অযোধ্যায় ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদের ধ্বংসস্তূপের উপর ‘রামমন্দির’ এর শিলান্যাস করেছেন স্বাধীন ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের নামে মন্ত্রগুপ্তির শপথ নেওয়া প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ভারতকে ধর্মনিরপেক্ষতা থেকে আর এস এসীয় হিন্দুত্বে উপনীত করবার একটি বড় রকমের সাফল্য হিসেবে এই ভিতপুজোর ঘটনাটিকে হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তি তুলে ধরতে চাইছে। এই তুলে ধরবার ভিতর দিয়েই তারা আমাদের সহনাগরিক মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষদের জানমাল তো দূরের কথা, তাদের নাগরিকত্বই যে স্বীকার করা হবে না, এটাই প্রচ্ছন্নভাবে দেগে দেওয়া হচ্ছে।কেবল সংখ্যালঘু মুসলমানেরাই নন, সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের হিন্দু, যারা সাম্প্রদায়িকতায় বিশ্বাস করেন না, পরধর্ম বিদ্বেষী নন, বহুত্ববাদী ভারত চেতনাকে বুকে লালন করেন, সেইসব মানুষেরাও যে আগামী দিনে আর এস এসীয় ‘ হিন্দু রাষ্ট্রে’ একদম দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবেই পরিগণিত হবেন, সেই ইঙ্গিতই বাবরি মসজিদের ধ্বংসস্তূপের উপর প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক মন্দিরের ভিত পুজোর ভিতর দিয়ে পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে।
ভাতৃঘাতী দাঙ্গা, দেশভাগ ভারতীয়দের মনে যে ক্ষত তৈরি করেছিল, তার আগে , অখণ্ড ভারতের শেষ পর্যায়ে যে সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতিজনিত সমস্যার সৃষ্টি হয়েছিল, সেই বাতাবরণের ছাপ কিন্তু স্বাধীন ভারতের প্রথম লোকসভার ভোট ১৯৫২ তে তেমন একটা পড়েনি। হিন্দু – মুসলিম উভয় সাম্প্রদায়িক শক্তিই কেবলমাত্র ‘৫২ সালের লোকসভার ভোটেই নয়, ‘৫৭ এবং ‘৬২ র ভোটেও তেমন একটা ভালো ফল করেনি। হিন্দু – মুসলমান- উভয় সাম্প্রদায়িক শক্তির ভোট রাজনীতিতে পিছিয়ে পড়াটাই ভারতের বাম, অবাম সব রাজনৈতিক দলের ভিতরে একটা আত্মতুষ্টির মানসিকতা তৈরি করে দেয়। ভোট রাজনীতিতে পিছিয়ে পড়লেও হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তি যে প্রবল বেগে তাদের সোশাল ইঞ্জিনিয়ারিং চালাচ্ছে, ভারতের অ হিন্দু মহাসভা বা অ জনসঙ্ঘ রাজনৈতিক দল গুলি হয় সেটা বুঝে উঠতে পারেনি। নাহলে হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তির এই সামাজিক প্রযুক্তির আড়ালে রাজনৈতিক শক্তি সংগ্রহের কৌশলটা বুঝে উঠতে পারেনি।
বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, আধুনিক শিক্ষার ফলে সাম্প্রদায়িকতা অচিরেই নখদন্তবিহীন হয়ে যাবে, এই উপলব্ধির ভিতর দিয়ে ভারতের অসাম্প্রদায়িক বুর্জোয়া দলগুলি বা বামপন্থীরা ও সঙ্ঘ পরিবারের ভিতর দিয়ে, সামাজিক প্রযুক্তিকে সমাজের শেকড় পর্যন্ত বিস্তৃত করে, ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারকে যে হিন্দু সাম্প্রদায়িকেরা এই পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারে, এটা উপলব্ধিতেই আনতে পারেনি।বামপন্থীরা আদর্শগতভাবে সবসময়ে সোচ্চার থেকেছে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে। তাদের বিভিন্ন কর্মসূচিতে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে তারা স্পষ্ট অভিমত দিয়েছে। কিন্তু সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রশ্নে রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গেই যে একটা প্রবল সামাজিক আন্দোলন দরকার, এটা বুঝেও , প্রয়োগ জনিত ক্ষেত্রে তারা খুব একটা উদ্যোগী হয়নি।
হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তি তাদের সামাজিক প্রযুক্তি শক্তির পরীক্ষাতে ‘৫২ র লোকসভা ভোটের পর থেকে নানা জায়গাতে দাঙ্গা ঘটিয়েছে। ‘৫৮ সালে গোটা ভারতে বিভিন্ন দাঙ্গাতে মৃতের সংখ্যা ছিল ৭ জন। পরের বছর ই সেটা হয় ৪১ জন। ‘৬১ তে হয় ১০৮ জন। দুই বিড়ি উৎপাদকের ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতা ঘিরে, হিন্দু ব্যবসায়ী হয়ে আর এস এসের প্রত্যক্ষ ভূমিকা স্বাধীন ভারতে প্রথম ভয়ঙ্কর দাঙ্গা ঘটায় জব্বলপুরে ‘৬১ সালে। অবিভক্ত পাকিস্তানে মার্শাল ল’ কে ব্যবহার করে হিন্দু মুসলমানে বিরোধ ঘটানো হয়েছিল ‘৬৪ তে আজকের বাংলাদেশে। আর তারও তিন বছর আগে ভারতে সামাজিক বিভাজনকে তীব্র করতে দাঙ্গা লাগায় আর এস এস, তাদের সেই সময়ের রাজনৈতিক সংগঠন জনসঙ্ঘ।
ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত নেহরু কড়া হাতে পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে জাতীয় সংহতি পরিষদ তৈরি করেন। কিন্তু নেহরুর মত দু একজন হাতে গোনা রাজনৈতিক ছাড়া, সব রাজনৈতিক দলের কাছেই ভোটের দায়ে হাড়ি কাঠে চড়ে সংখ্যালঘু মুসলমানের স্বার্থ। ‘৬১ তে ভারতের লোকসভায় জনসঙ্ঘের ছিল মাত্র ১৪ জন সাংসদ। ‘৬৭ তেই তা দাঁড়াল ৩৫ এ। পশ্চিমবঙ্গের মত রাজ্যে ও বর্ধমান লোকসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনে (‘৬৩) অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টি সমর্থন করল সদ্য হিন্দু মহাসভা ত্যাগী নির্মলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে, যিনি উচ্চবর্ণের হিন্দু অভিজাতের স্বার্থে বাংলাভাগের অন্যতম নায়ক ছিলেন। সামাজিক ক্ষেত্রে মুসলিম বিদ্বেষ ছড়ানোর ক্ষেত্রে যার ভূমিকা সর্বজনবিদিত।
কমিউনিস্ট পার্টি বিভাজনের পর (‘৬৪) , সি পি আই সহ অন্যান্য ভারতীয় অবাম দলগুলি( সি পি আই এম কখনোই নয়) ছয়ের দশকের শেষ দিক থেকেই ভারতের বেশ কিছু রাজ্যে জনসঙ্ঘের সঙ্গে জোট করে অ কংগ্রেসি সরকার চালায়। আবার সি পি আই জনসঙ্ঘের সঙ্গে ক্ষমতা ভাগ করে নিয়ে পাঞ্জাবে গুরনাম সিংয়ের ক্যাবিনেটে অনেককাল থেকেছে।
ভারতের রাজনীতিতে এটা ভাবীকালের কাছে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন এই যে, ইন্দিরা গান্ধী কর্তৃক জরুরি অবস্থা ঘোষণার কারণ হিসেবে আর এস এসের গোটা দেশব্যাপী কর্মকাণ্ডের বিভৎসতার কোনও ইঙ্গিত ছিল কি না। তদানীন্তন গোয়েন্দা প্রধান টি ভি রাজেশ্বর তার ‘ইন্ডিয়া : দি ক্রুসিয়াল ইয়ার্স'( পৃ-৩,৪,৫৭,৭৩-৮০,৮৯-৯৩,১৬৪, ২৩৯) গ্রন্থে এমন কথা খুব খোলাখুলিভাবেই করেছেন।ইন্দিরার জরুরি অবস্থা জারির আগে জয়প্রকাশ নারায়ণের নানা ভাবে ইন্দিরা বিরোধী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে আর এস এসের সংযুক্ত হয়ে পড়া এবং পরবর্তীতে জরুরি অবস্থা বিরোধী আন্দোলনে সি পি আই ( এম) এর আপত্তিকে অগ্রাহ্য করে , সেই আন্দোলনে আর এস এসকে সংযুক্ত করা, কেবল ভারতের জন্যেই নয়, গোটা দক্ষিণ এশিয়ার জন্যেই বিষময় ফল এনে দিয়েছে।
ভারতের বহুত্ববাদী ধারার প্রবাহমানতায় খুব গভীরভাবে দরকার ছিল বিদ্যমান বহুত্ববাদী ধারার পক্ষে রাজনীতির পাশে সামাজিক আন্দোলন।ইন্দিরার মর্মান্তিক মৃত্যুর পর অ বিজেপি দলগুলি প্রথম দিকে সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নকে গুরুত্বই দেয়নি। রাজীব গান্ধী বাবরি মসজিদের তালা খুলে ‘৪৯ এর ডিসেম্বরে আর এস এস কর্তৃক মসজিদে অনুপ্রবেশ করানো ধাতুমূর্তির পুজোর অনুমতি দিয়ে ভারতকে একদম ধ্বংসের পথে ঠেলে দিয়েছিলেন। আর ভি পি সিং সরকারের অন্যতম ক্রাচ হয়ে বিজেপির সঙ্গে বামেদের ট্রেজারি বেঞ্চে বসার ও বিষময় ফল ঘটেছে।
দশরথনন্দন রামকে ঘিরে ভারতের একটা বড় অংশের মানুষের ভাবাবেগকে নিজেদের সঙ্কীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থে কাজে লাগিয়েছে হিন্দু সাম্প্রদায়িকেরা। অবিজেপি দলগুলি সেই রামকেই কিভাবে বিজেপির দিক থেকে নিজেদের শিবিরে টেনে আনা যায়, এই প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত থেকে সাম্প্রদায়িকতার ঢাকেই কাঠি দিয়েছে।আর বামপন্থীরা ভাববাদ আর বস্তুবাদের কচকচিতেই ‘রাম’ ইস্যুতে বাস্তব রাজনীতি থেকে দূরে সরে গেছে। ‘রাম’ নামে কোনো ইতিহাস সম্মত চরিত্র ছিলেন না- বামেদের এই প্রচার গোটা ধর্মনিরপেক্ষ শিবিরকেই নাস্তিক বলে দেখিয়ে, নিজেদের আর ও সুবিধা করে নিয়েছে হিন্দু সাম্প্রদায়িক শিবির।
গত ৫ আগস্ট মুজফফর আহমদের জন্মদিনে অনলবর্ষী বামপন্থী নেতা মহঃ সেলিম তার বক্তৃতায় যোদ্ধা রাম নয়, সীতাপতি রাম, লক্ষণের সঙ্গে ভাতৃবৎসল রামকে মানুষের ভালোলাগার কথা বলেছেন। আর এস এস- বিজেপি সংখ্যাগুরুর আধিপত্যপাদ প্রতিষ্ঠায় চায় ধনুর্ধারী , যোদ্ধা রামকে। আর আপামর দেশবাসী চায় পত্নী বৎসল, ভাতৃবৎসল, প্রজাবৎসল রামকে। এই রামকে চাওয়ার পিছনে কোনো হিন্দু – মুসলমান নেই। ধনী – দরিদ্র নেই। উঁচুজাত- নীচুজাত নেই– সেলিমের ভারতাত্মার মর্মমূল থেকে উঠে আসা এই অনুধ্যানই পারে সংখ্যাগুরুর আধিপত্যের হাত থেকে ভারতকে বাঁচাতে। পারে সংখ্যালঘুর স্বাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে। নেহরু, মৌলানা আজাদ, জ্যোতি বাবুর পর স্বাধীন ভারতে সেলিমের মত এমন বাস্তববাদী ভাবনা আর কেউ ভাবেননি।
এই ধরণের ধর্মনিরপেক্ষ, বাস্তববাদী নেতা যদি ভারতের রাজনীতির হাল না ধরেন, ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলির , বিশেষ করে কমিউনিস্ট পার্টির সার্বিক নেতৃত্বে না আসে, তাহলে নরম সাম্প্রদায়িকদের আধিপত্য ভারতের রাজনীতিতে বৃদ্ধি পাবে। সেই পরিস্থিতি অচিরেই আর এস এস – বিজেপিকেই প্রকারান্তে শক্তি যোগাবে। ফলে বাংলাদেশসহ গোটা দক্ষিণ এশিয়াতে সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শক্তির দাপট ভয়ঙ্কর রকম বৃদ্ধি পাবে।বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষ শেখ হাসিনার নেতৃত্ব যেমন ভারতে কোণঠাসা ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির কাছে লড়াই এবং প্রতিরোধের একটি বড় শক্তি, তেমনই ভারতে ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির নেতৃত্বে যদি সেলিমের মত মানুষের আরও অনেক বেশি গুরুত্বসহকারে প্রতিষ্ঠিত হন, তা একদিকে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ , গণতন্ত্র প্রিয় মানুষদের কাছে ইতিবাচক হবে, অপরদিকে বাংলাদেশেও ধর্মনিরপেক্ষ , গণতান্ত্রিক শক্তির ধর্মান্ধতা, মৌলবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ক্ষেত্রে বিশেষ অনুঘটকের ভূমিকা পালনকারী একটি বিষয় হিসেবেই পরিগণিত হবে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)