চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

ভালোবাসার জয়মাল্য সেলিনা হোসেন

মায়ের মতো জ্ঞান করি তাকে মাতৃসম মহিয়সী তিনি। ছোটোগল্প, উপন্যাস, শিশুসাহিত্য-এইসব মাধ্যমে সফল এক লেখক। আমার অতিপ্রিয় সেলিনা হোসেন।

সেই কবে কোনো ছোটবেলায় তাকে দেখেছি। তাকে ‘সেলিনা’ আপা সম্বোধন করেছি। আপা স্নেহের অবারিত হাত প্রসারিত করেছেন আমাদের প্রতি।

সাগর ভাই অবশ্য সেলিনা আপাকে খালা ডাকেন। রাবেয়া খাতুনের সম্পর্ক সূত্রে।

সেলিনা আপা বাংলা একাডেমির পরিচালক ছিলেন দীর্ঘদিন। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে লেখাপড়া করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে।

আমরা ছোটবেলা থেকে সেলিনা আপাকে চিনি ধান শালিকের দেশের সম্পাদক হিসেবে। বাংলা একাডেমি প্রকাশিত শিশু-কিশোর মাসিক। এই পত্রিকাটিতে সেলিনা আপা গভীর মমতা ও ভালোবাসা দিয়ে দীর্ঘদিন সম্পাদনা করেছেন। আমরা নিয়মিত সেখানে লিখতাম। কোন ভুল থাকলে যত্ন নিয়ে তা শুধরে দিতেন।

সেলিনা আপাকে কোনোদিন উচ্চকণ্ঠে কথা বলতে শুনিনি। দ্রুত ছুটতে দেখিনি। খুব স্থির। খুব শান্ত ধরনের ব্যক্তিত্ব। কিন্তু খুব অভিমানী। কারো ওপর কোনো কারণে রাগ করলে সেটা তিনি দ্রুত প্রকাশ করবেন। আর কখন যে অভিমান করবেন সেলিনা আপা সেটা কেউ জানে না।

সেলিনা আপা খুব হৃদয়বান। সবসময় সবার খোঁজখবর রাখবেন। ব্যক্তিগত পর্যায়ের খবর। আমি যে ডায়াবেটিক রোগী, আমার হার্টে সমস্যা আছে তা নিয়ে আপা খুব উদ্বিগ্ন থাকে।

আর সেলিনা আপা সব বিষয় নিয়ে খুব সিরিয়াস। কোন কাজ তিনি কাছিমের মতো তীব্র ভাবে আঁকড়ে ধরবেন। আর পড়াশোনা করার অপরিসীম ক্ষমতা তার। প্রচুর বই পড়েন।

সেলিনা আপা এখন শিশু একাডেমীর চেয়ারম্যান। প্রয়োজনে সম্পাদনা করতে হয়। নিজেও অনেক ধরনের বিষয় নিয়ে সম্পাদনা কাজ করেন। তখন দেখেছি- কি যে সিরিয়াস তিনি। লেখা বাছাই, সম্পাদনা করে থাকেন অনেক নিষ্ঠার সঙ্গে।

সেলিনা আপার একটা বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তরুণদের পৃষ্ঠপোষকতা করা। যেখানেই কর্মজীবনে পদাধিকার বলে কাজের সুযোগ পেয়েছেন সেখানেই তরুণদের পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। এটি একটি বিরল গুণ। এমন তারুণ্যদীপ্ত হৃদয়বান লেখক খুব বেশি দেখা যায় না।

পেছন পানে তাকিয়ে দেখি, অনেক স্মৃতি। সেলিনা আপার সঙ্গে কম স্মৃতি নয়।

একটা স্মৃতি খুব বেশি মনে পড়ে। বিখ্যাত চিত্রশিল্পী এস এম সুলতান। তাকে বাংলা একাডেমিতে দেখলাম। সেলিনা আপাকে ধরে তিনি হাঁটছেন। বাংলা একাডেমির নতুন ভবনের পাশে একটা মহুয়া গাছ আছে। সেই গাছের তলায় কালো আলখাল্লা পরা এস এম সুলতানকে প্রথম দর্শন। পরে একদিন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের আমতলাতেও দেখা পাই এসএম সুলতানকে। নড়াইল থেকে কখনো এসএম সুলতান ঢাকায় এলে সেলিনা আপার আতিথ্য গ্রহণ করতেন। এই আন্তরিক শ্রদ্ধাবোধ আমাদের উদ্দীপ্ত করতো।

সাহিত্য জীবনের সূচনাপর্ব থেকেই তিনটি বিষয়ে সেলিনা আপা নিরাপোষ। বাঙালি জাতীয়তাবোধ, বঙ্গবন্ধু এবং বাংলাদেশ। তার সমগ্র রচনাবলীতেই দেশপ্রেমের উত্তাপ ছড়িয়ে আছে।

সেলিনা হোসেন তার রচনায় প্রকৃতি ও মানুষের জীবনকে একসূত্রে গেঁথেছেন। অসম্ভব প্রকৃতি প্রেমিক তিনি। তার অনেক বিখ্যাত বই আছে। যে বইয়ের অনুষঙ্গ প্রকৃতি নিয়ে। সে সব বিস্তারিত লেখা যাবে।
এবার চন্দ্রবতী একাডেমির শিশুসাহিত্য সম্মেলনে আমার একটা নোটবুক বাড়িয়ে দিলাম সেলিনা আপার কাছে। আপা বলল, একটু পরে তোমাকে অটোগ্রাফ দিচ্ছি।

একটা অটোগ্রাফ দেয়ার ব্যাপারেও সেলিনা আপা অনেক সিরিয়াস। আমার ছড়ার চারলাইন তিনি কারও কাছ থেকে শিওর হলেন। তারপর খাতার পাতায় লিখে দিলেন : আমীরুলের ছড়ার মতোই আমীরুলও অনেক ভালো মনের মানুষ। আমীরুলের দীর্ঘ জীবন কামনা করি।

দেখা হলেই মিষ্টি হাসি দেবেন সেলিনা আপা। মায়েদের মত তার চোখমুখ থেকে অবিরত স্নেহের ধারা ঝরে পড়ে।
তোমাদের খবর কি?
তোমরা কেমন আছো?
জ্বী আপা ভালো।
সাগর কেমন আছে?
ভালো আছে আপা।
তারপরই হয়তো স্বগতোক্তির মতো করে বললেন,
রাবেয়া আপার শরীর কেমন? বয়স হচ্ছে। ভালো যাচ্ছে না নিশ্চয়ই। আমারই কত সমস্যা।
না, না আপা। আপনি অনেক ভালো আছেন।
সেলিনা আপার মুখে তখন সেই সলজ্জ হাসি। হ্যাঁ-না কিছু বললেন না।

সেলিনা আপাকে যখন থেকে দেখছি তখন থেকে তার চোখে চশমা। সুতির শাড়ি। পায়ে স্লিপার। কাঁধে ব্যাগ। আড়ম্বরহীন, সরল- সাদা মনের ব্যক্তিত্ব।

একদিন বাংলা একাডেমিতে গেছি। সেলিনা আপার বক্তব্য নেব প্রকৃতি বিষয়ে। বর্ধমান হাউসের পুকুরমুখী বারান্দায় আমরা দাঁড়ালাম। ক্যামেরা চালু হলো। আপা সেদিন বৃক্ষ বিষয়ে বললেন। তার বাবা বৃক্ষ বিশারদ ছিলেন। নামী কবিরাজ। গাছের ভেষজ গুণাগুণ সম্পর্কে ব্যাপক জানতেন।

ছোটোবেলার স্মৃতি। আপা বললেন, তার ছোটবোনের গভীর অসুখ হয়েছে। তখন বাবা বললেন, ভোরবেলা অমুক গাছের তলায় গিয়ে ভেজা শিশির যদি ওকে খাওয়ানো যায় তবে মেয়েটি সুস্থ হয়ে যাবে।
সেদিন থেকে প্রতিদিন ভোরবেলা উঠে সেলিনা আপা সেই গাছতলায় যান। শিশির বিন্দু সংগ্রহ করেন।
গাছ এমনই স্নেহশীলা। গাছ এভাবেই আমাদের দীক্ষা দেয়। বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখায়। এমন গভীর মমতা নিয়ে সেলিনা আপা সেই গল্প বলেছিলেন যে আমাদের প্রত্যেকের চোখে জল চিকচিক ওঠে।

সেলিনা আপা ব্যক্তিগত ভাবে প্রচণ্ড বৃক্ষপ্রেমিক, বাংলার অধিকাংশ গাছপালাকে তিনি চেনেন। লতাগুল্ম তার চেনা। দ্বিজেন শর্মার মতোই তার আনন্দ-বেদনার সঙ্গী গাছেরা। তার বাবার কারণে শৈশব থেকেই গাছের সাথে বন্ধুত্ব হয়েছে সেলিনা আপার।

সেলিনা আপা বঙ্গবন্ধু ও রবীন্দ্রনাথ- এই দুই বিশাল বৃক্ষ নিয়ে বৃহৎ আকারের উপন্যাস লিখেছেন। ‘হাঙ্গর নদী গ্রেনেড’ তার মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বিখ্যাত উপন্যাস। সত্যজিৎ রায় এই উপন্যাসের প্রেক্ষাপট নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণের আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেছিলেন। সেলিনা আপার শতাধিক গ্রন্থ। সে আলোচনা এই প্রেক্ষাপটে নয়।

তবে গত পঞ্চাশ বছরে সচেতন বাঙালি পাঠক মাত্রই সেলিনা আপার কোন না কোন লেখা পড়েছেন। সেলিনা আপা সৎ সাহিত্যিক। জনপ্রিয় ধাবার সস্তা লেখা তিনি লেখেননি। বিনোদন-সাহিত্য থেকে দূরে থেকেছেন। সম্প্রতি বড় প্রেক্ষাপট ও বড় বিষয় নিয়ে তিনি উপন্যাস লেখেন। সেলিনা আপা বড় প্রেক্ষাপট পছন্দ করেন। তার যেকোন কাজই বড় আকারের।

সেলিনা আপা তার সাহিত্য চর্চা ও সামাজিক কর্মকাণ্ডের জন্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অনেক পুরস্কার পেয়েছেন। দেশে বাংলা একাডেমি পুরস্কার ছাড়াও একুশে পদক, স্বাধীনতা পুরস্কার পেয়েছেন।

তবে সবচেয়ে বেশি পেয়েছেন মানুষের ভালোবাসা। ভালোবাসার জয়মাল্য তারই প্রাপ্য।