চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

ভয়াল ২৫ মার্চ: লাশের স্তুপে ভরে যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস

ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে পরবর্তীকালে সব আন্দোলনের সূতিকাগার হিসেবে ভুমিকা পালন করা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল হানাদার পাকবাহিনীর আক্রমণের প্রধান লক্ষ্য। ‘অপরাশেন সার্চলাইটের’ আওতায় ২৫ মার্চ কালরাতে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের আক্রমণের মধ্য দিয়ে গণহত্যা শুরু করা পাকবাহিনী পরাজয়ের ঠিক পূর্বমুহূর্তে আবারও আক্রমণ চালায় এ বিশ্ববিদ্যায়েই। জাতির শ্রেষ্ঠসন্তান শিক্ষকদের হত্যা করে স্থাপন করে ইতিহাসের জঘন্যতম দৃষ্টান্ত।

স্বাধীনতার পর নির্মম সে গণহত্যার জন্য ক্ষমা না চেয়ে বারবার সে দায় অস্বীকার করে আসছে পাকিস্তান। এর প্রতিবাদে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে দেশটির সঙ্গে সব ধরনের সম্পর্ক ছিন্ন করে সহস্র শহীদের রক্তের দাগ বয়ে বেড়ানো দেশের সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠানটি। স্বাধীনতার ৪৪ বছর পর ২০১৫ সালের ১৪ ডিসেম্বরে নেওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন সিদ্ধান্ত পাকিস্তানের মিথ্যাচার এবং নির্লজ্জতার বিরুদ্ধে উপযুক্ত জবাব বলেও আলোচিত হয় তখন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের মতে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার বিষয়টি ছিল গণহত্যার দায় অস্বীকার করে আসা দেশটির মিথ্যাচার ও নির্লজ্জতার জবাব।

২৫ মার্চ কালোরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘটিত গণহত্যা সম্পর্কে চ্যানেল আই অনলাইনকে উপাচার্য বলেন, পাকবাহিনী এ বিশ্ববিদ্যালয়ে আক্রমণ করে দেশের শ্রেষ্ঠসন্তানদের হত্যা করে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে বাঙালিকে পঙ্গু করতে চেয়েছিল। কিন্তু ২৫ মার্চ রাতের বর্বোরোচিত সে হত্যাকাণ্ডের খবর ছড়িয়ে পড়লে দেশবাসী হানাদারদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে আরও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে ওঠে। যার ফলে শেষ পর্যন্ত তাদের পরাজিত করে দেশকে স্বাধীন করা সম্ভব হয়েছিল।

সম্প্রতি ২৫ মার্চকে গণহত্যা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে জাতীয় সংসদ। চেষ্টা চলছে জাতিসংঘের মাধ্যমে দিবসটির আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জনেরও।

বিশ্ববিদ্যালয়ে যেভাবে গণহত্যা চালায় পাকবাহিনী
‘গভীর রাতে প্রথমে আক্রমণ করা হয় ইকবাল হলে (জহুরুল হক হল)। পাকসেনারা কক্ষে ঢুকে গুলি করে অনেক ঘুমন্ত ছাত্রকে হত্যা করে। জগন্নাথ হলেও নারকীয় হত্যাকাণ্ড চালানো হয়। শত শত ছাত্রের লাশ সেদিন জগন্নাথ হলের সিঁড়িতে, বারান্দায় ও রাস্তায় স্তুপ হয়ে পড়েছিল। ছাত্রদের হত্যার পর মাঠে গণকবর দেয়। ছাত্রীদের রোকেয়া হলেও পাকসেনারা চালায় নির্মম পাশবিক নির্যাতন।’

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ গভীর রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাকবাহিনীর এমন বর্বোরোচিত চিত্র তুলে ধরেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আবু মোঃ দেলোয়ার হোসেন তার ‘স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস’ বইয়ে। বইটিতে ইতিহাস বিভাগের এ অধ্যাপক আরও বর্ণনা করেছেন শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারিদের ওপর নারকীয় হত্যাযজ্ঞের ঘটনাও।

তার মতে, ২৫-২৬ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়টির মোট ৩০০ জন ছাত্র-কর্মচারী হত্যা করা হয়।

আর্চার কে ব্লাড-এর বই “The Cruel birth of Bangladesh” থেকে জানা যায় যে, ছাত্রীদের রোকেয়া হলে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয় এবং ছাত্রীরা আগুন থেকে বাঁচতে হলের বাইরে আসা শুরু করলে পাকবাহিনী তাদের উপরে নির্বিচারে গুলি চালায়।

পাকবাহিনী নিয়ন্ত্রণ কক্ষের সাথে আর্মি ইউনিট ৮৮ এর কথোপকথন থেকে জানা যায়, রোকেয়া হলে আনুমানিক ৩০০ জন ছাত্রীকে সেসময় হত্যা করা হয়।

যে কারনে টার্গেট ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বিভিন্ন গ্রন্থ এবং ইতিহাসবেত্তাদের জবানী থেকে জানা যায়, অপারেশন সার্চলাইটে ঢাকা শহরে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় প্রাধান্য দিয়ে পাকিস্তান সামরিক কর্তৃপক্ষ তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে যে আটটি সিদ্ধান্ত নেয় তারমধ্যে অন্যতম ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আক্রমন। কারণ বাংলাদেশের মহান মুক্তিসংগ্রামের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে পরিগণিত হওয়া বিশ্ববিদ্যালয়টি কেবল ভাষা আন্দোলনই নয় পরবর্তীতে সংগঠিত সবগুলো আন্দোলনের সবচেয়ে বেশি ভুমিকা রাখে। তাছাড়া পাকিস্তান সামরিক জান্তার কাছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচিতি ছিল আওয়ামী লীগের শক্তিকেন্দ্র হিসেবে। অসহযোগ আন্দোলনের বেশিরভাগ ছাত্রনেতাও ছিলেন এখানকারই। পাকবাহিনীর ধারণা ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে থামিয়ে দিতে পারলে গতি হারাবে বাঙালিদের প্রতিরোধ ব্যবস্থা। তাইতো অপারেশন সার্চলাইটের শুরুতেই এ ক্যাম্পাসে আক্রমন চালিয়ে নির্বিচারে হত্যা করে শিক্ষক-ছাত্র এবং কর্মকর্তা-কর্মচারিদের।

২২ নং বালুচ, ১৮ ও ৩২ নং পাঞ্জাব রেজিমেন্টের বাছাই করা একদল সৈন্য তৎকালীন ইকবাল হল(শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) এবং জগন্নাথ হলে আক্রমন চালায়।প্রথমেই আক্রমন চালায় ইকবাল হলে যে হলটি ছিল অসহযোগ আন্দোলনের নিয়ন্ত্রন কক্ষ এবং আন্দোলনের অধিকাংশই নেতা থাকতেন এ হলে।ছাত্ররা সাধারণ অস্ত্র দিয়ে সে আক্রমন প্রতিহত করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন।একই সঙ্গে আক্রমন করা হয় জগন্নাথ হল এবং রোকেয়া হলেও।সেখানে নির্বিচারে হত্যাকাণ্ড পরিচালনার পর পুরো বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় তাণ্ডব চালিয়ে পুরো ক্যাম্পাসকে পরিণত করে লাশের স্তুপে।

এবারের গণহত্যা দিবসে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মসূচি

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে পাক-হানাদার বাহিনীর আক্রমণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিহত শহীদদের স্মরণে ২৫ মার্চ কালরাত ও গণহত্যা দিবস পালন উপলক্ষে জগন্নাথ হলের ‘কালরাত ও গণহত্যা দিবস পালন কমিটি’হাতে নিয়েছে বিস্তারিত কর্মসূচি। শনিবার সকাল ১০টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত হল প্রাঙ্গণে আয়োজন করা হয়েছে নানা অনুষ্ঠানের।এর মধ্যে রয়েছে সকাল ১০টায় চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, সন্ধ্যা ৬টায় শহীদদের স্মরণে স্থাপনাশিল্পের প্রদর্শন, ৭টায় নাট্যানুষ্ঠান, রাত ৮টায় দেশাত্মবোধক গান ও কবিতা আবৃত্তি, ১১টায় মশাল প্রজ্জ্বলন, ১১টা ৫৯ মিনিটে গণসমাধিতে মোমবাতি প্রজ্বলন এবং শ্রদ্ধা নিবেদন।

রাত ১১টায় মশাল প্রজ্জ্বলনের মাধ্যমে স্মরণ অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করবেন উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক এবং প্রধান অতিথি থাকবেন বাংলাদেশ সরকারের মুক্তিযুদ্ধমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক এমপি। বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ দপ্তর এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানিয়েছে।

অন্ধকার থেকে আলোর পথে যাত্রা

কালরাত স্মরণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে শনিবার রাত ১১টা ৫৯ মিনিট থেকে রোববার ১২টা ১ মিনিট পর্যন্ত সব বৈদ্যুতিক আলো নিভিয়ে দেওয়া হবে। আলোক প্রজ্বালনের মাধ্যমে স্মরণ করা হবে ওই দিনের শহীদদের।

শুক্রবার বিকেলে জগন্নাথ হলের প্রাধ্যক্ষের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক অসীম সরকার জানান, ২৫ মার্চের কালরাত স্মরণে সব বৈদ্যুতিক বাতি নিভিয়ে দেওয়া হবে। পরে মোমবাতি প্রজ্বালন করে সে আঁধার দূরীভূত করা হবে। ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসের মাধ্যমে যেভাবে নতুন দিনের সূচনা হয়েছিল, তেমনি প্রথম প্রহরে সে আলো আবার জ্বেলে দেওয়া হবে।