রোহিঙ্গাদের নিয়ে বাংলাদেশের সংকট যেন কাটছেই না। মিয়ানমারের খামখেয়ালিতে দীর্ঘ হচ্ছে বিশ্বের অন্যতম এই মানবিক সংকট। বর্মী শাসক ও দেশটির বাহিনীর অমানবিকতার কাছে অদৃশ্য কারণে বলতে গেলে অসহায় বিশ্বের বাঘা বাঘা দেশগুলোও। নাকি ইচ্ছা করেই কথিত বিশ্বনেতারা এ সংকট দীর্ঘায়িত করছেন, ইতোমধ্যে সেই প্রশ্নও উঠতে শুরু করেছে।
মিয়ানমারের একঘেঁয়েমির পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় ডিসেম্বর মাসের প্রথম দিকে কক্সবাজারের উখিয়া থেকে ১৬৪২ জন রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। চট্টগ্রাম থেকে নৌবাহিনীর ৭টি জাহাজে করে ৩৯০ পরিবারের ১৬৪২ জন রোহিঙ্গাকে নিয়ে যাওয়া হয় ভাসানচরে। এছাড়া ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যেই কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে রোহিঙ্গাদের দ্বিতীয় একটি দলকে ভাসানচরে স্থানান্তর করা হচ্ছে।
কক্সবাজারের পরিবেশ রক্ষা এবং সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় আপাতদৃষ্টিতে রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তরের কথা বলা হলেও দীর্ঘমেয়াদে এর নেতিবাচক প্রভাব কী? মিয়ানমার এতে কতোটা স্বস্তিতে রয়েছে? এটা কি সংশ্লিষ্টরা বিবেচনায় নিয়েছেন? এসব প্রশ্ন উত্থাপন ব্যতীত কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেননি বলেই মনে হয়। তাহলে এমন প্রশ্ন সামনে আসার পরও তারা কেন এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন? রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে থাকার ব্যবস্থা করায় বর্মী শাসকরা তো তাদের রাখাইনে নিতে গড়িমসি করবেন। এর ফলে ভাসানচর সিদ্ধান্ত আমাদের জন্য আত্মঘাতী হয়ে গেল না?
বাংলাদেশের সচেতন নাগরিকরা শুরু থেকেই রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের বিরুদ্ধে সরকারকে কঠোর হতে বলেছিল। কিন্তু সীমান্ত অরক্ষিত থাকায় এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মানবিক আহ্বানে সাড়া দিয়ে বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছে। যুগের পর যুগ মিয়ানমার রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশে কলকাঠি নাড়লেও বাংলাদেশ কেন সীমান্ত সুরক্ষিত করলো না? এর দায় কার? অন্যদিকে আন্তর্জাতিক গোষ্ঠী বাংলাদেশকে মানবিক হতে বললেও মিয়ানমারকে কেন বলতে পারছে না? এছাড়া চীন-ভারতসহ প্রতিবেশি দেশগুলোর নীরবতাও আশ্চর্যের বিষয়। অথচ তারাই আবার বাংলাদেশকে বন্ধুরাষ্ট্র হিসেবে দাবি করে!
রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান না হলে বাংলাদেশই যে ক্ষতিগ্রস্থ হবে তা নয়। ‘শোয়া অবস্থায় উপর দিকে থুতু নিক্ষেপ করলে তা নিজের বুকেই এসে পড়ে’ প্রবাদটি সহজে বুঝতে পারছে না আমাদের প্রতিবেশিরা। হয়তো তারা ভাবছে রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশ ব্যাকফুটে থাকলেও নিজেরা নিরাপদ। আসলে তা নয়। রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের ছোবল থেকে তারাও রেহাই পাবে না। সেখানে এসব অপকর্ম ছড়িয়ে পড়ার যে শঙ্কা শুরু থেকেই ছিল, তা এখন হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া যাচ্ছে।
এমনই কিছু ঘটনার বিবরণ গণমাধ্যমে এসেছে। এরমধ্যে সম্প্রতি রোহিঙ্গারা শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার কার্যালয়ে নিয়োজিত স্বেচ্ছাসেবককে (সিপিপি) অপহরণ করার মতো ধৃষ্টতা দেখিয়েছে। চ্যানেল আই অনলাইনের প্রতিবেদনে জানা যায়, কক্সবাজারের উখিয়ার শফিউল্লাহ কাটা শরণার্থী ক্যাম্প থেকে ‘মুক্তিপণের দাবিতে’ শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার কার্যালয়ে নিয়োজিত স্বেচ্ছাসেবককে (সিপিপি) অপহরণ করেছিল রোহিঙ্গারা। পরে উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়নের শফিউল্লাহ কাটা ১৬ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ডি-৪ ব্লকে এ অভিযান চালিয়ে তাকে উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় জড়িত অভিযোগে এক রোহিঙ্গা কমিউনিটি নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
এমন আরও অনেক ঘটনা রয়েছে। গণমাধ্যমে প্রায়ই এসব খবর প্রকাশ হচ্ছে। এরপরও প্রতিবেশি দেশ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বোধদয় হচ্ছে না! এই সন্ত্রাসী কার্যকলাপ যে শুধু বাংলাদেশে সীমাবদ্ধ থাকবে তা নয়। বরং এর বিস্তৃতি ভারত-চীন হয়ে দক্ষিণ এশিয়া এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ছড়ানোর শঙ্কা রয়েছে। এছাড়া আন্তর্জাতিক জঙ্গিবাদী সংগঠনগুলোও বসে নেই। রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করতে তারাও সচেষ্ট বলে সংবাদমাধ্যমে অনেকবার খবর বেরিয়েছে। এরপরও এ সংকট দীর্ঘায়িত করা বিশ্বনেতাদের জন্য আত্মঘাতী।
রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে নেওয়ার প্রতিবাদে সেখানে কথিত আন্দোলন-বিক্ষোভ হচ্ছে। বিদেশি বিভিন্ন সংস্থাও এর বিরোধিতা করছে। এসব অবশ্য মিয়ানমারে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের দাবিতে নয়। সেখানে নেওয়ার বিষয়ে বিরোধিতা করতে পারলেও নিজ ভূমিতে ফিরে যাওয়ার জন্য আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য তো তারা তেমন কোনো কর্মসূচি দিতে পারলো না! বিদেশি সংস্থাগুলোর বিরোধিতাও যৌক্তিক কারণে নয়। বরং কক্সবাজারে যে পাঁচতারকা হোটেলে হানিমুন বা ট্যুর মুডে থাকা যায়, ভাসানচরে সেটা না পাওয়ার শঙ্কায় তারা এমনটা করছেন। পৃথিবীর কোথাও শরণার্থীদের ইচ্ছামাফিক কোনো কিছু চলে না, চলতে পারে না; এটা তাদের মাথায় রাখা দরকার। এখানে তারা যদি মানবিকতার পরিচয় দিতেন, তাহলে মিয়ানমারের দুর্বৃত্তায়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে চাপ সৃষ্টি করতেন। সেটা তারা তেমন একটা করেননি। সুতরাং রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে কোথায় থাকবে, কোথায় রাখা হবে; সেই ইস্যুতে কথা বলার নৈতিক অধিকার তাদের নেই। অবশ্য প্রত্যাবাসনের বিষয়ে কথা বলার সুযোগ এবং সময় এখনও তাদের রয়েছে।
তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সম্প্রতি ঢাকায় এসে জাতিসংঘকে পাশে নিয়ে রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তরের পরামর্শ দিয়েছেন। এসময় তিনি অন্য অনেক দেশের মতোই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে ঢাকার পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছেন। তবুও বলতে হয়, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে আমরা ইতোমধ্যে জাতিসংঘের নজিরবিহীন অক্ষমতা দেখেছি। এ সংস্থাটি আন্তরিক থাকলেও নানা কারণে প্রত্যাশিত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেনি। এমনকি যুক্তরাষ্ট্র রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের পক্ষে অবস্থান নেওয়ার পরও তারা জোরালো ভূমিকা রাখতে পারেনি, অথবা রাখেনি। কিন্তু শুরু থেকেই মানবিক দিক দেখার কথা বলে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে বাংলাদেশকে অনুরোধ করে আসছিল জাতিসংঘ। সেই সংস্থা যখন আশানুরূপ ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ, তাহলে তাদেরকে সাথে নিয়ে বাংলাদেশকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে কেন? এ আহ্বানের কোনো যৌক্তিকতা নেই। তুরস্কের বরং জাতিসংঘকে আহ্বান জানানো উচিত সংস্থাটি যেন মিয়ানমারের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বন্ধে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে যেন কার্যকর ভূমিকা রাখে।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে মিয়ানমার যেহেতু নানা ছলচাতুরীর আশ্রয় নিচ্ছে, তাই বাংলাদেশকে সতর্কতা ও বুদ্ধিমত্তার সাথে পথ চলতে হবে। কূটনৈতিক পদক্ষেপ বাড়িয়ে সফল হওয়ার পাশাপাশি সিদ্ধান্ত গ্রহণেও বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিতে হবে। ভাসানচরে স্থানান্তর করা হলে রোহিঙ্গা সংকট আরও দীর্ঘায়িত হবে কিনা, নোয়াখালীর স্থানীয় জনগোষ্ঠী ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তরে সন্তুষ্ট কিনা তা নতুন করে ভেবে দেখতে হবে। ভাসানচরের বদলে রোহিঙ্গাদের নিজ ভূমি মিয়ানমারে তাদের প্রত্যাবাসনের দিকে নজর দেওয়া জরুরি। যেকোন মূল্যে মিয়ানমারকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাধ্য করতেই হবে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)