নভেরা আহমেদ। সময়ের চেয়ে এগিয়ে চলা এক ভাস্করের নাম। ১৯৪৭ সালের দেশ ভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানের নারী-পুরুষ নির্বিশেষে প্রথম আধুনিক ভাস্কর ছিলেন তিনি। পাকিস্তানের ভূত যখন বাঙালির উপর, সেই পঞ্চাশ ষাটের দশকেও সমাজের রক্ষণশীলতাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নিজের খেয়ালে চলেছেন। স্পর্ধা নিয়ে। যার নাম জড়িয়ে আছে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের নকশা প্রনেতা হিসেবে। সেই নভেরার ব্যক্তি জীবন ও তার শিল্পকর্ম নিয়ে একটি বই লিখেছেন কবি ও প্রাবন্ধিক সাখাওয়াত টিপু।
বইটির নাম ‘নভেরার রূপ’। অমর একুশে গ্রন্থমেলায় ১০ ফেব্রুয়ারি থেকে বইটি পাওয়া যাচ্ছে আদর্শ প্রকাশনার ৫৪৫, ৫৪৬, ৫৪৭ নম্বর স্টলে। নভেরার শিল্পকর্ম অবলম্বনে বইটির প্রচ্ছদ করেছেন শিল্পী এস এম সাইফুল ইসলাম।
ভাস্কর নভেরাকে নিয়ে লেখা বইটিতে লেখক সাখাওয়াত টিপু কোন রূপ উন্মোচন করেছেন নভেরার? জানতে চাইলে চ্যানেল আই অনলাইনকে তিনি বলেন, নভেরাকে নিয়ে তিনটি জিনিষ আমি উন্মোচনের চেষ্টা করেছি আমার লেখায়। নভেরা আমাদের প্রথম জেনারেশনের ভাস্কর। পূর্ববঙ্গ তথা বাংলাদেশে ভাস্কর্য শিল্পের বিকাশ কিন্তু তার হাত ধরেই। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন যেরকম চিত্রকর্মে বাংলাদেশের অগ্রপথিক, নভেরা তেমনি ভাস্কর্য শিল্পে।
‘নভেরার রূপ’ এ যে তিনটি জিনিষ উন্মোচন করার চেষ্টা করেছেন লেখক সেটা জানিয়ে তিনি বলেন, একজন শিল্পী কীভাবে তার আত্মপরিচয়টা নির্মাণ করেন শিল্পের মধ্য দিয়ে সেটা আছে এই বইয়ে। এই আত্মপরিচয়ের একটা আইডেন্টিটিক্যাল পলিটিকস আছে। শিল্পের সঙ্গে মানুষের বেড়ে উঠার যে সামাজিকতার সম্পর্ক, শিল্পীর যে আকাঙ্ক্ষা সেটার সঙ্গে সমাজের যে পরিবর্তন এবং শিল্পীরতো শিল্পী হয়ে উঠতে হয়। নভেরার শিল্পী হয়ে উঠার রাজনৈতিক পরিচয়টা কীভাবে নির্মাণ হয়েছে সেটা এই বইয়ে পাওয়া যাবে।
দ্বিতীয়ত, নভেরার ব্যক্তিগত জীবন ও শিল্পের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ পাওয়া যাবে ‘নভেরার রূপ’ এ। এটা এই বইয়ে তুলে ধরতে খুব বেগ পেতে হয়েছে। কারণ নভেরাকে নিয়ে তথ্য উপাত্ত খুঁজতে গিয়ে দেখি সেটা যথেষ্ট নয়। নভেরাকে নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে যে গোছানো তথ্য উপাত্ত, ইতিহাস থাকা দরকার সেটা নেই। এগুলোর সংকট আছে আমাদের। ফলে নভেরা সম্পর্কে যতটুকু আমার সাধ্যের মধ্যে ছিলো সেগুলো ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে নভেরার জীবন ও শিল্পের একটা তূলনামূলক সমালোচনা তুলে ধরেছি। শিল্পে নভেরার বিকাশ কীভাবে ঘটেছে, তার উপর কার কার প্রভাব আবার নভেরা শিল্পের কোন জায়গায় শক্তিমান ছিলো সেগুলো দেখানোর চেষ্টা করেছি।
তৃতীয়ত, আমাদের যে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার আছে এটাতে কিন্তু নভেরারও একটা ভূমিকা ছিলো। প্রখ্যাত শিল্পী হামিদুর রহমানের বান্ধবী ছিলেন নভেরা। তারা দুজন মিলেই শহীদ মিনার করেন। কিন্তু আমাদের যে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা দেয়া হয় সেখান থেকে আমরা জেনে আসছি, শহীদ মিনারের নকশা করেছেন হামিদুর রহমান। শহীদ মিনারের প্রথম নকশা কে করেছিলেন, এটা নিয়ে একটা বিতর্ক আছে আমাদের সমাজে। সেই বিতর্কের জায়গাটা আমি একটু অনুসন্ধান করে দেখিয়েছি যে নভেরার ভূমিকা কী ছিলো! পরে কীভাবে এটা নিয়ে বিতর্কটা শুরু হলো। আমি দেখাতে চেয়েছি একক হামিদুর রহমান কিন্তু শহীদ মিনার করেননি। তিনি ছিলেন একজন পেইন্টার, ম্যুরালেরও কাজ জানতেন। কিন্তু ভাস্কর্যশিল্পী ছিলেন না। ভাস্কর ছিলেন নভেরা।
বাংলাদেশের শিল্পচর্চার ইতিহাসে নভেরা আহমেদের মতো আলোচনা আর কাউকে নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে হয়নি। জীবনের অনেকটা সময় লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকা এই ভাস্করকে নিয়ে আগ্রহের কমতি নেই পাঠকেরও। তার শিল্পকর্ম থেকে শুরু করে ব্যক্তিজীবন সমান কৌতূহলোদ্দীপক। তাকে নিয়ে নির্মিত হয়েছে মঞ্চ নাটকও।
১৯৩৯ সালের ২৯ মার্চ জন্ম নেয়া এই অগ্রগণ্য ভাস্কর মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্তু দীর্ঘ পয়তাল্লিশ বছর ধরে ফ্রান্সের প্যারিসে বসবাস করেন। ২০১৫ সালের ৬ মে মৃত্যু বরণ করেন তিনি। তারআগে ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে একুশে পদক প্রদান করে।