অনেক বছর আগে বিদ্রূপ ম্যাগাজিন উন্মাদ-এ বিভিন্ন পেশায় থাকা মানুষের আঙুলের ছবি এঁকে ক্যারিকেচার করা হয়েছিল। সেখানে ছিল একজনের হাতের একটা আঙুলের সামনের অংশ ক্ষয়ে গেছে। নিচে লেখা ছিল টেলিফোন অপারেটরের আঙুল। এ যুগে আমরা যেভাবে মোবাইল ফোন, ট্যাব, পিসি, ল্যাপটপ, টিভি রিমোট ইত্যাদিতে দুই হাতের ১০ আঙুল যেভাবে ব্যস্ত রাখছি, তাতে ভবিষ্যতে সত্যি সত্যি ক্ষয়ে যাওয়া ১০ আঙুল আর হাতের তালু দেখা গেলে বিস্মিত হওয়ার কিছু থাকবে না। তো হাতের আঙুলগুলোকে আমরা কেনো ব্যস্ত রাখছি? কারণ আমরা অসংখ্য ‘চাই-চাই’ নির্ভর এক সমাজে বসবাস করছি। এই চাওয়া মেটাতে আঙুলগুলো ব্যস্ত রাখার কোনো বিকল্প নেই!
আমরা উত্তেজনা চাই। গরম খবর চাই। ‘ভেতরের’ খবর চাই। ‘অবিশ্বাস্য-শ্বাসরুদ্ধকর’ কিছু জানতে চাই। কারণ আমরা মনে করি, প্রত্যেকের জীবনেই এমন কিছু গোপন-রগরগে ঘটনা আছে, যা আমরা জানতে পারছি না। ঢেকে রাখা হচ্ছে! কেউ যদি এমন কোনো নিষিদ্ধ উপাদানের সন্ধান দেয় তো, আমরা হামলে পড়ি। এর কারণ কী? কারণ হলো আমাদের জীবনটা বড় বেশি একঘেয়ে, পানসে। কি ব্যক্তি জীবনে, কী সামাজিক-রাজনৈতিক-রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে, একই রকম ঘটনা যুগের পর যুগ ধরে চলছে এবং ঘটছে। কোনো নতুনত্ব নেই। কোনো চমকও নেই। এ পরিস্থিতিতে আমরা চাই চমক, আনকোড়া, গোপন সব রহস্যের খবর। যদিও তেমন কিছু আমাদের সমাজে সব সময় ঘটে না। ঘটলেও সংবাদ আকারে তা আসে না।
তা ছাড়া আমরা তো জ্ঞানীও হতে চাই। আমাদের মধ্যে যে মধ্যবিত্ত অহমিকা-তাতো আসলে জ্ঞানেরই অহমিকা। আমি বেশি জানি, আমি সব জানি, আমি ওর চেয়ে এটা ভালো বুঝি-এই করেই তো চলছে আমাদের সমাজ-সংসার-রাজনীতি। একটা সময় পর্যন্ত অর্থাৎ প্রাক-পুঁজিবাদী যুগে ‘জ্ঞানী’ শুধু তাঁকেই বলা হতো যিনি ঈশ্বরকে জানেন। পুঁজিবাদী দুনিয়ায় জ্ঞানী তাঁকেই বলা হয়-যিনি লিখতে-পড়তে-ভাবতে-ভাবাতে পারেন। যিনি এই ভাবনা ব্যবহার করে টাকা বানাতে পারেন। আর এখন যিনি যত বেশি ‘তথ্য’ জানেন তিনি নিজেকে তত জ্ঞানী মনে করেন। এখন তো বলাই হয়, ইনফরমেশন ইজ নলেজ অ্যান্ড নলেজ ইজ পাওয়ার। আমরা তথ্য চাই, খবর চাই, নলেজ চাই পাওয়ার চাই। হয়তো আরও অনেক কিছু চাই (চাই যৌনতা, পারভারসানও)!
‘সব পেতে’, পাশাপাশি সব জানতে আমাদের চেষ্টার কোনো কমতি নেই। আর সেই সুযোগও এখন কাঙ্ক্ষিত প্রেয়সীর মত আমাদের হাতছানি দিয়ে ডাকছে! ইন্টারনেটের বদৌলতে হাতের মুঠোয় চলে এসেছে গোটা দুনিয়া। ইন্টারনেট ও যন্ত্রপ্রযুক্তি নির্ভর দুনিয়াকে বলা হচ্ছে ডিজিটাল জগৎ। অল্প কিছু টাকা ব্যয় করলেই হাতের মুঠোয় এসে যাচ্ছে জগৎ।
ইন্টারনেটের অধিকাংশ বিষয়ই তো প্রায় ‘বিনামূল্যে’। আপনার যদি একটি মোবাইল, ট্যাবলেট, ল্যাপটপ কিম্বা কম্পিউটার থাকে আর কোনো এক সেবাদায়ী প্রতিষ্ঠান থেকে মাসিক সেবামূল্য দিয়ে ইন্টারনেট সংযোগ নেন, তবে আপনাকে আর বাড়তি পয়সা খরচ না করে পাঠক, লেখক, সম্পাদক এমনকি প্রকাশক হতে বাধা দিচ্ছে কে? এখনতো আপনিই কেন্দ্র, ঢাকা, নিউইয়র্ক, প্যারিস বা লন্ডন নয়। পুরো দুনিয়াই আপনার পরিধি!
নতুন নতুন আবিষ্কারসহ দুনিয়াজুড়ে তথ্য-প্রযুক্তির উন্নতি ঘটছে। সঙ্গে সঙ্গে মানুষের ব্যক্তিগত ও সামাজিক যোগাযোগসহ ব্যবসায়িক ও বাজার অর্থনীতির বিচিত্র কার্যক্রম-ডিলিংস অনলাইন বা ইন্টারনেট মাধ্যমে ব্যাপকভাবে বেড়েছে। মোবাইল ফোন ও এর উন্নত নেটওয়ার্ক প্রযুক্তির ব্যাপক বিস্তারের ফলে ইন্টারনেটের ব্যবহারকে আরও বেশি গতিশীল ও সম্প্রসারিত করেছে। এতে করে অনলাইনে গড়ে উঠেছে মানুষের কাছে দ্রুত ও তাৎক্ষণিক সংবাদ পৌঁছে দেয়ার মাধ্যম। যাকে বর্তমানে অনলাইন সংবাদমাধ্যম বলা হয়।
বিশ্ব্যব্যাপী প্রভাবশালী বেশ কয়েকটি দৈনিক তাদের কাগজে ছাপা মাধ্যম থেকে সরে পুরোপুরি যুক্ত হয়েছে অনলাইন মাধ্যমে। আমাদের দেশে সবগুলো সংবাদপত্রই অনলাইন ভার্সান চালু করেছে। এমনকি, রেডিও-টিভিও অনলাইন ভার্সান চালু করেছে। যুগের চাহিদা ও বিবর্তনের পথ ধরে প্রিন্ট মিডিয়া এক সময় বিলুপ্ত হলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না!
ইউনিকোড বা অভ্র (এন্ড্রয়েডে রিদমিক) আমাদেরকে ডিজিটাল দুনিয়ায় মাতৃভাষা চর্চার সুযোগ করে দিয়েছে। আমরা কবি-সাহিত্যিক-লেখক হয়ে যাচ্ছি রাতারাতি, নাট্যকার হয়ে যাচ্ছি ঘণ্টা পেরোনোর আগেই। এখন আমরা মাতৃভাষাতেই আমাদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো ব্যবহার করতে পারি।
আমরা কবিতা লেখি, গান গাই, সাহিত্য রচনা করি, প্রেমিক/প্রেমিকাকে প্রেম নিবেদনও করি। শেষটা বাদে সব কিছুই বাংলায় চলে। আগের দিস্তা-দিস্তা কাগজ, খুচরো ডায়েরি, আর্ট পেপার আজ কিবোর্ডের দখলে। আমরা বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যুক্ত থাকছি–ফেইসবুক, টুইটার, ইন্সটাগ্রাম, হোয়াটসআপ, ভাইভার, ট্যাঙ্গ, মেজেঞ্জার, এডাল্ট সাইট আরও কত কী!
এ অবস্থায় সৃজনশীল বাঙালি জাতি তো আর হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকতে পারে না। থাকা উচিতও নয়। তো আমাদের মধ্যে অতি ‘সৃজনশীল’ কেউ কেউ হাজির আজব নিউজ উপাদানসমৃদ্ধ বিচিত্র সব ক্রিয়েটিভ নামের অনলাইন নিউজপোর্টাল বা অনলাইন নিউজপেপার নিয়ে। কিছু ‘অতি-উৎসাহী’ মানুষের চাহিদা বিবেচনায় নিয়ে আমাদের দেশে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছে অজস্র-অসংখ্য নিউজপোর্টাল। যেদিকে তাকান দেখবেন অনলাইন পত্রিকা। অনলাইন পত্রিকাগুলোর বেশির ভাগের পিছনে লাগানো থাকে ২৪।
‘যুগের দাবি’ পূরণ করতে এখন দেশে অনলাইন নিউজপোর্টাল বের করার ‘হুজুগ’ চলছে। দেশে আপাতত গণতন্ত্র, সুশাসন ইত্যাদির অভাব যতই প্রকট হোক না কেন, কাক, লেখক, নেতা, বক্তা, তেলাপোকা আর অনলাইন নিউজপোর্টালের কোনো অভাব নেই।
শুরুতে সবাই আমরা আশান্বিত হয়ে উঠেছিলাম। যাক অনলাইনে খবরগুলো অন্য সব মাধ্যমের চেয়ে দ্রুত পাওয়া যাবে। খবরের জন্য তীর্থের কাকের মত সকালের সংবাদপত্রের অপেক্ষায় প্রহর কাটাতে হবে না। যথন যেখানে যা কিছু ঘটবে, তখনই তা জানতে পারা যাবে। একেবারে গরম খবর। তাজা খবর। কাজের ফাঁকে, চলতি পথে, আড্ডায় কিংবা ভ্রমণে জেনে নেওয়া যাবে কোথায় কী ঘটেছে এবং ঘটছে।
কিন্তু হায়! তখন কে ভেবেছিল শষ্যের মাঠ আগাছায় ভরে যাবে! মানসন্মত অনলাইন পোর্টালের ভেতর ঢুকে পড়বে মানহীন, পুরো ‘রসময়’ ও ‘সৃজনশীল’ সব পোর্টাল। যাদের কাজ হলো হুমায়ূন আহমেদের হিমুর পোশাকের রঙ-‘হলুদ’ সাংবাদিকতাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরা। ভুয়া, বানোয়াট, আজগুবি সব খবর ছড়িয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করা! এই শ্রেণির পোর্টালগুলো মূলত যৌন সুড়সুড়ি মার্কা খবর আর ভুয়া খবর প্রকাশ করে পাঠকদের দৃষ্টিআকর্ষণ করে সস্তা জনপ্রিয়তা পাওয়ার জন্য। কারণ এরা জানে যৌনতানির্ভর খবর প্রকাশ করলে পাঠক হুমড়ি খেয়ে পড়বে, আর সাইটে পাঠকের ‘হিট’ বাড়বে। এজন্যই এই নিউজপোর্টালগুলো ধর্ষণ, বহুগামিতা, যৌনতা সম্পর্কিত খবরগুলো চটকদার শিরোনাম দিয়ে রসিয়ে রসিয়ে পরিবেশন করে। এসব পোর্টালে দেশের কোনো গুরুত্বপূর্ণ খবর পাওয়া যাবে না। সুড়সুড়ি মার্কা হেডলাইন, ততোধিক সুড়সুড়ি যুক্ত ছবি এবং ভাষ্যযুক্ত নিউজ হচ্ছে, সেগুলো থাকছে সর্বোচ্চ পঠিত তালিকার লিস্টে!
আর এমন কিছু অনলাইন পত্রিকা আছে, যে পত্রিকাগুলো বিভিন্ন অশ্লীল পোস্ট দিয়েই ভরপুর। ফেসবুক থেকে ওই পোস্টে ক্লিক করে ঢুকলে দেখা যায় হয়ত সেটি অন্য কোনো দেশের একটি তুচ্ছ ঘটনা (অনেক সময় বানানো ঘটনা), না হয় হেডলাইন আর ছবি ছাড়া আর কিছুই নেই, আবার এমনও দেখা যায় (ভিডিও) লিখা থাকলেও কোন ভিডিও নেই। এক কথায় পাঠকদেরকে ব্ল্যাকমেইল করার নানা কৌশল। এরা শুধু নায়ক-নায়িকা, নেতানেত্রী, খেলোয়াড়, ব্যবসায়ীসহ সেলিব্রেটিদের ‘গোপন’ খবরই প্রকাশ করে না, পারলে মহাপুরুষ-মনীষীদের যৌনজীবনের রগরগে কাহিনী পরিবেশন করে!
‘ব্রেকিং নিউজ’ ছাপতেও এদের জুড়ি নেই। তাক লাগানো কোনো ঘটনা না ঘটলেও এরা ‘ব্রেকিং নিউজ’ তৈরি করে। তিলকে কাঁঠাল বানিয়ে, ব্যাঙকে হাতি বানিয়ে তারপর এরা সেই হাতিকে কাঁঠাল খাইয়ে সঙ্গে একটা ‘যুবতী নারী’ জুড়ে দেয়। সরল বিশ্বাসে আমাদের হতভাগা ‘চমকপ্রিয়’ পাঠক সেই গরলকেই অমৃত ভেবে পান করে! নিজে গাঁড়ল বনে যাচ্ছে। এতে একদিকে যেমন তাদের পোর্টালের পাঠকপ্রিয়তা বাড়ে, টিআরপি বাড়ে, বাড়ে আয়-ইনকাম। একই সঙ্গে এ ধরনের অসত্য কিন্তু ‘উদ্ভাবনমূলক’ খবর প্রকাশের ফলে পাঠকদের ভেতরে দ্বিধা দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়। তর্কটা লাগে যারা সঠিক তথ্য জানে আর যারা ঐ ভুল তথ্য বিশ্বাস করে-তাদের ভেতর।
তবে যুগের চাহিদা অনুযায়ীই কিন্তু অনলাইন নিউজপোর্টালের জনপ্রিয়তা বাড়ছে। এ ধরনের পোর্টালে প্রতিনিয়ত আপডেট তথ্যপ্রাপ্তির যে সুযোগ রয়েছে, প্রিন্ট মিডিয়ায় তা নেই। প্রিন্ট মিডিয়ার সঙ্গে এর আরেকটি প্রধান পার্থক্য হচ্ছে, অনলাইনে পাঠক প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায় লেখাটি প্রকাশ হওয়ার পর পরই মন্তব্যের ঘরে। সেখানেও চলে তর্ক-বিতর্ক, প্রশংসা, এমনকি লেখার নিন্দাও। আবার একটি লেখার বিতর্ক থেকে জন্ম নেয় আরও অনেক চিন্তাশীল লেখাও।আমাদের দেশে মানসন্মত অনলাইন পোর্টাল যে নেই ব্যাপারটা এমন নয়।
কিছু আছে খুবই মানসম্মত। এরা সত্য ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশ করে। এর মধ্যে নিঃসন্দেহে চ্যানেল আই অনলাইনও রয়েছে। মাত্র এক বছরে এটি গুণে-মানে-পাঠকপ্রিয়তায় অন্যতম শীর্ষে পৌঁছাতে পেরেছে। এটা আনন্দের সংবাদ। পরিশেষে স্মরণ করি জীবনানন্দর প্রবাদপ্রতীম উক্তি: ‘সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি।’ ঠিক তেমনি সব অনলাইন নিউজপোর্টালই ‘নিউজপোর্টাল’ নয়, কিন্তু ‘চ্যানেল আই অনলাইন’ আসলেই একটি সমৃদ্ধ, মানসম্পন্ন অনলাইন পোর্টাল।
এজন্য একজন পাঠক হিসেবে সংশ্লিষ্টদের জানাই শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন। আরেকটি কথা, মানহীন ভুয়া অনলাইন পোর্টালগুলো যেন ‘রুচির বিকার চর্চা’র মাধ্যমে ‘অনলাইন দূষণ’ ঘটাতে না পারে-এ ব্যাপারে তথ্য মন্ত্রণালয় কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করবে বলেই আমাদের প্রত্যাশা।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)