ঝড়, বন্যার দেশ হিসেবে এক সময় পৃথিবীতে বাংলাদেশের পরিচিতি ছিল। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে দুর্যোগের ঝুঁকি ও মাত্রা বেড়েছে কিন্তু ঝড়-বন্যার মতো নদী বা সাগর অর্থাৎ পানি কেন্দ্রিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় আমাদের সক্ষমতা বেড়েছে। কিন্তু সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে আমাদের দেশে ভূমিকম্পের মতো দুর্যোগের ঝুঁকি বেড়ে চলেছে।
অনেকদিন থেকে শোনা যাচ্ছিল, দুর্যোগ বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছিলেন আমরা মারাত্মক ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছি। দেখা যাচ্ছে আমাদের দেশে ভূমিকম্পের আঘাতের মাত্রা বাড়ছে; বাড়ছে ভূমিকম্পের স্থায়িত্ব এবং দুটো ভূমিকম্পের সময়ের ব্যবধান কমে আসছে। বন্যা বা জলোচ্ছ্বাসের মতো দুর্যোগের আগে মানুষকে সতর্ক করে দেওয়া, তাদের নিরাপদে সরিয়ে নেয়ার মতো পূর্ববর্তী ও পরবর্তী কিছু পদক্ষেপ নেয়ার সুযোগ থাকলেও ভূমিকম্পের ক্ষেত্রে সেটা আমাদের মতো প্রযুক্তিগতভাবে পিছিয়ে থাকা দেশের জন্য সম্ভব হয় না।
আবার নগরের বিস্তারের সাথে সাথে আমরা বেপরোয়া হয়ে উঠছি। কাঠামো পরিকল্পনা ও ভবন নির্মানে ত্রুটি, ভবনের ধারণ ক্ষমতার থেকে তার উপর বেশি চাপ এগুলো যেমন আছে তেমনি জলাধার, জলাশয় ভরাট করছি অবলীলায়। কেউ বাঁধা দিচ্ছে না, আইন আছে কিন্তু প্রয়োগ নেই। যারা প্রয়োগ করবেন বলে খাতা কলমে লেখা আছে তারা কীভাবে যেন ম্যানেজ হয়ে যাচ্ছেন। ফলে শহর বাড়ছে- মানুষ বাড়ছে আর আমাদের দল বেঁধে মরার ঝুঁকি বাড়ছে। আমরা এখন চাইলেই ঝুঁকি থেকে মুক্ত হতে পারবো না কিন্তু যদি পরিকল্পনা করি ও তার বাস্তবায়ন করি তাহলে সেই ঝুঁকি কমিয়ে আনতে পারবো বা এই ধরনের দুর্যোগ পরবর্তী ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে আমরা কিছুটা এগিয়ে থাকতে পারবো।
দেখা যাচ্ছে ভূমিকম্প শুরু হলে মানুষ ছোটাছুটি করছে। পাঁচ তলা ভবন থেকে দৌড়ে নীচে নেমে আসছে, কিন্তু এদের অনেকেই জানেন এই ধরনের দুর্যোগের সময় নিরাপদ জায়গায় আশ্রয় নিতে হয়। দৌড়াদৌড়ি বরং বড় বিপদ ডেকে আনতে পারে। কিন্তু সেটা জানার পরেও হচ্ছে না। তার অর্থ আমরা যদি সচেতন হয়েও থাকি তাহলে বিপদের সময় সেই সচেতনতা কাজে আসছে না। এটা মানুষকে মনে করিয়ে দেয়া দরকার- বার বার দরকার। সেটা সরকার করতে পারে– গণমাধ্যম তার সামাজিক দায় থেকে করতে পারে। এ ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে গণমাধ্যমে ভূমিকম্পের সংবাদ আসছে কিন্তু এই ধরনের দুর্যোগের সময় করণীয় কী সেটা আসছে না। সমাজে বিরাট প্রভাব সৃষ্টিকারী এই মাধ্যমটি কেবল রি-এক্টিভ তৎপরতার মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়েছে।
দেখা যাচ্ছে, যে ভূমিকম্প হচ্ছে তার বেশিরভাগ রাতের বেলা। আমার সাথে অনেকে একমত হবেন দিনের বেলা বিশেষ করে অফিস চলাকালীন সময়ে এই ধরনের ভূমিকম্প হলে ক্ষয়-ক্ষতির মাত্রা বহুগুণে বাড়বে। কেবল তৈরি পোশাক কারখানায় যখন শ্রমিকরা কাজ করেন সেই সময়ে এই ধরনের ভূমিকম্প হলে তাড়াহুড়ো করে নামতে গিয়ে বড় বিপদের সম্ভাবনা থেকে যায়। পোশাক কারখানায় তাড়াহুড়া করে নামতে গিয়ে আগেও মানুষের প্রাণহানী ঘটেছে। তাহলে এই ধরনের স্থাপনায় বা শিল্প কারখানায় আমাদের করণীয় কী? এখানে যারা কাজ করেন তাদের সচেতন করা, নিয়মিত মহড়ার ব্যবস্থা করা, এই ভবনগুলো দুর্যোগসহিষ্ণু কী না সেটা দেখা, যদি বিপদ ঘটার সম্ভাবনা থাকে তাহলে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া। কেননা এই ধরনের ভবন যদি বিপর্যয়ের মুখে পড়ে তাহলে মানুষের উপর, সম্পদের উপর, ব্যবসা ও দেশের ভাবমূর্তির উপরে তার প্রতিক্রিয়া কেমন হয় সেটা রানা প্লাজা থেকে দেখেছি।
গত বুধবারের ভূমিকম্পের পরে চট্টগ্রামে যে নয়টি ভবন হেলে পড়েছে, জানা গেছে তার দুটো ভবন দ্রুত ভেঙ্গে ফেলার জন্য নগর উন্নয়ন অথরিটির পক্ষ থেকে ভবনের মালিককে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে এই ভবন দুটো নিয়ম মেনে নির্মিত হয়নি। হয়তো সেটা ঠিক। কিন্তু যখন ভবন দুটো নির্মিত হয় তখন যাদের দেখার কথা ছিল তারা কেন দেখেনি? এই প্রশ্নের উত্তর কোনদিন পাওয়া যাবে না। আবার ওইদিন এই হেলে পড়া ভবনে আরও বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটতো- প্রাণহানীর ঘটনা ঘটতো তাহলে তার দায় দেখাশোনার দায়িত্ব যাদের ছিল তারা কি নিতেন?
বছর তিনেক আগে বাংলাদেশ প্রতিদিন-এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিলো, ঢাকায় প্রায় চারশটি ভবন ঝুঁকিপূর্ণ। এই ভবনগুলো সরিয়ে ফেলার তোড়জোড় তখনই শুরু হয় যখন কোনো দুর্ঘটনা ঘটে বা মানুষ মারা যায়। আমরা সভ্য হচ্ছি বলে দাবি করছি কিন্তু দেখা যাচ্ছে- রাস্তায় গাড়ি চাপা পড়ে কেউ মারা যাবার পরে-ই সেখানে আমরা ফুট ওভার ব্রীজ বানাই, মানুষ যখন পরিবার-পরিজন নিয়ে ঝিলের পানিতে তলিয়ে যায়; তার পরে আমরা ছুটে যাই ঝিলের ভেতরে অবৈধভাবে গড়ে তোলা ঘর সরাতে, খোলা ম্যানহোলে শিশু পড়ে নিখোঁজ না হওয়া পর্যন্ত আমরা সেই ম্যানহোলের মুখ বন্ধ করি না।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাকে গুরুত্ব দিয়ে সরকার আগের খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়কে আলাদা করেছেন এবং একজন পূর্ণ মন্ত্রীকে মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দিয়েছেন। কিন্তু এই সেক্টরটির সাথে যারা কাজ করেন তাদের অনেকের অভিমত হলো দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় যথাযথভাবে কাজ করতে পারছে না বা তারা তাদের দায়িত্ব সম্পর্কে অবহিত নয়। বিশেষ করে মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর তৎপরতা খুব একটা চোখে পড়ে না। অথচ পরিবর্তিত পরিস্থিতি বিবেচনায় এই মন্ত্রণালয়ের সক্রিয়তা খুব জরুরি।
একই সাথে এই ধরনের দুর্যোগ মোকাবেলায় জন্য যে বিদেশী অর্থ আসছে সেটা সরকারী চ্যানেলে বা এনজিওদের মাধ্যমে সেটা সঠিক কাজে লেগেছে কিনা তাও খুঁজে বের করা দরকার। যতটুকু জানি, এনজিওর মাধ্যমে যে অর্থ আসে তার বেশিরভাগ চলে যায় সে সব প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের বেতন ভাতার পেছনে। সরকারী অর্থের অপচয়ের খবর মাঝে মাঝে পত্রিকায় এলেও এদের অর্থের নয়ছয়ের খবর মানুষ জানে না।
ঢাকা শহরে এই ধরনের দুর্যোগ দেখা দিলে শুধু ফায়ার সার্ভিস দিয়ে মোকাবেলা করা যাবে না বলে দুর্যোগ বিশেষজ্ঞরা বারবার সতর্ক করছেন। এদেরকে আধুনিকায়ন করা হচ্ছে ঠিক কিন্তু এই ধরনের একটা ঘটনায় পরে সৃষ্ট পরিস্থিতি মোকাবেলায় তাদের ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা রয়েছে। ঢাকায় একটা বড় ভূমিকম্প হলে শুধু ভবন-ই ধসে পড়বে না আমাদের শহরে জালের মতো ছড়িয়ে থাকা গ্যাসের বিস্তীর্ণ পাইপ লাইন বিস্ফোরণে এবং যত্রতত্র বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া বিদ্যুৎ সংযোগ লাইনের কারনেও এক ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে সেটা আমরা না চাইলেও।
শহরের রাস্তাগুলো সরু হওয়ায় উদ্ধারকারী যানবাহনের চলাচল, পানির উৎস না থাকায় অগ্নি নির্বাপণে এক মহাসংকট আমাদের সামনে অপেক্ষা করছে। যেহেতু আমাদের সামনে বিপদের আলামত স্পষ্ট তাই আমরা অন্ধ সাজার ভান করলেও প্রলয় বন্ধ হবে না। আমাদের প্রস্তুতি নিতে হবে। ভূমিকম্পের ফলে কী ক্ষতি হবে সেই তথ্য পাঠককে সামনে তুলে ধরা এই লেখার উদ্দেশ্যে নয়, আমাদের সামনে একটা বড় দুর্যোগ অপেক্ষা করছে- যা ইচ্ছে করলেও আমরা ঠেকাতে পারবো না। কিন্তু সেই দুর্যোগের ফলে সৃষ্ট বিপর্যয় মোকাবেলায় আমাদের দ্রুত এবং সমন্বিত কিছু প্রস্তুতি নেয়া দরকার সেটা নীতি নির্ধারকদের সামনে আবার তুলে ধরার প্রয়াস।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল
আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)