনশীল মানুষই এলাকায় অসম্মানিত হয়েছে। ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক হযরত মুহম্মদ(সাঃ)কেও যাদুকর, পাগল অভিধা পেতে হয়েছে। মক্কা ত্যাগ করে মদিনায় হিজরত করতে হয়েছে তাকে। যিশু খ্রিষ্টকেও নিজ এলাকায় ক্রুশবিদ্ধ হতে হয়েছে। জার্মান দার্শনিক কার্ল মার্কসকে জার্মান ছেড়ে লন্ডনে আশ্রয় নিতে হয়েছে। কবি কাজী নজরুল ইসলামকেও শিশু বয়সেই বর্ধমান হতে ত্রিশালে চলে আসতে হয়েছে। শুধু কি তাই? অলি আউলিয়াদের বেলাতেও অনুরূপ ঘটনা। হযরত শাহজালালের মাজার সিলেটে। কিন্তু তিনি সিলেটের নন। হযরত শাহ সুলতানের মাজার নেত্রকোনার মদনপুরে কিন্তু তিনি এই এলাকার নন। হযরত বুড়াপীরের মাজার মদনে কিন্তু তিনিও এ এলাকার নন। সোজা কথায় কোন জ্ঞানী গুণীই নিজ এলাকায় জীবদ্যশায় সম্মানিত হতে পারেন না। অসাধারণ গুণী হতে সাধারন গুণী পর্যন্ত সকলের বেলাতেই কেন জানি এমনটি ঘটে চলছে যুগযুগ ধরে।
কুমির চাষী মুশতাকের পাগল খ্যাতি পাওয়াটা তাই অস্বাভাবিক কিছু নয়। মুশতাক আহমদ কারাগারে ছিল। কই তার কারামুক্তির জন্যতো কোনো উচ্চবাচ্য হলোনা। তিনি জামিন পাচ্ছিলেন না, হাসপাতালে স্থানান্তরিত হচ্ছিলেন না। কই এ নিয়ে তো কোন উচ্চবাচ্য হলোনা। আসলে বাস্তবতা এমনই। মানুষ মানুষের পাশে দাঁড়ায়না। দাঁড়ায় লাশের পাশে। জীবনে যারা খবর নেয়নি তারাও লাশের পাশে জানাযায় দাঁড়ায়। জীবনে যারা যাকে নূন্যতম সম্মান করেনি তারাও তখন মুঠো ভরে সম্মান জানায় তাকে। খুনীকেও দেখা যায় খুন করে লাশের পাশে দাঁড়িয়ে সম্মান জানাতে। জীবনে যারা এতটুকু মমতা প্রদর্শন করেনি তারাও মরণে লাশের উদ্দেশ্যে মমতার ঢালি খুলে দেয়। বড় বিচিত্র মানুষের এই সম্মান ও মমতাবোধ। মুশতাককে নিয়ে দেশব্যাপী মিছিল হচ্ছে। জীবদ্দশায় তা দেখলে তিনি নিশ্চয়ই খুশিই হতেন। কিন্তু এগুলো হয় তখনই যখন মানুষটি খুশি অখুশি, হাসি, আনন্দ ও দুঃখ বেদনার সকল অনুভূতির উর্ধে উঠে যায়। কেন হয় এসব?
কেউ এসব করে নিজেদের ভালত্ব ও মানবিকতা প্রদর্শনের জন্য। কেউ করে ইস্যুবাজিতে লিপ্ত হয়ে।কেউ করে আবেগে। মৃত ব্যক্তিকে পদক দিতেও দেখা যায়। দেখা যায় তাকে নিয়ে গবেষণা করে কোটি কোটি টাকা খরচ করতে। অনেক সৃজনশীল গুণী ব্যক্তি জীবদ্দশায় কোন ধরনের আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতা পাননি। কিন্তু মরার পরে তার নামাংকন,স্মৃতি সংরক্ষন ও গবেষনায় ব্যয় হয় কোটি কোটি টাকা।এগুলোই হয়ে উঠছে সৃজনশীল গুণীদের নিয়তি। কারাগারে নিহত হওয়া মুশতাকও সেই নিয়তিবাদেরই করুণ শিকার হলেন। তাকে নিয়ে যে এত হৈচৈ তা কি তার সৃজনশীলতার জন্য নাকি লাশের প্রতি আবেগে? এদেশের কজন মানুষ তার লেখা পড়ত ও তার বই পড়তো? মুশতাক কার সমালোচনা করলো সরকারের নয় কি? পুলিশ জনগণের বেতনভুক্ত সরকারী কর্মচারী মাত্র। ফেসবুকের একটি সামান্য স্ট্যাটাসে তাকে কেন কারাগারে প্রেরণ করলো? এই ফেসবুক স্ট্যাটাসে কী আর ক্ষতি হয়ে গেল সরকারের?
ফেসবুক স্ট্যাটাসে যদি কাউকে কারাগারে যেতে হয় তাহলে পথে ঘাটে, খেলার মাঠে, ঘরে ও চায়ের দোকানের সমালোচকদেরকেও তো কারাগারে নেয়ার কথা। এসবের অনলাইন সংস্করণ হলোই তো এই ফেসবুক। এই সমাজ ও দেশ যেমন সব মানুষের ফেসবুকও তাই। এজন্য কারাগারে নেয়ার, নির্যাতন করার অধিকার পুলিশকে কি জনগণ দিয়েছে? কেন তারা এমন অতিউৎসাহী ক্ষমতাবাজী করে চলছে? একজন কার্টুনিস্ট কার্টুন আঁকবে তার স্বাধীন শৈল্পিক সৃৃজনশীলতা দিয়ে। আর সেটা কেউ ফেসবুকে প্রচারও করবে তার স্বাধীন নাগরিক মতামত অনুযায়ী। এখানে বিধিনিষেধ আরোপ করলে ড্রয়িং রুমে, রান্না ঘরে, খেলার মাঠে ও চায়ের দোকানেও বিধিনেষেধ আরোপ করা উচিত নয় কি?তবে হয়ে যাক না একটা টকিং নিরাপত্তা আইন! চায়ের দোকানেও কারও কোন বক্তব্য শেয়ার করলেই তাকে ধরা হবে। দেশটাকে কি তবে এমন অবস্থার দিকেই নিয়ে যাওয়া হচ্ছে? মুশতাক আহমদকে কেন কারাগারে নেয়া হল। কারা এর মূলে? কেন তাকে জামিন দেয়া হলনা? কেন হাসপাতালে নেয়া হলোনা এই প্রশ্নগুলোর উত্তর জানতে চায় দেশবাসী।
মুশতাক আহমদ জেনে গেল একজন খুনের আসামী, ধর্ষনের আসামী, হাজার কোটি টাকা দুর্নীতির আসামী জামিন পেতে পারে কিন্তু সামান্য একটা ফেসবুক স্ট্যাটাস দিয়ে তিনি পেতে পারেন না। মাসের পর মাস কারাগারে রেখে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়া হলো তাকে। এদেশটা কোন পুলিশী রাষ্ট্র নয় যে পুলিশ যাকে তাকে ধরে কারাগারে পুরবে। কাউকে নির্যাতন করবে আর কাউকে বিনোদনের জন্য কারাগারেই নারী সঙ্গের ব্যবস্থা করে দেবে। এর একটা বিহিত হওয়া দরকার। আইন নাগরিকের জন্য।নাগরিকের জন্য আইন নয়। তাই নাগরিকরাই যেহেতু ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের দাবী জানাচ্ছে তাই অবশ্যই তা বাতিল করা উচিত। নইলে এ আইনে মুশতাকের মতো অনেককেই জীবন দিতে হতে পারে। এখন শোনা যাচ্ছে কার্টুনিস্ট আহমেদ কিশোরও কারাগারে গুরুতর অসুস্থ। মুশতাক এই আইন বাতিলের খবরে উল্লসিত হতে না পারলেও অন্যদের জীবনের প্রয়োজনে তা বাতিল করা উচিত। সংবাদ পত্র সূত্রে সেন্টার ফর গভর্নেস স্টাডিস(সিজিএস) এর বরাতে এক তথ্যে জানা গেছে ২০২০ সালের ১ জানুয়ারী হতে ২০২১ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ৭৮৩ টি মামলা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে সিজিএস ৪০২ টি মামলার তথ্য সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছে। ৪০২ টি মামলায় মোট অভিযুক্ত ৮৭৩ জন। এই ৮৭৩ জনের মধ্যে আর কেউ মুশতাক হবেনা এর কি গ্যারান্টি আছে কোন? কেউ বলছে ভয় দেখানোর জন্যই মুশতাকের এই মৃত্যুর ঘটনা ঘটানো হয়েছে।
মুশতাকের মৃত্যু দেখে অন্যরা ভয় পেয়ে চুপসে থাকবে এমন উদ্দেশ্য কোনো মানবিক হতে পারেনা।কারাগারে মুশতাকের মৃত্যু ঘটেছে। কারান্তরিন শিশির সহ অন্যদের আর কোন মৃত্যুর খবর শুনতে চায়না জাতি। ইতোমধ্যে মুশতাকের মৃত্যুর নিন্দা জানিয়েছে জাতিসংঘ, বিদেশী কূটনীতিকরা, নিন্দা জানাচ্ছে দেশী বিদেশী সংবাদ মাধ্যম, মানবাধিকার সংগঠন ও এ দেশের ছাত্রজনতা। সুতরাং এই আইন বহাল রাখার আর কোন যৌক্তিকতা নেই। ভয় দেখিয়ে কথা বলার স্বাধীনতা কেড়ে নেয়া কোন সভ্য সমাজের রীতি হতে পারে কি? মুশতাক মরে গিয়ে সে প্রশ্নটাই রেখে গেল সবার কাছে। আমরা এ প্রশ্নের উত্তরে না বলতে চাই। চাই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিলুপ্তি। মানুষ কথা বলবে, মানুষ কবিতা লিখবে, গল্প উপন্যাস লিখবে, কার্টুন আঁকবে, গান গাইবে।কারও সেগুলো ভালো লাগবে কারও ভালো লাগবেনা। এমনটাই জীবন ও সমাজের স্বাভাবিক রীতি।এর ব্যতয় হতে পারেনা। তাই আমাদের দাবী কথা বলার অধিকার হরণের সকল কার্যক্রম অবিলম্বে বাতিল করা হোক।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)