সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে (স্বায়ত্বশাসিত/বেসরকারি) বিশৃঙ্খলা ও অস্থিরতার চিত্র দেখা যাচ্ছে। সরকার থেকে শুরু করে গ্রামের সাধারণ আমজনতা বিশ্ববিদ্যালয়ের খবর নিয়ে দ্বিধার মধ্যে রয়েছে। কেননা, সাধারণ মানুষের নিকট বিশ্ববিদ্যালয় একটি পবিত্র জায়গা যেখানে জ্ঞান সৃজন ও জ্ঞানের চর্চা হয়। স্বাভাবিকভাবে তারা মনে করেন, দেশ পরিচালনায় যারা বিভিন্ন সেক্টরে দায়িত্ব পালন করে থাকেন তাদের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থী। সেক্ষেত্রে তাদের নিকট আরো জ্ঞাত ধারণা, সেই সব বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা পাঠদান করে থাকেন অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা জ্ঞানে, শৌর্য, বিদ্যা ও বুদ্ধিতে অনন্য। কিন্তু সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নিয়ে খবরের কাগজে নেতিবাচক চিত্র দেখে তারা অত্যন্ত মর্মাহত, বেদনাগ্রস্থ। উল্লেখ্য, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য (ভিসি) বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্য থেকেই নিয়োগ দেওয়া হয়ে থাকে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একটি বিরাট অংশ বিশ্ববিদ্যালয় সংক্রান্ত নেতিবাচক খবরের শিরোনামে যারপরনাই বিরক্ত, লজ্জিত ও আতংকগ্রস্থ। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের বিভিন্ন ফোরামে সাধারণ শিক্ষকরা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে নানামুখী মুখরোচক খবরের কারণে পেশার গুরুত্ব, মর্যাদা ও ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্থ। এ কথা বলতে অস্বীকার করার কোনরূপ সুযোগ নেই যে, মান ও মর্যাদার মাপকাঠিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একটি আলাদা বিশেষত্ব রয়েছে। তবে যে ধরনের অরাজকতার চিত্র বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পর্যায়ক্রমে দেখা যাচ্ছে এ অবস্থা বজায় থাকলে মান-মর্যাদার বিশেষত্ব আর বজায় থাকবে না এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
প্রসঙ্গক্রমে এ কথাও বলা যায়, চলমান সংকটের সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ সমাধান ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক পরিবেশ বজায় রাখাও সম্ভব হবে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা ছাত্ররাই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা পেশার সাথে জড়িত হয়ে থাকেন, সুস্পষ্টভাবে বলা যায় বাংলাদেশের একাডেমিক শিক্ষা কার্যক্রমের সঙ্গে সঙ্গে গবেষণার সাথে সম্পৃক্ত হয়ে থাকেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশৃঙ্খলা পরিবেশ বজায় থাকলে মেধাবীরা কালের বিবর্তনে সময়ের প্রয়োজনে অন্যান্য পেশার দিকে ধাবিত হয়ে পড়লে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে লেখাপড়ার সামগ্রিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক ও সাবলীল হবে না। তখন কিন্তু দেশ একটি বিরাট সংকট ও সমস্যায় উপনীত হবে; কাজেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নিয়ে সরকার সহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে হবে যার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে তথা বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার মান আরো উন্নত ও আধুনিক হয়।
কিছুদিন পূর্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ ও পদোন্নতি নিয়ে অভিন্ন নীতিমালার বিরুদ্ধে প্রায় সবক’টি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মানববন্ধন ও প্রতিবাদলিপির কারণে অভিন্ন নীতিমালা প্রণয়নের পূর্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি ও ফেডারেশনের সঙ্গে আলোচনায় বসে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়। অভিন্ন নীতিমালা এখনো কার্যকর হয়নি তবে সেটা প্রক্রিয়াধীন।
ঐ সময়ে শিক্ষকদের পক্ষ থেকে যে দাবি উচ্চারিত হয়েছিল তার মধ্যে অন্যতম ও প্রধান হল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর নিয়োগের জন্য নীতিমালা প্রণয়ন করা প্রয়োজন। কারণ হিসেবে তারা বলেছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ব্যক্তি যেহেতু উপাচার্য, কাজেই উপাচার্য নিয়োগ যথাযথ হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য নিয়োগ, পদোন্নতি ও প্রশাসনিক কার্যক্রম স্বাভাবিক নিয়মেই হয়ে থাকবে বলেই সবাই বিশ্বাস করে। বাংলাদেশের যেহেতু চারটি বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও জাহাঙ্গীরনগর) ১৯৭৩ এর অধ্যাদেশে পরিচালিত হয়ে থাকে, সেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগের ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে সিনেটের উপর। সুতরাং সেসকল বিশ্ববিদ্যালয়ে যে কোন মূল্যে সিনেটকে কার্যকর করতে হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক পরিবেশকে স্বাভাবিক ও সুষ্ঠু রাখার নিমিত্তে।
অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগের ক্ষেত্রে একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন করা যেতে পারে। যার রূপরেখা হতে পারে এমন; প্রথমত: বিশ্ব র্যাংকিংয়ে-এ প্রথম ৫০/১০০ টি বিশ্ববিদ্যালয়ের যে কোন একটি থেকে পি.এইচ.ডি ডিগ্রী থাকতে হবে। দ্বিতীয়ত: নির্দিষ্ট সংখ্যক একাডেমিক বই থাকতে হবে। তৃতীয়ত: প্রসিদ্ধ জার্নাল হতে সুনির্দিষ্ট সংখ্যক আর্টিকেল প্রকাশিত হতে হবে। চতুর্থত: যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিকে একাডেমিক ও প্রশাসনিক উভয় কাজই করতে হয় সেহেতু প্রশাসনিক কাজে (হাউস টিউটর, সহকারী প্রক্টর, প্রক্টর, প্রভোস্ট, ডিন প্রভৃতি) অভিজ্ঞতা সম্পন্ন হতে হবে ভিসিকে। আপাত দৃষ্টিতে উল্লেখিত নীতিমালা অনুসরণ করে ভিসি নিয়োগ প্রদান করা হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক পরিবেশ বর্তমানের চেয়ে উন্নত ও আধুনিক হবে মর্মে আশাবাদ ব্যক্ত করা যায়। উল্লেখ্য: ৭৩ এর অধ্যাদেশ পরিচালিত যে সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে সিনেট কার্যকর নয় সেখানে এ নিয়ম চালু করা হলে পরিস্থিতি সকলের জন্যই আশাব্যঞ্জক হবে। ধর্তব্য নীতিমালার মধ্যে প্রার্থী নিরূপন করা সম্ভব না হলে প্রয়োজনে নীতিমালা সহজলভ্য করা যেতে পারে।
রাজনৈতিক বিবেচনায় যদিও ভিসি নিয়োগ দেওয়া হয় তথাপি যে সকল প্রফেসরগণ রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা দলটির সমর্থক হিসেবে পরিচিত তাদের মধ্যে যিনি সব থেকে ভাল একাডেমিশিয়ান তাদেরকে ভিসি হিসেবে নিয়োগ দিলে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ভাল হয়। এখনো যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি নিয়োগের নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়নি সেহেতু ক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক দলের সমর্থকদের মধ্যে যাদের নামকরা ও প্রসিদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চতর ডিগ্রী, একাডেমিক বই ও স্বনামধন্য জার্নাল থেকে প্রকাশিত আর্টিকেল রয়েছে তাদেরকে নিয়োগ দিয়ে সরকার বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিদের নিয়ে যে অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তা থেকে আশু সমাধান পেতে পারে। তবে যাদেরকেই ভিসি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে কিংবা হয়েছে তাদের প্রত্যেকেরই যথেষ্ট প্রজ্ঞা, মেধা ও একাডেমিক এক্সিলেন্সি রয়েছে কিন্তু তারপরেও সমালোচনা এড়ানোর স্বার্থে উপর্যুক্ত বিষয়গুলো বিবেচনায় নেওয়া যেতে পারে।
ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি ভিসি হিসেবে দায়িত্ব প্রদান অনেকাংশে পুরস্কার প্রদানের স্বরূপ। স্বাভাবিকভাবে একজন প্রফেসরের চাকুরি জীবনের শেষ মুহুর্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে মনোনয়ন দেওয়া হয়। তার মানে হল: আপনার সুদীর্ঘ অধ্যাপনা জীবনে আপনার অর্জিত একাডেমিক ও প্রশাসনিক জ্ঞানকে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে যথাযথভাবে কাজে লাগানোর সুযোগ করে দেয় রাষ্ট্র। আর সেই দায়িত্ব নেওয়ার পরে সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যাচ্ছে ভিসিগণ খেই হারিয়ে ফেলছে। ভিসিগণ কী জন্য দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় নানারকম নেতিবাচক খবরের শিরোনাম হয় তার কার্যকারণ অনুসন্ধান করা প্রয়োজন ব্যাপকভাবে। তবে সাধারণভাবে মোটাদাগে বেশ কিছু কারণকে সামনে নিয়ে আসা যেতে পারে। পত্রিকার খবরে জানা যায়, উপাচার্য পদ পেতে নানা জায়গায় নানা জনের তদবির লবিং এর প্রয়োজন হয়। এমনও দেখা যায়, উপাচার্য পদের দৌড়ে বেশ কয়েকজনের নাম শোনা গেলেও লবিং এর দৌড়ে যিনি এগিয়ে থাকেন তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়ে থাকে। কথাটুকু কতটুকু সত্য, সময়ই তা মূল্যায়ন করবে।
যদি সত্যই না হয় তাহলে কেন দেখা যায়; বিশেষ ব্যক্তিকে নিয়োগ প্রদানের জন্য ন্যূনতম যোগ্যতার চেয়েও শিথিল করে সার্কুলার প্রদান করে থাকে কর্তৃপক্ষ যাতে পছন্দের প্রার্থীকে সহজে মনোনয়ন দেওয়া যায়। আবার দেখা যায়, সার্কুলার জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশ করার নিয়ম থাকলেও স্থানীয় পত্রিকায় দায়সারাভাবে প্রকাশ করা হয়ে থাকে। এমনো দেখা যায়, সার্কুলার প্রদানের পরে একটি সুনির্দিষ্ট নিয়মের (সময়ক্ষেপন, নিয়োগবোর্ড) বিধান থাকলেও তড়িগড়ি করে নিয়োগ সম্পন্ন করা হয়। দেখা যায়, ঈদের বন্ধের আগের দিন তড়িগড়ি করে মাস্টার রোলে নিয়োগ দেওয়া হয় কিংবা সিন্ডিকেট করা হয় দুরভিসন্ধি চরিতার্থ করার স্বার্থে। উপাচার্যগণ এসকল গর্হিত কাজ কখনোই করতে পারেন না! কারণ, তারা বিজ্ঞ, দীর্ঘদিন ধরে সততার সঙ্গে শিক্ষকতা ও গবেষণা করে আসছেন। কিন্তু উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই যাদের সহযোগিতা নিয়ে উপাচার্য হন তাদের তদবির রক্ষা করতে গিয়ে এ রকম জঘন্য কাজ করে বসেন অবলীলায়। কাজেই, উপাচার্য নিয়োগে যদি একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন করা যায় যার ভিত্তিতে উপাচার্য নিয়োগ করা হবে তাহলে উপাচার্য পদ নিয়ে শিক্ষকদের মধ্যকার অভ্যন্তরীন দ্বন্দ্ব ও বিদ্বেষের অবসান ঘটবে।
অন্যদিকে দেখা যায়, প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক রাজনীতির কারণে যে কোন উপাচার্য দায়িত্ব নেওয়ার পর পর উপাচার্য গ্রুপ ও উপাচার্য বিরোধী গ্রুপের আবির্ভাব ঘটে যায়। বিষয়টা প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক অগ্রগতির জন্য বাধাস্বরূপ। বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য, সাধারণ শিক্ষক, বিভিন্ন পর্ষদের দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা, কর্মচারী সকলের। প্রত্যেকের যথাযথ দায়িত্ব পালনই বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক কার্যক্রমকে বেগবান করতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ের যে কোন ইতিবাচক কাজের ফলাফল যেমন আমার উপর বর্তায়, ঠিক তেমনিভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের যে কোন নেতিবাচক কাজের ফলাফলও আমার উপর বর্তায়- এমন ব্রত নিয়ে একটি পরিবার হিসেবে সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় যে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের অগ্রযাত্রাকে নির্দেশ করে থাকে। আশা করবো, উপাচার্যগণ তাদের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা ও সক্ষমতা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক মঙ্গলার্থে কাজ করে যাবেন দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে উন্নত ও আধুনিক করার স্বার্থে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)