গ্রাহকদের অ্যাকাউন্টের গোপনীয়তা বজায় রাখায় সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলো প্রায় কিংবদন্তিতুল্য। এই সুবিধা ও সুযোগের কারণে সারাবিশ্বের বৈধ ও অবৈধ অর্থের মালিকরা সুইস ব্যাংকগুলোতে নিজেদের গোপন কিংবা প্রকাশ্য অর্থ জমা রাখেন। বিশ্বায়নের এই যুগে প্রযুক্তি ও তথ্যের অবাধ প্রবাহের কারণে অবশ্য মোটাদাগে জানা যাচ্ছে যে কোন দেশের গ্রাহকরা কী পরিমাণ অর্থ সুইস বিভিন্ন ব্যাংকে জমা করছেন। সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকে বাংলাদেশিদের অর্থ জমা রয়েছে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ।
সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুইস ন্যাশনাল ব্যাংক (এসএনবি) ‘ব্যাংকস ইন সুইজারল্যান্ড ২০১৬’ শীর্ষক বার্ষিক প্রতিবেদনে বিভিন্ন দেশের গ্রাহকদের অর্থ জমার পরিমাণ প্রকাশ করেছে। এ বছর সুইস ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশ থেকে জমা হওয়া অর্থের পরিমাণ ৬৬ কোটি ১০ লাখ সুইস ফ্রাঁ, বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৫ হাজার ৬৮৫ কোটি টাকা (এক সুইস ফ্রাঁ=৮৬ টাকা)। ২০১৫ সালে সুইস ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশ থেকে জমার পরিমাণ ছিল প্রায় ৪ হাজার ৭৩০ কোটি টাকা। সে হিসাবে আগের বছরের চেয়ে প্রায় এক হাজার কোটি টাকা বা ২০ শতাংশ বেড়েছে।
সবচেয়ে বেশি অর্থ গচ্ছিত রাখা নাগরিকদের তালিকায় শীর্ষস্থানে রয়েছে যুক্তরাজ্য, দ্বিতীয় স্থানে যুক্তরাষ্ট্র।
সুইস ব্যাংকে বিভিন্ন দেশের রাজনীতিবিদ, শিল্পপতি, সন্ত্রাসী, সেলেব্রিটিসহ হোমড়া-চোমড়াদের কালো টাকার পাহাড় নিয়ে বহু গল্প-প্রতিবেদন হয়েছে। বড় কোন কাজের পরে বা কেলেঙ্কারির পর অর্থ জমা হয়ে যাচ্ছে সুইস ব্যাংকে, এমন দৃশ্য নিয়ে বিভিন্ন দেশে সিনেমাও তৈরি হয়েছে।
সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলো (সুইস ব্যাংক হিসেবে পরিচিত) খুবই কঠোর গোপনীয়তার সুবিধা দেয়াতে পাচারের অর্থ জমা রেখে বেশ স্বাচ্ছন্দ্যে থাকেন পাচারকারীরা। খোদ সুইজারল্যান্ড রাষ্ট্রই তাদের ব্যাংকগুলোকে এই সুবিধা (!) অনুমোদন দিয়েছে। ফলে কোন রাষ্ট্র ও সরকারের অনুরোধেও সুইস এসব ব্যাংক অনুরোধ করা ওই রাষ্ট্রের নাগরিকদের লেনদেনের কোন তথ্য প্রকাশ করে না।
ভারত কীভাবে এই অর্থ পাচারের লাগাম টানলো?
সুইজারল্যান্ড করফাঁকির স্বর্গরাজ্য হয়ে উঠেছে বলে দীর্ঘদিন ধরেই অভিযোগ আছে আন্তজার্তিক বিভিন্ন মহলে। দুর্নীতি বিকাশ আর লালনের জন্য তাদের অভিযুক্ত করা হয় বিভিন্ন দুর্নীতি দমন ও মনিটরিং ফোরামে। তবে সুইস কর্তৃপক্ষ গ্রাহকের গোপনীয়তার দোহাই আর ব্যাংক ব্যবসার কথা বলে পার পেয়ে যাচ্ছিলো অনেক বছর ধরেই। তারাও অবশ্য এখন বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করছে, চিন্তা করছে কীভাবে সারাবিশ্বে দুর্নীতি কমানো যায়।
১৯৯৭ সাল থেকে সুইস ব্যাংকগুলো সংক্ষিপ্ত আকারে তথ্য প্রকাশ করলেও সম্প্রতি সুইজারল্যান্ডের ফেডারেল কাউন্সিল গ্লোবাল কনভেনশন অন অটোমেটিক এক্সচেঞ্জ অব ইনফরমেশন- এইওআই (global convention on automatic exchange of information-AEOI) এর স্বীকৃতি দেয়। এইওআই মেনে নেওয়ায় এখন থেকে সুইজারল্যান্ড তাদের ব্যাংকে রক্ষিত অর্থের তথ্য গ্রাহকের নাম না উল্লেখ করে গোপনীয়তা বজায় রেখে প্রকাশ করবে।
বিভিন্ন দেশের সরকার প্রধান ও স্ব স্ব দেশের ফিনান্সিয়াল ইন্টিলিজেন্সের ডাকে সাড়া দিয়ে সুইস কর্তৃপক্ষ কিছু যুগান্তকারী পদক্ষেপও নিতে শুরু করেছে। সেসব নিয়ম ও সুযোগের ব্যবহার করে সাফল্য পেতে শুরু করেছে বাংলাদেশের অন্যতম প্রতিবেশী দেশ ভারত।
এ বিষয়ে গদ কয়েক বছর ধরে দারুণ সাফল্য পেয়েছে ভারত! প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৬ সালে এসে আগের বছরের চেয়ে সুইস ব্যাংকগুলোতে ভারতের জমার পরিমাণ প্রায় অর্ধেক হয়ে গেছে। ২০১৫ সালে ভারতীয়দের জমার পরিমাণ ছিল প্রায় ১২১ কোটি সুইস ফ্রাঁ, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১০ হাজার ৪০৬ কোটি টাকা। ২০১৬ সালে এসে ভারতের জমার পরিমাণ কমে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৫ হাজার ৭১০ কোটি টাকা, মানে এক বছরে ৪ হাজার ৬৯৬ কোটি টাকা কমেছে।
বিশ্বের ২৮২টি দেশ ২০১৬ সালে সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে অর্থ জমা রেখেছে। ওই তালিকায় বাংলাদেশের (৮৯তম) আগের অবস্থানটিই হচ্ছে ভারতের (৮৮তম)। তালিকায় সর্বনিম্নে অবস্থান করছে ভুটান, ২৮২তম। ২০১৫ সালে অর্থ জমায় ৭৫তম অবস্থানে ছিল ভারত, আর ২০১৪ সালে ভারতের অবস্থান ছিল ৬১তম। এ এক বিরাট অগ্রগতি!
এছাড়া বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিবেদন অনুসারে, মুদ্রা পাচারের দিক থেকে বিশ্বে ভারত চতুর্থ থেকে পঞ্চমে উঠানামা করে। গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিআইএফ) এর প্রতিবেদন অনুসারে, ২০০৫ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত সময়ে ভারত থেকে ১৬৫ বিলিয়ন ডলার বা প্রায় ১১ লাখ কোটি রুপি পাচার হয়েছে।
এ অবস্থায় ভারতের বিভিন্ন সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিলেও কালো টাকা রোধ ও পাচারে সবচেয়ে কার্যকর যোগাযোগ-পদক্ষেপ নেন বর্তমান ক্ষমতাসীন নরেন্দ মোদির বিজেপি সরকার। নরেন্দ মোদির সরকার ক্ষমতায় আসার পর সুইস ব্যাংকে টাকা পাচার বন্ধ, ভারতে অর্থ ফিরিয়ে আনা ও বিনিয়োগের উপরে জোর দিতে শুরু করেছে। নিজের দলের মধ্যে শুদ্ধি অভিযানের ঘোষণা দিয়ে ওই কাজে হাত দিয়েছেন মোদি।
ক্ষমতায় এসেই কালো টাকা উদ্ধারের জন্য ভারতের সাবেক বিচারপতি এমবি শাহর নেতৃত্বে একটি বিশেষ তদন্তকারী দল বা সিট (SIT) গঠন করে মোদি সরকার। নরেন্দ্র মোদির আগের ইউপিএ সরকারও বিদেশের ব্যাংকে গচ্ছিত কালো/পাচার হওয়া টাকা উদ্ধারে সক্রিয় হয়েছিল। বিরোধী দলনেতা থাকাকালীন লালকৃষ্ণ আদভানি কালো টাকা নিয়ে তথ্য সংগ্রহের জন্য একটি টাস্ক ফোর্স গঠন করেছিলেন। তার অন্যতম সদস্য ছিলেন অজিত দোভাল। তিনি এখন মোদি সরকারের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা। এই টাস্ক ফোর্সের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, তারা অনুসন্ধান করে জেনেছে সুইস ব্যাংকে ভারতীয়দের গচ্ছিত কালো টাকার পরিমাণ প্রায় ২৫,০০০ লাখ কোটি টাকা যদিও সে ব্যাপারে কোনও সুনির্দিষ্ট তথ্যপ্রমাণ সেসময় পাওয়া যায়নি। এই বিপুল পরিমাণ টাকা উদ্ধারের দাবি জানিয়ে রথযাত্রাও করে ছিলেন আদভানি।
সরকারে ও বিরোধীদলে থাকার অভিজ্ঞতা নিয়ে মোদি নিজের দলের মধ্যে শুদ্ধি অভিযানের ঘোষণা দিয়ে ওই কাজে হাত দিয়েছেন। শুরুতে বাইরে ও ভেতর থেকে প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়লেও ২০১৬ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে সফল হতে থাকেন তিনি।
ক্ষমতায় আসার পর থেকেই সুইজারল্যান্ডের কাছে সে দেশের ব্যাংকগুলোতে ভারতীয় নাগরিকদের লেনদেন সংক্রান্ত তথ্য দেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে আসছিল ভারত। তবে প্রথম প্রথম প্রথম তাতে তেমন কোনো সাড়া দেয়নি সুইজারল্যান্ড।
২০১৬ সালের জুন মাসে সুইজারল্যান্ড সফরের সময় এ বিষয়ে জোরালো অবস্থান তুলে ধরেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তাতে পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করে। ২০১৬ সালের নভেম্বরে তথ্য আদান-প্রদান বিষয়ে সুইজারল্যান্ডের সঙ্গে চুক্তি সই হয় ভারতের।
কীভাবে তথ্য পাবে তার বেশি বিস্তারিত প্রকাশ না করলেও সেসময় ভারতের অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়েছিল, ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর থেকে সুইস ব্যাংকগুলোতে ভারতীয়রা যে সব অ্যাকাউন্ট খুলবেন, সেগুলির লেনদেনের তথ্য সরাসরি হাতে পাবে ভারত।
জুন ২০১৭তে ভারতের গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদনে জানা যায়, গোপনীয়তা বজায় রাখার শর্তে সুইস ব্যাংকগুলোতে ভারতীয়দের অ্যাকাউন্ট লেনদেনের তথ্য পাবে ভারত সরকার। তবে সে তথ্যের জন্য ভারতকে অপেক্ষা করতে হবে ২০১৯ সাল পর্যন্ত।
এই সংবাদের পর সুইস ব্যাংকগুলোতে ভারতীয়দের অর্থ উত্তোলন বা সরিয়ে নেবার কোনো তথ্য প্রকাশ না হলেও, সেখানে জমার পরিমাণ কমেছে পর্বতপতন হারে। স্থানীয়ভাবেও নগদ লেনদেন কমাতে ভারতীয় রুপি বাতিলসহ নানা পদক্ষেপ নিয়ে মোদি সরকার যে সিগন্যাল দিয়েছে, সমালোচনা থাকলেও তাও বেশ কার্যকর ফল নিয়ে আসতে শুরু করেছে সেদেশের ব্যাংকিং খাতে।
একটি দেশের সরকার প্রকৃত অর্থে আন্তরিক হলে কালো টাকা রোধ ও অর্থ পাচার বন্ধ করা যে খুব কঠিন না, তা প্রমাণ করেই যাচ্ছেন নরেন্দ মোদি।
অর্থপাচারে বাংলাদেশের অবস্থা ও ব্যবস্থা
বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৯১১ কোটি ডলার পাচার হয়েছে ২০১৪ সালে, টাকার অঙ্কে যা প্রায় ৭২ হাজার ৮৭২ কোটি টাকা। ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই) অর্থ পাচারের এ তথ্য প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনে রয়েছে ২০০৫ থেকে ২০১৪ সাল সময় পর্যন্ত তথ্য।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৪ সালে যে পরিমাণ অর্থ বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে পাচার হয়ে গেছে, তা চলতি অর্থবছরের মূল্য সংযোজন কর (মূসক) খাতে আদায়ের লক্ষ্যমাত্রার সমান। ২০০৫ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে প্রায় ৭ হাজার ৫৮৫ কোটি ডলার বা ৬ লাখ ৬ হাজার ৮৬৮ কোটি টাকা। যা দিয়ে অর্থমন্ত্রী প্রায় দুই বছরের বাজেট তৈরি করতে পারতেন।
সুইস ব্যাংকগুলোতে ২০১৬ সালে বাংলাদেশ থেকে জমা হওয়া অর্থের পরিমাণ প্রায় ৫ হাজার ৬৮৫ কোটি টাকা, আগের বছরের চেয়ে প্রায় এক হাজার কোটি টাকা বা ২০ শতাংশ বেড়েছে। বছর বছর বেড়েই চলেছে এই অবস্থা।
দেশে দৃশ্যমান ও কার্যকর উন্নয়ন হলেও ক্রমবর্ধমান কালো টাকা ও টাকা পাচারের কারণে অগ্রগতি যে হারে হওয়া উচিত, তা হচ্ছে না। গত ৬ জুন সংসদে বক্তব্যকালে অর্থমন্ত্রী এএমএ মুহিত দেশ থেকে টাকা পাচার হওয়ার কথা স্বীকার করেছেন। টাকা পাচার পুরোপুরি বন্ধ করা সম্ভব না বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
তবে বিদেশের ব্যাংকে জমা হওয়া সব টাকাই যে পাচার হয়েছে, তা নয়। বিদেশে বসবাসকারী বাংলাদেশিরাও তাদের বৈধ টাকা সেখানে রাখছেন।
দেশ থেকে অর্থপাচারের তথ্য আদান-প্রদান করতে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সমঝোতা স্মারকে সই করেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট। বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত প্রায় অর্ধশত দেশের সঙ্গে চুক্তি করেছে। কিন্তু সুইজারল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডের মতো ক্রমবর্ধমান পাচারের স্বর্গরাজ্যগুলোর সঙ্গে কোন চুক্তি নেই। রাষ্ট্রের অর্থ ব্যয়ে বিভিন্ন দেশে সভা সেমিনারে অংশগ্রহণ করে একের পর এক সমঝোতা স্বারক সই করা হলেও টাকা পাচার বন্ধ হচ্ছে না, বরং দিন দিন তা বেড়েই চলেছে।
এ অবস্থা অবশ্যই দেশের জন্য চিন্তার। বিষয়টি নিয়ে নিশ্চয় কাজ করছেন বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ। বাংলাদেশ ব্যাংক, দুর্নীতি দমন কমিশন এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ড একসঙ্গে কাজ করলে অবস্থার পরিবর্তন হবে বলে আশাবাদী সংশ্লিষ্টরা। মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সহযোদ্ধা দেশ ভারতের দুর্নীতি দমন ও টাকা পাচার রোধের মডেল আমরা কাজে লাগাতেই পারি।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)