আমরা অানন্দের জন্যে খাই, সুস্বাদু সব খাবারগুলি চেটেপুটে খেয়ে চলার জন্য বেচেঁ থাকি। ভাত-ভেজা হাতখানি ঘন দুধে কড়া লিকারের চায়ের ধোঁয়ায় শুকোতে ভালোবাসি। বেহেশতে অামি ইলিশের ডিম নিয়ে যেতে পারব; এ কথাটা ভাবতেও ভালো লাগে। পেটের ভেতর দিয়ে হৃদয়ের দরজা খোলার পথটা বাঙ্গালির মতো অার কেউ চেনে না। খাই পরিমাণে কম তবু, বাসনা-রসনায় সিক্ত জীবন। অামার বিশ্বাস বিশ্বের প্রত্যেকটি সৃষ্টিশীল মানুষ রসনা বিলাসী, উপভোগ করে খেতে ভালবাসেন। রবীন্দ্রনাথ বাসতেন, নজরুল, সুকান্ত থেকে শেক্সপিয়ার; সবাই খাদ্য রসিক ছিলেন। গুনীজনদের এই বিলাসটা রপ্ত করবার চেষ্টা করি না, বংশগত। অাব্বাও খেতেন পরিমাণে কম, কিন্তু খেতে ভালবাসতেন অাম্মার হাতের সব রান্না।
এবং অতি অবশ্যই অামিও সে অানন্দকে সঙ্গী করে তোমার চোখের তারায় রীতিমতো ‘ইস্কুল করি’।
লোকে বাঁচার জন্য খায়, জানি। অামি টক ঝাল গরুর গোশতের তরকারি খেয়ে ঘেমে-নেয়ে একাকার হতে ভালোবাসি। লোকে বেঁচে থাকার প্রয়োজনে খায় জানি, অামি খেয়ে চলার প্রয়োজনে বেঁচে থাকি।
কিছু লোকে ছাপাছাপির জন্য লেখেন, অার অামি অানন্দের জন্য লিখি। অামার অাসলে রাজনৈতিক অসঙ্গতি নিয়ে বেদনা অার ক্ষোভের কথাগুলি লিখতে খারাপ লাগে না। বিশেষত অনেকে যখন সেটি এড়িয়ে যেতে স্বাচ্ছ্যন্দ খোঁজেন নানা কারণে।
ভালো একটি রিপোর্ট করার নেশাটাও ছাড়তেও পারি না। শেষাবধি, অামি অানন্দের জন্যই লিখি। কিছু অসাধারণ ব্রেকিং অার চমকের খোঁজ বার করা রিপোর্ট লেখার ক্ষুধাটা ফুরোয়নি বলে, এই বেঁচে থাকা। কিছু অসাধারণ যৌক্তিক যুদ্ধি অার শানিত দ্যুতির শব্দের গদ্যের মেলবন্ধন লিখার পথ চেয়ে দিনগুলি উদযাপন। উদযাপন মানে এ কারণে যে, অামি জীবনকে খুব কম সময় যাপন করি। বেশিরভাগ সময় করি স্বাচ্ছ্যন্দের সাথে সাথে উদযাপন। জাগতিক সব দুঃখবোধকে বুক পকেটে রেখেও চলবার শক্তিটা জীবনই অামাকে দিয়েছে।
বিশ্বাস করি ঐ লেখাটা অামার চেয়ে দরদ দিয়ে লেখার মতো এখনো কেউ জন্মায়নি। লেখালেখি ছাড়া অানন্দের সাথে নেশা অার প্রার্থনার মতো করে অার কিছু করা শিখতে পারিনি। তাই শেষ পর্যন্ত অামাকে অগত্যা লেখালেখিকেই ভালবাসতে হয়। বিকল্প কোন পথ খোলা থাকে না গন্তব্যের অথবা ভালোবাসা দেবার।
কারণ, নদী অামাকে নেবে না, সমুদ্রে মুক্তা খুঁজতে অামি যাব না। বৃষ্টি; তুমি কি অামাকে নেবে?
অামি অাসলে বৃষ্টি, কলম অার খাবারে অানন্দ খুঁজতে ভালবাসি। বেশিরভাগ মানুষ প্রতিষ্ঠা ভালোবাসে, প্রাতিষ্ঠানিকতা বোঝে, অামি শুধু অানন্দ অার উপলব্ধির মুহূর্তগুলো মনে রাখতে ভালোবাসি। নিজের জন্য লম্বা দূরত্বের কিছু ভাবি না। বড়জোড় সামনের মাস চারেকে কি করবো ততটুকু ভাবি।
দেশটাকে খুব মিস করি। দেশ ছেড়ে টাকাপয়সার এই দেশে থাকলেও মনটা পড়ে থাকে বাংলাদেশে। বাংলাদেশের মাটির ঘ্রাণ অামাকে কাদাঁয়। তখন অামাকে অগত্যা বর্ষার কাছে চিঠি লিখতে হয়। লিখতে হয়, বর্ষা,তুমি অামায় মেঘলা দিনে ডেকো। অামি ছাতামাথায় হাঁটতে ভালোবাসি। জ্বর অাসবার ভয় রেখেও বৃষ্টির ছাট শরীরে মাখতে ভালবাসি।
সেদিন বাঙ্গালিপাড়া পূর্ব লন্ডনে ট্রেন থেকে নেমে হাঁটছিলাম। ছেলেটা বাংলাদেশি ছাত্র বা অামাকে চেনে এমন কেউ হবে। সিগারেট খাচ্ছিল। অামাকে দেখে দ্রুত সরে গেল সিগারেটটা ফেলে। ঘটনাটা অামাকে মুগ্ধ করলো। লজ্জিত অার বিব্রতও করলো। কারণ অামার হাতেও যে ছিল। এই সব ছোট ছোট মুগ্ধতা,অানন্দ-বেদনা, এগুলো নিয়েই তৃপ্তিতে পথ চলি।
দুর্ভাগ্যকে খুব তাড়াতাড়ি মেনে নিতে জানি বলেই, প্রশান্তির সময়গুলো জীবনে অারো জলদি অাসে।
এই যে, অাজকের প্রিয় গানটা শুনতে শুনতে জীবনের অগোছালো গল্পের খেরোখাতা লিখছি। কোথাও মনে হলো; অারে, এই গল্পটা তো একলা খালি অামার না। এটা হতো অাপনারও গল্প। হয়ত কোন একটা অংশ। এটা অামার ফেসবুক বন্ধুদেরও হয়ত কারো জীবনের গল্প, হয়ত কোন স্কুল বন্ধুর। একটা সময় সব সম্পর্কে দূরত্ব বাড়ে। শুধু বন্ধুতা ছাড়া। খুব কাছের বন্ধুরা কখনো বিপদে সরে যায় না।
সেরা দুটো লাইন অার ভালোবেসে নিজে পড়ার মতো একটাও লেখা লেখতে পারিনি। যে লেখাটা লিখতে পারার তৃপ্তি নিয়ে অনায়াসে অানন্দে মরে যাওয়া যায়।
দিনশেষে চাই খুব কম। কারণ জানি চাওয়া বেশি হলেই তুমি ঠকবে। বিবেকের বোধটা অামার কাছে প্রার্থনার মতো একটা বিষয়। ক’দিন অাগে খুব এক কাছের মানুষ বাবা হয়েছেন। ফোন করে সুখবরটি দিয়ে নবজাতক শিশু কন্যাটির জন্য একটা নাম চাইলেন। রাতের ঐ সময়টায় কাজে ছিলাম। তৎক্ষনাৎ কি জানি মনে এলো; বললাম, ডাকনাম রাখতে পারেন মৃদূলা। তিনি বললেন, নামটা তার খুব পছন্দ হয়েছে।
জীবন যতটা দিয়েছে, অামি কখনোই ততটা দিইনি জীবনকে। তবে, যা করি অার যা লিখি, সবটুকু তার হৃদয় অার বিশ্বাস থেকে। নিজেকে অামি ঠকাই না, পাঠকদেরও না। শেষ বিচারে নিজের কাছে যোগ্যতার বহুগুণ পাওয়া কৃতজ্ঞ অর্ধেক মানুষ।
শেষপর্যন্ত অামাকে জানতে হয়, ভালোবাসারও মেয়াদ থাকে। থাকে বলেই ভালোবাসা মেয়াদোত্তীর্ণ হয়। খুব কম ভালোবাসা কালোত্তীর্ন হয়। খুব কাছের ভালোবাসাগুলি মেয়াদ হারাবার অাগে মৃত্যুর কাছেই হেরে যেতে অানন্দ থাকে। স্বার্থকতার।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)।