ভারতের টেলিকম কোম্পানি এয়ারটেল, রিলায়েন্স কমিউনিকেশন্স (আরকম) এবং ভোডাফোনের বকেয়া থাকা হাজার কোটি ডলার আদায়ে অতিরিক্ত সময় দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে দেশটির উচ্চ আদালত। এই অবস্থায় যুক্তরাজ্য ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ভোডাফোন তাদের ব্যবসা গুটিয়ে নিতে পারে এমন সংশয় তৈরি হয়েছে ভারতে।
এই বিষয়ে বিবিসির প্রতিবেদক অরুণোদয় মুখার্জি ব্যাখ্যা করেছেন যে, এটি পুরো টেলিকম ইন্ডাস্ট্রির অস্তিত্বের জন্য আঘাত হতে পারে।
ভারত বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম টেলিকম বাজারগুলির মধ্যে অন্যতম একটি, তবে এর প্রধান প্রতিষ্ঠানগুলো সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অনেক দুর্দশাগ্রস্থ সময়ের মুখোমুখি হয়েছে। এখন দেশটির শীর্ষ আদালত কর্তৃক ১৭ মার্চের মধ্যে টেলিকম কোম্পানিগুলোকে ১৩ বিলিয়ন ডলার আদায়ের নির্দেশনা দেয়ার ফলে তাদের সেই দুর্দশাগ্রস্থ সময় আরও দীর্ঘ হলো।
টেলিকম কোম্পানিগুলোর মধ্যে ভোডাফোন আইডিয়া-দেশটির অন্যতম বৃহত্তম। ভোডাফোন আইডিয়ার জন্য এই আদালতের আদেশটি আরও কঠিন সময় উপস্থিত করেছে। প্রতিষ্ঠানটি গত সপ্তাহের একই সময়ে ৯০৩ মিলিয়ন ডলার লোকসানের ঘোষণা দিয়েছে যা, গত বছর একই সময়ে ছিলো ৭০ মিলিয়ন ডলার।
পরিস্থিতি এতোটাই খারাপ যে, সংস্থাটির চেয়ারম্যান কুমার মঙ্গলম বিড়লা সরকার বা আদালত থেকে কোনো সহযোগিতা না পেলে ভারত থেকে তাদের ব্যবসা বন্ধ করে দিতে হতে পারে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। প্রতিদ্বন্দ্বী এয়ারটেলের সঙ্গে ভোডাফোন যখন তাদের ঋণ পরিশোধের জন্য আরও সময় প্রত্যাশা করছিলো, তখন এমন আদেশ তাদের জন্য গভীরে তলিয়ে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি করেছে। প্রশ্নটি হলো ১৭মার্চ এর বকেয়া আদায়ের সময়সীমা নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো হস্তক্ষেপ বা সহযোগিতা না আসলে তবে কি ভোডাফোন ভারতে তাদের ব্যবসা শেষ করে দেবে?
বিবিসি বলছে, যুক্তরাজ্য ভিত্তিক টেলিকম কোম্পানিটি ভারতীয় বাজারে অন্যতম প্রবীণ এবং বৃহত্তম। সর্বোপরি এর রয়েছে ৩০০ মিলিয়নেরও বেশি গ্রাহক এবং কয়েক লক্ষ লোকের কর্মসংস্থান করে এই প্রতিষ্ঠান। ভারতের টেলিকম ব্যবসার ২৯ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে প্রতিষ্ঠানটি। এমতাবস্থায় হঠাৎ করে এটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরিবেশ তৈরি হলে তা তুচ্ছভাবে দেখা যাবে না। এর ফলে পুরো টেলিকম সেক্টরে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে।
এই অবস্থা তৈরি হলে ভারতে এয়ারটেল ও রিল্যায়েন্স জিও টিকে থাকবে। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোনো বাজারে মাত্র দুটি কোম্পানি থাকলে তা গ্রাহকদের ইতিবাচক কোনো সংবাদ নয়। তাছাড়া বছরের শেষ প্রান্তিকে এসে প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলার লোকসান করে এয়ারটেল এবং সরকারের কাছে ৫ বিলিয়ন ডলার বকেয়া রয়েছে। এয়ারটেলও খুব ভালো অবস্থানে নেই। সেদিক থেকে দেশের টেলিকম সেক্টরে সর্বাধিক নতুন প্রবেশকারী জিও অনেক বেশি সুখকর জায়গায় রয়েছে।
কারণটি হচ্ছে, ভারতে বহু বছর যাবত টেলিফোন কলের রেট নিম্নগামী। অন্যদিকে টেলিফোন ডাটার দাম ছিল বেশি। কিন্তু তিন বছর আগে রিলায়েন্সের জিও মোবাইল নেটওয়ার্ক বাজারে আসার পর পরিস্থিতি সম্পূর্ণ পাল্টে যায়। এ কোম্পানিটি মোবাইল ডাটার দাম কমিয়ে দেয়। ফলে গ্রাহকরা টেলিফোনে কথা বলে খরচ করার চেয়ে ডাটা ব্যবহারে বেশি মনোযোগী। পরস্পরের সাথে যোগাযোগের জন্য ইন্টারনেট-ভিত্তিক বিভিন্ন অ্যাপ ব্যবহার করতে থাকে। রিলায়েন্সের এ পদক্ষেপ অন্য কোম্পানিগুলোর উপর অনেক চাপ তৈরি করে। তাদের সাথে তাল মিলিয়ে অন্য কোম্পানিগুলোও তাদের মোবাইল ডাটার দাম কমিয়ে দিতে বাধ্য হয়। ফলে তাদের লাভ কমে লোকসানের দিকে যাত্রা শুরু হয়।
তারপর থেকে ভোডাফোন ও এয়ারটেল কয়েক মিলিয়ন গ্রাহক হারায়। তাদের ১০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি যৌথ লোকসান হয় এবং তারা এখন আগামী মাসের মধ্যে সরকারের বকেয়া আদায়ের দ্বারপ্রান্তে ঝুলছে।
২০১৯ সালের হিসাবে ভোডাফোন থেকে ৩৫০ মিলিয়নেরও বেশি গ্রাহকের প্রস্থান থেকে জিও উপকৃত হয়। বিশেষজ্ঞরা অনুমান করেছেন যে, এটি ২০২২ সালের মধ্যে এর উপার্জন ভালভাবে দ্বিগুণ হতে পারে এবং ৫০০ মিলিয়ন এর বেশি গ্রাহককে সাইন ইন করাতে পারে।
অর্থনীতিবিদ বিবেক কৌল বিবিসিকে বলছিলেন, মূল্য বাড়ানো অগত্য কোনো মন্দ বিষয় নয়, এটি আসলে ভালো ব্যাপার। কারণ এই বাজারে কিছুটা প্রতিযোগিতা করার একমাত্র উপায় এটি। ভারতে টেলিকমগুলি টিকে থাকা ও উন্নতি সাধনের জন্য এটি হওয়া দরকার।
টেলিকম সংস্থাগুলি এবং সরকার কী লড়াই করছে?
সরকারের সাথে মোবাইল কোম্পানিগুলোর লাভ সমন্বয় নিয়ে তৈরি হওয়া দ্বন্দ্ব। টেলিকম কোম্পানিগুলো যা আয় করে তার একটি নির্দিষ্ট অংশ সরকারের টেলিকম ডিপার্টমেন্টকে দিতে হয়। এনিয়ে টেলিকম কোম্পানিগুলো এবং সরকারের মধ্য ২০০৫ সাল থেকেই মতবিরোধ চলছিল।
কোম্পানিগুলো চেয়েছিল যে তাদের লভ্যাংশ থেকে সরকারকে দিতে। কিন্তু সরকার এর চেয়েও বেশি চেয়েছে। অর্থাৎ কোম্পানিগুলোর সম্পদ বিক্রি এবং জমানো অর্থের সুদের উপরও অংশ দাবি কর সরকার।
সম্প্রতি ভারতের সুপ্রিম কোর্ট বিষয়টি নিয়ে সরকারের পক্ষে রায় দিয়েছে। যা ভোডাফোন ও এয়ারটেল এর মতো কোম্পানির জন্য বড় রকমের ঝুঁকি।