ডাকসু ভিপি নূর সাধারণ ছাত্রদের ভোটে নির্বাচিত হয়ে কি সাধারণ ছাত্রদের বিরুদ্ধে যাচ্ছেন? যে ছাত্রলীগ তাকে শিবির বলে সমালোচনা করল শিবিরের ভিপি মানতে পারবেনা বলল সেই নূর এখন নিজেকে ছাত্রলীগের নেতা দাবি করছে৷ ভিপি নূর এখন টক অব দি কান্ট্রি৷ তিনি ছাত্রলীগ বেষ্টিত থেকে এক ধরনের কথা বলেন৷ ছাত্রদল বেষ্টিত থেকে আরেক ধরনের কথা বলেন৷ বামজোট ও সাধারণ ছাত্রবেষ্টিত থেকে বলেন আরেক কথা। ছাত্রলীগ বেষ্টিত থেকে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে মা সম্বোধন করেন৷ পায়ে মাথা ঠেকিয়ে সালাম করেন৷ ছাত্রলীগ নেতাদের অনুকরণে আবার আপাও ডাকেন। ছাত্রদল পরিবেষ্টিত থেকে আবার তারেক রহমানকে ভাইয়া সম্বোধন করেন। তিনি ভিপি পদেও থাকতে চান আবার ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ডাকসুর পুনর্নির্বাচনের আন্দোলনের সঙ্গেই আছেন তিনি। দায়িত্ব গ্রহণের বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে নুর বলেন, ‘ডাকসুর ভিপির দায়িত্ব গ্রহণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিনি এখনো। সাধারণ শিক্ষার্থী ও নির্বাচন বর্জন করা প্যানেলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে ভিপির দায়িত্ব গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেননি তো ভিপি হিসাবে প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করতে গেলেন কেন?
এদিকে ডাকসু নির্বাচন বাতিলের দাবিতে সংবাদ সম্মেলন করেছে প্রগতিশীল ছাত্র ঐক্য। এ ঐক্যের ভিপি পদে নির্বাচন করা লিটন নন্দী বলেন, গণভবনে গিয়ে ডাকসুর নবনির্বাচিত সহসভাপতি নুরুল হক যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা ধোঁয়াশাপূর্ণ। এটি পুনর্নির্বাচনের যে আন্দোলন চলছে, সেটির জন্য ক্ষতিকর। শনিবার গণভবনে গিয়ে নুরুল হক বলেছিলেন, প্রধানমন্ত্রীর চেহারায় তিনি তার মায়ের প্রতিচ্ছবি খুঁজে পান।
প্রগতিশীল ছাত্র ঐক্যের পর পরই পাঁচ প্যানেলের ব্যানারেও পুন নির্বাচনের দাবীতে সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ভোট বর্জন করা স্বতন্ত্র জোট, স্বাধিকার স্বতন্ত্র পরিষদ, প্রগতিশীল ছাত্র ঐক্য, ছাত্র ফেডারেশন, ছাত্র মৈত্রী, সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের প্রতিনিধিরা এতে উপস্থিত ছিলেন। সেখানে দেওয়া বক্তব্যে স্বতন্ত্র জোটের ভিপি পদে নির্বাচন করা অরণী সেমন্তী খানও ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করে উপাচার্যের কার্যালয়ের সামনে অবস্থান কর্মসূচির পক্ষে মত দেন। সেই সাথে ডাকসু বাতিল, ভিসির অপসারণ, হামলাকারীদের বহিষ্কার, মামলা প্রত্যাহারসহ চার দফা দাবি তুলে ধরেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমন্ত্রণে গিয়ে অনেক কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারেননি বলে দাবি করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) নবনির্বাচিত ভিপি নুরুল হক নুর । এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘গণভবনে অনেক কথা বলতে পারিনি। বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের দেখে আমার মনোযোগ নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ব্যক্তি। তার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ থেকে আমি গণভবনে গিয়েছি।’
উল্লেখ্য ডাকসু ও হল ছাত্র সংসদের নবনির্বাচিত নেতাদের সৌজন্য সাক্ষাতে গণভবনে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। আমন্ত্রণে তখন ডাকসু ভিপি হিসাবে পরে কাজ করার জন্য সহযোগিতাও চান প্রধানমন্ত্রীর কাছে।
সংগঠনের নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলেই প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে গণভবনে গিয়েছিলেন দাবি করে নুর বলেন, ‘আমার বক্তব্য নিয়ে বিভ্রান্তির কোনো কারণ নেই। শিক্ষার্থীদের সবার দাবির সঙ্গে একমত পোষণ করে সকল পদে পুনর্নির্বাচন চাইছি।’ তার এই কথা সত্য হলে তিনি কেন ভিপি পদ প্রত্যাখ্যান করলেন না? ভিপি পদ রেখে অন্যপদ গুলোতে পুনর্নির্বাচন দাবী কি সালিশ মানি তালগাছটা আমার বক্তব্যের মত হলো না?
ছাত্রদলের সঙ্গে একান্ত বৈঠকে ছাত্রদলের ভিপি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী মোস্তাফিজুর রহমান ভিপি নুরকে লন্ডনে পলাতক তারেক জিয়ার সঙ্গে ফোনে কথা বলিয়ে দেন। তারেক জিয়া তখন তাকে বলেন, তিনি যদি ডাকসু নেতৃত্ব গ্রহণ করেন তাহলে তার রাজনৈতিক জীবন শেষ হয়ে যাবে। শিক্ষার্থীরা তাকে বেঈমান বলবে। এসময় তিনি বলেন, ভাইয়া, আমি যেটাই করি না কেন আপনাদের মত এবং পরামর্শ নিয়ে করবো। আপনারা না চাইলে আমি কখনই শপথ নেবো না। লিটন নন্দীর নেতৃত্বে বাম সংগঠনগুলোর বৈঠকে নুর উপস্থিত হয়ে তাদের দাবির সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেন। এরপর তিনি সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ডাকসু নির্বাচনে ভোট কারচুপি হয়েছে। নির্বাচন পক্ষপাতপূর্ণ হয়েছে। অনুরূপ বক্তব্য দিয়ে কবি সুফিয়া কামাল হল সংসদের নির্বাচিত সদস্য লামইয়া তানজিন তানহা যদি পদের লোভ প্রত্যাখ্যান করতে পারেন নুর কেন তা পারছেন না?
কুয়েত মৈত্রী হল সংসদের নির্বাচিত সদস্য ফারজানা আক্তার মিমও পুনঃ নির্বাচনের দাবীতে প্রধানমন্ত্রীর সাথে গণভবনে সাক্ষাত কর্মসূচি বর্জন করেছেন। কোটা সংস্কার আন্দোলন, প্রগতিশীল ছাত্রজোটসহ নির্বাচন বর্জনকারী সকল পক্ষই চাইছে, নুর ও সমাজসেবা সম্পাদক আখতার যেন শেষ পর্যন্ত শপথ গ্রহণ না করে। অথচ তিনি গণভবনে গিয়ে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি শপথ গ্রহণ করছেন। উপাচার্যের সঙ্গে সাক্ষাতেও বলেন, শপথের দিন তারিখ অনুযায়ী তিনি শপথ গ্রহণ করবেন। তার শপথকে সাধারণ ছাত্র অধিকার পরিষদ মানবে কি? নাকি কোটা সংস্কার আন্দোলন ও ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠন বিরোধী সেন্টিমেন্টকে কাজে লাগিয়ে ভিপি হয়ে নুর ছাত্রলীগে যোগ দিচ্ছেন অথবা ছাত্রলীগ নিয়ন্ত্রিত ভিপি হচ্ছেন?
২৮ বছর আগে ডাকসু নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় পাওয়া ছাত্রদল এবারের নির্বাচনে কোন প্রতিদ্বন্দ্বিতাই করতে পারলনা। ভোট পাওয়ার হারও ছিলো একেবারেই নগণ্য।
কেন এমন হল? সরকার বিরোধী সেন্টিমেন্ট ছাত্রদলের দিকে না গিয়ে কেন সাধারণ ছাত্র পরিষদের দিকে চলে গেল? এটা কি ছাত্রদলেরও ব্যর্থতা নয়? কেউ বলছে ভিপি নূরকে কারচুপি করেও হারানো যায়নি৷ কেউ বলছে উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে নাটক করার জন্য তাকে জেতানো হয়েছে। ছাত্রলীগ সভাপতি শোভনকে বলি দিয়ে জিএসসহ অন্য পদগুলোতে জায়েজ করার কৌশল হিসাবে এমনটি করা হয়েছে। ব্যাপারটা কি সত্যিই তাই? ভিপি নূরও বলছে, সুষ্ঠু নির্বাচন হলে ছাত্রলীগ একটি পদও পাবে না৷ তাহলে কি যারা জিতেছেন তারা কারচুপি করে জিতেছেন? একইরকম বক্তব্য বাম দলগুলোও দিচ্ছে। তবে এই বিষয়টিও অনেকে মানছেন যে, নির্বাচন সুষ্ঠু হলে হয়তো অরাজনৈতিক প্রার্থীরাই আরো বেশি সফল হতেন। ডাকসুর ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, নির্বাচনে ছাত্রলীগের তুলনায় অন্য রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনগুলোর যেমন ভরাডুবি ঘটেছে, তেমনি এর বিপরীতে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে উত্থান ঘটেছে কোটা বিরোধী আন্দোলন করে আলোচনায় আসা অরাজনৈতিক ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের। কেন্দ্রীয় সংসদে ভিপিসহ দুটি পদে জয়লাভও করলো তারা।
১৮টি হল সংসদের মধ্যে ৬টিতে শীর্ষ ভিপি পদে জিতেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। এর মধ্যে দুটি হলে পূর্ণ প্যানেলে জয়লাভের ঘটনাও আছে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের। এতে কি এটাই প্রমাণ হয়না যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রচলিত ধারার রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনগুলোর গ্রহণযোগ্যতা কমতে শুরু করলো? আর যদি সেটাই হয়, তাহলে এর কারণ কী? জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনেও মানুষ ভোটবিমুখ হয়ে উঠল। হারিয়ে যাচ্ছে ভোটদানের আগ্রহ। তবে কি ডাকসুর মত এসবেও অরাজনৈতিক প্রার্থী চাচ্ছে তারা? দলীয় প্রার্থীর বিপরীতে স্বতন্ত্র প্রার্থীর প্রতি আগ্রহে কি এমনটিই প্রমাণ হয়না?
২০১৩ সালে দেখেছি অরাজনৈতিক মঞ্চ গণজাগরণ মঞ্চকে দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়তে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার জাগরণে গণজাগরণ মঞ্চ যে ভূমিকা রাখল তা কি কোন রাজনৈতিক সংগঠন পারলো? অতঃপর নিজেদের বিভক্তিতে আন্দোলনটি নষ্ট হয়ে গেল। কোটা সংস্কার আন্দোলনও কি এমন পরিণতির দিকে যাচ্ছে? ভিপি নুর কি তখন ছাত্রলীগে যোগ দেবেন? নাকি ছাত্রলীগ নিয়ন্ত্রিত ভিপি পদ নিয়ে তিনি কোটা সংস্কার আন্দোলনের বিপক্ষে চলে যাচ্ছেন? জাতীয় নির্বাচনে জাতি প্রত্যক্ষ করল সুলতান রঙ্গ। সরকার বিরোধী বক্তব্য ও প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে জিতে অতঃপর তিনি দল ত্যাগ করলেন৷ এবার শুরু হল নূর রঙ্গ। মানুষের এমন রঙ্গ দেখাটা কি ধারাবাহিক সিরিজ হয়ে উঠছেনা?
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)