দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলার রায় চীনের বিপক্ষে গিয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে এই খবরের কোথাও বাংলাদেশের জন্য বাড়তি কোনো আগ্রহোদ্দীপক তথ্য নেই বলে ধরা যেতেই পারে। জাহাজের পথ মহাসাগরের খবর নিয়ে আদার ব্যাপারীদের আর কী লাভ থাকতে পারে! তবে শেষ পর্যন্ত মহাসাগরের এই খবর বাংলাদেশের জন্যও অদূর ভবিষ্যতেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। এর অন্যতম প্রধান কারণ ভারত মহাসাগরে বাংলাদেশের অবস্থান।
বর্তমান বৈশ্বিক রাজনীতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভারত মহাসাগরের প্রাচীন ইতিহাস বহিরাগতদের জন্য সুখকর নয়। আবার যখন এ অঞ্চলের জন্য বহিরাগতরা দুঃখ বয়ে নিয়ে এসেছিলো, তার মূলেও ছিলো এই মহাসাগর। মার্কিন নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ রবার্ট ডি ক্যাপলান বহু বছর ধরে এই মহাসাগর নিয়ে কাজ করেছেন, বইও লিখেছেন। তিনি মোটামুটি চোখে আঙুল দিয়েই দেখিয়েছেন, প্রাচীনকালে বিস্তৃত এই মহাসাগরের মৌসুমী বায়ুপ্রবাহের বিচিত্র ধরণ কীভাবে এ অঞ্চলের বাণিজ্যিক স্ফীতি ঘটায়।
ক্যাপলানের মতে, এই মহাসাগরের নিজস্ব বায়ুপ্রবাহের ধরণটিই ছিলো এ অঞ্চলে যোগাযোগের চাবিকাঠি। বাইরের কাছে এই বায়ুপ্রবাহ ছিলো অপরিচিত। আর সে কারণেই ভারত মহাসাগর সংশ্লিষ্ট ভূখণ্ডগুলো সেই সময় নিজেদের ভেতর আন্তযোগাযোগের এক অকল্পনীয় ক্ষেত্র তৈরি করতে পেরেছিলো। অন্যদের জন্য অজানা এই নিজস্ব বায়ুপ্রবাহই এ অঞ্চলের নিরাপত্তা বলয়ের কাজ করতো। সেই বলয় ভাঙে যখন বহিরাগতরা সেই বায়ুপ্রবাহের গতিপথ খুঁজে পায়। তারপরের ইতিহাস তো সবারই জানা। ইউরোপীয় বেনিয়াদের আগমন, অর্থনৈতিক লেনদেন থেকে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব দখল পর্যন্ত গড়ায়।
ভূরাজনীতি ও নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা আজকের দিনেও ভারত মহাসাগরকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন। এর অন্যতম প্রধান কারণ, এই মহাসাগর পৃথিবীর বাণিজ্যিক পরিবহনের প্রধান পথ। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যে যোগাযোগই শুধু নয়, বিশ্বশক্তিগুলোর নানা রসদ পরিবহনের মূল পথ এই অঞ্চল। সাগরতলের সম্পদেও কিছু কম লোভাতুর নজর নেই। বর্তমান বিশ্বশক্তিগুলোর সমরকৌশলে স্বল্প ব্যয়ে অধিক সাফল্যের নীতি প্রাধান্য পাওয়ায় মহাসাগর কেন্দ্রিক সামরিক স্থাপনার জন্যও এ অঞ্চল গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে মার্কিন স্বার্থের জন্য সাম্প্রতিক সময়ের অন্যতম শত্রু ও মিত্র উভয়পক্ষের ভৌগোলিক অবস্থানই এই মহাসাগরের কাছে।
কাজেই কয়েক দশক আগে মানবাধিকার লঙ্ঘনের সবচেয়ে নিকৃষ্ট উদাহরণগুলোর মধ্যে একটি গড়ে এখানকার দ্বীপ ডিয়েগো গার্সিয়া থেকে সেখানকার অধিবাসীদের বাস্তুহারা করে সেখানে মার্কিন সামরিক ঘাটি স্থাপন করা হয়। ব্রিটিশদের কাছ থেকে লিজ নেয়া এই দ্বীপ মার্কিনদের জন্য শুধু ভারত মহাসাগরের পাহারাদারই নয়, গুয়াম অ্যান্ডারসন ও এই ঘাটি মিলিয়ে এ অঞ্চলে একটি শক্ত সামরিক অবস্থানের দৃষ্টান্তও বটে। তবে তারা সেখানেই থেমে থাকে নি। ২০১০ সালে তারা ঘোষণা দিয়ে এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে তাদের মোট সমরশক্তির ৭০ শতাংশ ব্যয়ের কাজ শুরু করে। শেষ হওয়ার কথা ২০১৮ সালে। এর মধ্যেই দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে উত্তেজনার পারদ ক্রমাগত ওঠানামা শুরু করে।
এই সময়টুকু ছিলো যুক্তরাষ্ট্রের প্রাচ্যনীতির জন্য এক বিশেষ পর্যবেক্ষণের সময়। খানিকটা অস্বস্তির মধ্যেও ছিলো তারা। বিশেষ করে এ অঞ্চলের তিন গুরুত্বপূর্ণ শক্তি রাশিয়া, চীন ও ভারত নানা ক্ষেত্রে পরস্পরের কাছাকাছি আসতে থাকে। অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্কের পাশাপাশি কৌশলগত সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতাও এই তিন রাষ্ট্রের মধ্যে বাড়তে থাকে। ২০১৪ সাল পর্যন্ত রিক সংলাপ ও ব্রিকসের সম্ভাবনার আলোই ছিলো ভূরাজনীতির বাঁক বদল। আঞ্চলিক সংহতির এই সম্ভাবনা এ অঞ্চলে মার্কিন স্বার্থকে বিপণ্ণ করে তোলে। যদিও সেই পরিস্থিতি এখন আবারো নতুন চেহারা নিতে যাচ্ছে। সাম্প্রতিক নানা ইস্যুতে চীন-ভারত ঐক্যতানের সম্ভাবনা কিছুটা মলিন হয়েছে।
দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে দেয়া রায় বিপক্ষে যাওয়াটা স্বাভাবিকভাবেই চীন মেনে নেয় নি। রায়ের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই বক্সন নিউজ খবর দিয়েছে, চীনা সামরিক বাহিনীকে প্রস্তুত থাকার জন্য বলা হয়েছে প্রেসিডেন্টের পক্ষ থেকে। তেল ও গ্যাস পরিবহনের নিরাপত্তা মালাক্কা ফাঁদে আটকে পরার শঙ্কা বহুদিন ধরেই তাদেরকে তাড়া করছে। এর সঙ্গে নতুন করে যোগ হওয়া এই রায় চীনকে নিঃসন্দেহে মরিয়া করে তুলবে। কারণ, চীন খুব ভালোভাবেই অনুধাবন করতে পারছে, এর পরের মার্কিন কৌশলটিই হবে ভারত মহাসাগর ঘিরে। এর প্রস্তুতির প্রাথমিক পর্বে অনেক আগে থেকেই বঙ্গোপসাগরের আশেপাশে মার্কিন উপস্থিতি নিশ্চিত করার প্রচেষ্টা চলেছে। কিন্তু সরাসরি সেই কৌশলে সফল হতে না পেরে পেন্টাগন নতুন কৌশল নেয়। আর সেটি হলো, আঞ্চলিক মিত্রদের কাঁধে পা দিয়ে এ অঞ্চলে তাদের উপস্থিতি নিশ্চিত করা।
গত দেড় বছরে এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে মার্কিন সমরশক্তি বাড়াতে কোনো বেগ পেতে হয় নি। কারণ ঠিক সেই সময়টাতে এ অঞ্চলের অন্যতম দুই শক্তি চীন ও ভারত পরস্পরকে ঠেকানোর কৌশল নিয়ে ভারত মহাসাগর কেন্দ্রীক পরিকল্পনার ছক সাজিয়েছে। মরিশাস, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ থেকে শুরু করে ভারত মহাসাগরের দ্বীপ রাষ্ট্রগুলোর ব্যাপারে দুই দেশই বাড়তি মনোযোগ দিয়েছে। এই তৎপরতায় চীনে-ভারতে কাটাকাটি হয়েছে ঠিকই। কিন্তু মার্কিন উপস্থিতি তাতে বিঘ্নিত হয় নি। সবশেষ এ বছর কদিন আগে মিশন মালাবারের আওতায় যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের সঙ্গে ভারত যৌথ সামরিক মহরায় অংশ নিয়ে বুঝিয়েই দিয়েছে, ভারত মহাসাগরে যুক্তরাষ্ট্র নয়, তাদের মূল মাথাব্যথা চীন। কাজেই ২০১৮ সালের মধ্যে মার্কিন পরিকল্পনা অনুযায়ী ভারত মহাসাগরে অবস্থান নিশ্চিত করার কাজটিতে তারা মিত্র হিসেবে ভারতকে পাশে পাবে বলে ধরেই নিচ্ছে। সঙ্গত কারণেই এই ইস্যুতে আপাতত কোনো আঞ্চলিক সংহতি তৈরির স্বপ্ন সুদূর পরাহত।
কাজেই আগামী দিনে ভারত মহাসাগরে যে বড় খেলার প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে, তাতে নাটকীয় কোনো বদল না হলে চীন-ভারত মুখোমুখি হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। পারস্পরিক এই শক্তিক্ষয় শেষতক কার জন্য কতোটা লাভ বয়ে আনবে, তা সময় বলবে। তবে যাদের কুমীর ঠেকানোর কথা ছিলো, তারা যখন নিজেরাই খাল কাটতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন, তখন অদূর ভবিষ্যতে কুমীরের দাঁত আর নখের বিভীষিকায় টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়ার মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে রাখাই ভালো। কখনো কখনো একটা দুটা ভুল কৌশল দীর্ঘ সময়ের কান্নার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। মধ্যপ্রাচ্য এর জ্বলন্ত উদাহরণ।
রাজা-রাজরাদের এই বিগ গেমে বাংলাদেশের জন্য বড় বার্তাটি হতে পারে, এই বাস্তবতা আর নিজের ভৌগোলিক অবস্থান মাথায় রেখে আঞ্চলিক সম্পর্কগুলোকে গভীরভাবে পরিচর্যা করা। কে জানে, ছোট হলেও শুধুমাত্র বহুমুখী সম্পর্কের কারণে বাংলাদেশই আগামীর এশিয়াকে সর্বনাশের হাত থেকে হয়তো রক্ষা করতে ভূমিকা রাখতে পারে! আর সে কারণেই বাংলাদেশ সন্ত্রাসকবলিত হলে পুরো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ভবিষ্যতই আক্রান্ত হবে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল
আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)