‘সাংবাদিকতা’র সঙ্গে দিন দিন যত বেশি ‘ডিজিটাল’ বিষয়টা যুক্ত হচ্ছে, ততই বেড়ে যাচ্ছে ভুল তথ্য আর ভুয়া খবরের প্রাচুর্য।
সুখবর হচ্ছে মানুষ এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি সচেতন ভুয়া খবর নিয়ে। ফলে বিশ্বাসযোগ্য খবরের জন্য এখন তারা আরও বেশি ঝুঁকছে বিশ্বের প্রতিষ্ঠিত ও তুলনামূলক বিশ্বস্ত সংবাদমাধ্যমগুলোর দিকে।
কিন্তু একই সঙ্গে একটি দুঃসংবাদও আছে। আর তা হলো, ভুয়া খবর নিয়ে সাবধানতা বাড়লেও অনলাইন প্ল্যাটফর্মে বিশ্বাসযোগ্য ও ভালো মানের সাংবাদিকতাকে এগিয়ে নেয়ার জন্য অর্থ খরচ করতে পাঠকদের মধ্যে আগ্রহ বিন্দুমাত্র বাড়েনি।
এমনই দুঃখজনক এক তথ্য বেরিয়ে এসেছে যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বার্তা সংস্থা রয়টার্সের গবেষণা প্রতিষ্ঠান রয়টার্স ইনস্টিটিউটের এ বছরের ‘ডিজিটাল নিউজ রিপোর্ট’-এ।
ডিজিটাল সাংবাদিকতা নিয়ে বিশ্বের অন্যতম প্রধান এ গবেষণা প্রকল্পের অংশ হিসেবে এবার পৃথিবীর ৩৮টি দেশের ৭৫ হাজার মানুষের ওপর একটি অনলাইন জরিপ চালিয়েছে রয়টার্স ইনস্টিটিউট। জরিপে পাওয়া ফলাফলে দেখা গেছে, এদের মধ্যে ৫৫ শতাংশ মানুষ জানিয়েছে যে তারা ডিজিটাল মাধ্যমে সংবাদের রূপধারী ভুল ও বিভ্রান্তিকর তথ্য নিয়ে উদ্বিগ্ন।
গবেষণায় দেখা গেছে, ৩৮টি দেশের মধ্যে অনেকগুলোতে সরকার এবং গণমাধ্যমের ব্যাপক চেষ্টার পরও ভুয়া খবরের প্রসার ঠেকানো তো যাচ্ছেই না, বরং তা বাড়তির দিকে।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ‘ইন্টারনেটে পাওয়া কোন তথ্যটি আসল আর কোনটি ভুয়া তা নিয়ে আমি চিন্তিত’ এ বাক্যটির সঙ্গে যুক্তরাজ্যের ৭০ শতাংশের বেশি উত্তরদাতা একমত পোষণ করেছেন। গত বছরের জরিপে পাওয়া ফলাফলের তুলনায় এবার যা ১২ শতাংশ বেশি।
গবেষণা প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, যুক্তরাজ্যের এই ৭০ শতাংশের চার ভাগের প্রায় এক ভাগ তথ্যের জন্য তুলনামূলকভাবে ‘নামকরা’ ও ‘বিশ্বাসযোগ্য’ সংবাদের উৎসের দিকে ঝুঁকছে। যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে এই হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে শতকরা ৪০ ভাগে।
অবশ্য সংবাদের নামকরা ও বিশ্বাসযোগ্য সূত্রের সংজ্ঞা নির্ধারণের কাজটি ছেড়ে দেয়া হয়েছে উত্তরদাতাদের ওপরই। যেমন, যুক্তরাজ্যের এক উত্তরদাতা বিস্তারিত সাক্ষাতকারের সময় বলেছেন, বিশ্বস্ত সূত্র বলতে তিনি মনে করেন তার দেশের বিবিসি, গার্ডিয়ান বা ইন্ডিপেনডেন্টের মতো চিরাচরিত বা ঐতিহ্যবাহী সংবাদমাধ্যমগুলোকে, যেগুলো বহু বছর ধরে সাংবাদিকতা করে আসছে।
কিন্তু বৈশ্বিকভাবেই বিশ্বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে ডিজিটাল সংবাদ। বিশেষ করে ফ্রান্সে এই পতন চোখে পড়ার মতো। ধারণা করা হচ্ছে, ইয়েলো ভেস্ট আন্দোলনের কাভারেজ নিয়ে বিভক্তি এর কারণ।
যুক্তরাজ্যেও সংবাদের প্রতি ভরসা করা মানুষের সংখ্যা কমে ৪০ শতাংশে ঠেকেছে। ২০১৫ সালে যা ছিল ৫১ শতাংশ।
বিশ্বস্ত সংবাদমাধ্যমের তালিকায় এ বছর শীর্ষে আছে বিবিসি। তার পরে রয়েছে যথাক্রমে আইটিভি নিউজ, ফিনান্সিয়াল টাইমস এবং চ্যানেল ৪ নিউজ।
তবে প্রতিবেদনটিতে সতর্ক করে এটাও বলা হয়েছে যে, ব্রেক্সিট এবং জলবায়ু পরিবর্তনসহ বিভেদ সৃষ্টিকারী ইস্যুগুলো সংবাদমাধ্যমের প্রতি অডিয়েন্সের ভরসাকে অনেকাংশে প্রভাবিত করে। এসব ক্ষেত্রে মানুষের মনে প্রশ্ন জাগে, মাধ্যমটি ওই ইস্যুতে কোনো বিশেষ এজেন্ডাকে অনুসরণ করছে বা লুকানোর চেষ্টা করছে কি না।
ডিজিটাল নিউজ রিপোর্টের অন্যতম লেখক নিক নিউম্যান এ বিষয়ে বলেছেন, বিশ্বস্ততা হারানোর প্রবণতা সবচেয়ে বেশি প্রকট হয়েছিল ইউরোপীয় ইউনিয়নের গণভোটের ঠিক পরই। মূলত তখন থেকে ‘মানুষ অনুভব করা শুরু করেছে যে, গণমাধ্যম, বিশেষ করে নিজেদেরকে নিরপেক্ষ দাবি করা সংবাদমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলো গণমানুষের মতকে প্রতিফলিত করছে না।’
আমেরিকানদের মধ্যে অবশ্য এই বিশ্বস্ততা কমেছে মাত্র ৯ শতাংশ। ধারণা করা হচ্ছে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বিভিন্ন ইস্যুতে প্রথম থেকেই বেশ কিছু বড়সড় মিডিয়া আউটলেটকে ‘জনগণের শত্রু’র তকমা দিয়েছেন বলে জনগণ সেগুলোকে নিয়ে ভাবছেই না তেমন।
এত অবিশ্বাসের মাঝেও পয়সা খরচে নারাজ পাঠক
ভুয়া খবর নিয়ে এত সচেতনতা, সত্য সংবাদ পেতে এত আকুতি, তবুও ভালো মানের সাংবাদিকতাকে টিকিয়ে রাখতে অনলাইন পাঠক সমাজের মধ্যে তেমন একটা আগ্রহ দেখা যায়নি। বিশ্বাসযোগ্য সংবাদ আধেয় সবাই পেতে চায়। কিন্তু সেটি পেতে সামান্য খরচ করতে চায় না তেমন কেউই।
জরিপে দেখা গেছে, অর্থের বিনিময়ে ডিজিটাল নিউজ মিডিয়ার সাবস্ক্রিপশন বা মেম্বারশিপ কেনা লোকের সংখ্যা আগের চেয়ে খুবই কম বেড়েছে। আর যা বেড়েছে তাও মূলত নর্ডিক দেশগুলোতে (নরওয়ে ৩৪%, সুইডেন ২৭%)।
২০১৬ সালে ট্রাম্প-ধাক্কার পর যুক্তরাষ্ট্রে তুলনামূলক বেশি সংখ্যক মানুষ অনলাইনে নিউইয়র্ক টাইমস ও ওয়াশিংটন পোস্টের সাবস্ক্রিপশন কেনা শুরু করেছিল। কিন্তু সেই পরিমাণটি তখন থেকে ১৬ শতাংশতেই আটকে আছে। অন্যদিকে যুক্তরাজ্যে পরিমাণটি আরও কম – মাত্র ৯ শতাংশ।
এই সাবস্ক্রিপশনের সংখ্যা বাড়াতে সংবাদমাধ্যমগুলো নানারকম চেষ্টা করছে। নতুন স্কিম থেকে শুরু করে পেইড মেম্বারদের জন্য অতিরিক্ত বা বিশেষ আধেয়, আরও কত কিছু। কিন্তু তারপরও কাজ হচ্ছে না। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, মানুষ এখন সংবাদের পেছনে টাকা খরচ করার চেয়ে নেটফ্লিক্স বা স্পটিফাইয়ের মাসিক সাবস্ক্রিপশন কিনতেই বেশি পছন্দ করে।
জরিপে প্রশ্ন করা হয়েছিল, শুধু মাসিক সাবস্ক্রিপশন কেনার বিনিময়েই যে কোনো একটি সেবা পাওয়া যাবে, এমনটা হলে কোন সেবাটি তারা বেছে নেবেন? জবাবে ৩৭ শতাংশ ভিডিও সার্ভিস, ১৫ শতাংশ মিউজিক সার্ভিস এবং মাত্র ৭ শতাংশ সংবাদকে বেছে নেবেন বলে জানিয়েছেন।
সংবাদমাধ্যমের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ সামাজিক মাধ্যম-টেক জায়ান্ট
সংবাদ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগের প্রবণতা বর্তমানে আগের চেয়ে অনেকটাই ব্যক্তিগত রূপ নিয়েছে। মেসেজিং অ্যাপগুলোর ব্যাপক প্রসারের কারণে সংবাদ বিষয়ক যোগাযোগের জন্য মানুষ এখন এগুলোর ওপরই বেশি নির্ভরশীল।
ব্রাজিল (৫৩%), মালয়েশিয়া (৫০%) ও সাউথ আফ্রিকার (৪৯%) মতো পশ্চিমা দেশের বাইরের দেশগুলোতে সংবাদ নিয়ে আলোচনা এবং সংবাদের লিংক শেয়ারের জন্য বিশেষ করে হোয়াটসঅ্যাপ পরিণত হয়েছে প্রাথমিক নেটওয়ার্কে।
গবেষণার অধীন ৩৮টি দেশের মধ্যে অনেকগুলো দেশেই মানুষ ফেসবুক ব্যবহার কমিয়ে হোয়াটসঅ্যাপ ও ইনস্টাগ্রামে বেশি সময় দিচ্ছে আগের বছরের তুলনায়। অবশ্য ফেসবুক ব্যবহার একেবারেই বাদ দেয়া ব্যবহারকারীর সংখ্যা খুব কম। সার্বিকভাবে এখনো এটি সংবাদ প্রাপ্তির জন্য ব্যবহৃত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম।