ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদের ধ্বংসস্তুপের উপর তথাকথিত রামমন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করলেন ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের নামে মন্ত্রগুপ্তির শপথ নেওয়া ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে অবিজেপি, অবাম রাজনৈতিক দলগুলির যে আচরণ দেখা যাচ্ছে, তাতে এই আশঙ্কাই তীব্র হয়ে উঠছে যে, ভারতের অবামপন্থী সব রাজনৈতিক দলগুলি’ই কি আরএসএস-বিজেপির উগ্র হিন্দুত্বের মোকাবিলাতে ধর্মনিরপেক্ষতার পরিবর্তে এখন থেকে নরম হিন্দুত্বের পথে হাঁটতে শুরু করল? কংগ্রেস, মোদিকে ভিত পুজোর একমাত্র ভাগীদার হতে দিতে রাজি নয়। তাঁদের দাবি, রাজীব গান্ধী প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন এই ভিত পুজো করেছিলেন।
কংগ্রেসের এই দাবির প্রেক্ষিতে ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ধ্বংস ঘিরে বহু অপ্রিয় প্রশ্ন আবার সামনে চলে আসে। রাজীব গান্ধীর অসচেতন রাজনৈতিকবোধই যে সাম্প্রতিক ভারতে বাবরি মসজিদ সংক্রান্ত যাবতীয় সমস্যার মূল উৎসভূমি , আপামর ধর্মনিরপেক্ষ সমাজের এই অভিযোগ, রাজীবকে বাবরি মসজিদের ভিতরে প্রথম রামমন্দিরের ভিতপূজক হিশেবে কংগ্রেসের দাবির ভিতর দিয়ে কার্যত প্রতিষ্ঠা দেওয়া হয়েছে। ইন্দিরার প্রধানমন্ত্রীত্বের প্রায় অন্তিমলগ্নে গোটা হিন্দুত্ববাদী শিবির একটি তথাকথিত ধর্মসংসদ করেছিল। সেখানে তারা বাবরি মসজিদেই তথাকথিত রামমন্দির তৈরির কথা জোরদার ভাবে ঘোষণা করে।
আরএসএস-বিজেপির ছত্রছায়াতে থাকা তথাকথিত সাধুসন্তদের ইন্দিরার জীবনের প্রায় শেষ পর্বে(‘৮৪ সালের সেপ্টেম্বরে) এই ধর্মসংসদ ছিল কার্যত বিজেপির হয়ে লোকসভা ভোটের প্রস্তুতি। এর অব্যবহিত পরেই শ্রীমতী গান্ধীর মর্মান্তিক হত্যাকান্ড। ইন্দিরা আবেগে কংগ্রেসের অভূতপূর্ব জয়। এই ব্যাপক জয় তো দূরের কথা, ইন্দিরা জীবিত থাকলে, কংগ্রেস আবার ক্ষমতায় ফিরে আসতে পারত কিনা- এমন রাজনৈতিক পরিস্থিতিই তখন গোটা ভারতব্যাপী তৈরি হয়েছিল।
‘৮০ তে ইন্দিরা ক্ষমতায় ফিরে এসে জরুরি অবস্থার মত প্রত্যক্ষ আধা ফ্যাসিবাদী সন্ত্রাসী মূর্তি ধারণ না করলেও , তাঁর স্বৈরাচারী মানসিকতাকে একমুহূর্তের জন্যে বিসর্জন দেন নি। এইসময়ে গোটা ভারতেই ধীরে ধীরে কংগ্রেসের ভিত আলগা হতে শুরু করেছিল। ইন্দিরা জনতা পার্টির আভ্যন্তরীণ সঙ্কটে, বিশেষ করে বিজেপির পূর্বসূরি, জনসঙ্ঘীদের ‘দ্বৈত সদস্যপদে’র ইস্যু জনিত সঙ্কটের ফলে কেন্দ্রে ক্ষমতায় ফিরে আসতে পেরেছিলেন। কিন্তু বহু রাজ্যেই কংগ্রেস ছিল ক্ষমতার বাইরে। সেইসব রাজ্যগুলির উপর ভয়াবহ অর্থনৈতিক অবরোধ চালিয়েছিলেন ইন্দিরা। ক্ষমতা কুক্ষিগত করবার একটা ভিন্নকৌশল ইন্দিরা তাঁর এই শেষ দফার প্রধামন্ত্রীত্বে দেখিয়েছিলেন।
ইন্দিরার এই স্বৈরাচারী মানসিকতার, ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণের দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিবাদে পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর নেতৃত্বে, ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের অকংগ্রেসী মুখ্যমন্ত্রীদের ভিতর একটি অভূতপূর্ব ঐক্য তৈরি হয়েছিল।এই ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের জেরে, কেন্দ্র- রাজ্য ক্ষমতা পুনর্বন্টনের ইস্যু পর্যালোচনা করতে শ্রীমতী গান্ধী বিচারপতি সারকারিয়ার নেতৃত্বে একটি কমিশন পর্যন্ত গঠন করতে বাধ্য হয়েছিলেন।
জ্যোতি বসুর নেতৃত্বে গোটা দেশে এই যে অকংগ্রেসী, অবিজেপি একটি ধর্মনিরপেক্ষ মঞ্চ তৈরি হয়েছিল, তার সামগ্রিক রাজনৈতিক কর্মকান্ডে আরএসএস-বিজেপির সাম্প্রদায়িক কর্মসূচিগুলো গোপনে রূপায়িত হলেও, সেগুলির প্রকাশ্য চর্চা প্রায় দেখতেই পাওয়া যেত না।সঙ্ঘের সামাজিক প্রযুক্তির কাজ জোর কদমে চললেও, সেই কাজকে রাজনৈতিক পরিমন্ডলে আনার মত ক্ষমতা তখন বিজেপির এই কারণে হয় নি যে, শাসক কংগ্রেসের অর্থনৈতিক এবং ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণের প্রতিবাদে কমিউনিষ্ট জ্যোতি বসু, যেভাবে গোটা দেশের বিভিন্ন প্রান্তের অকংগ্রেসী, অবিজেপি মুখ্যমন্ত্রীদের সমবেত করে, সেইসব রাজ্যগুলিতে একটা প্রবল কেন্দ্র বিরোধী আন্দোলনের পটভূমিকা তৈরি করতে পেরৃছিলেন, তার জেরে, বিজেপি তাদের রাজনৈতিক, সাম্প্রদায়িক আগ্রাসনগুলিকে প্রকাশ্যে সেভাবে ফলপ্রসু করতে পারছিল না।
রাজীব গান্ধী তাঁর মায়ের দুঃখজনক মৃত্যুঘিরে ক্ষমতার মদমত্তাতায় এমন একটা জায়গায় পৌঁছেছিলেন যে, তিনি তাঁর দলের প্রবীণ নেতাদের কোনো পরামর্শকে পর্যন্ত কার্যত কানে তুলতেন না। অমিতাভ বচ্চন, অরুণ নেহরু, অরুণ সিংয়ের মত অনভিজ্ঞ লোকেরাই ছিলেন ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর একমাত্র নির্ভরযোগ্য পরামর্শদাতা। এই সময়ে রাজীব শাহবানু মামলাকে কেন্দ্র করে মুসলিম মৌলবাদের সঙ্গে আপোষ করেন,’মুসলিম নারী অধিকার রক্ষা বিল’ নিয়ে এসে।অপরপক্ষে কার্যত কোনঠাসা(কারণ, তখন সংসদে মাত্র দুইজন বিজেপি সাংসদ) হিন্দু মৌলবাদের সঙ্গে আপোষ করেন ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদের তালা খুলে দিয়ে, পবিত্র মসজিদের অভ্যন্তরে ‘৪৯ সালে হিন্দু মৌলবাদীদের দ্বারা অনুপ্রবেশ ঘটানো একটি ধাতু মূর্তিকে ‘রামলালা’ হিসেবে ভজন পূজনের অনুমতি দিয়ে।
বাবরি মসজিদকে ঘিরে ভারতের স্বাধীনতার পর থেকেই হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তি নানাভাবে সমস্যা তৈরি করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু নেহরু থেকে ইন্দিরা, বিভিন্ন পর্যায়ে যাঁরা ভারতের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন, দলের চাপে অনেক সময়ে দৃঢ় অবস্থান দেখাতে না পারলেও , বাবরি মসজিদের অভ্রান্ততা ঘিরে তারা কখনো সংশয়ী ছিলেন না। বল্লভভাই প্যাটেলের সহযোগী গোবিন্দবল্লভ পন্থ উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন ‘ ৪৯ সালে একাংশের প্রশাসনঘনিষ্ঠদের সাহায্যে আর এস এস, বাবরি মসজিদের ভিতরে ওই ধাতু মূর্তির অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছিল। ডঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণাণের পুত্র সর্বপল্লী গোপাল সম্পাদিত গ্রন্থ, ‘ অ্যানাটমি অফ কনফ্রনটেশন’ গ্রন্থে সেই সময়ের উত্তরপ্রদেশ প্রশাসন, যা ছিল কার্যত নেহরু বিরোধী প্যাটেলপন্থী উগ্র হিন্দু সাম্প্রদায়িক, তাদের সঙ্গে এই মসজিদের ভিতরে আর এস এসের এই ধাতুমূর্তি ফেলে যাওয়ার বোঝাপড়ার পূর্ণাঙ্গ তথ্যনিষ্ঠ প্রমাণ আছে।
ফৈজাবাদের তৎকালীন জেলাশাসক কে কে নায়ারকে প্রধানমন্ত্রী নেহরুরর চাপে মূর্তি বের করে দেওয়ার আদেশ গোবিন্দবল্লভ পন্থ দিলেও , নায়ার সেই আদেশ কার্যত পন্থের অঙ্গুলি হেলনে অস্বীকার করেছিলেন।এই নায়ার ছিলেন পুরোপুরি আর এস এসের লোক।’৬৫ সালে তিনি উত্তরপ্রদেশ বিধানসভায় জনসঙ্ঘের বিধায়ক ছিলেন। ‘৬৭ সালে তিনি আর এস এসের তৎকালীন রাজনৈতিক সংগঠন জনসঙ্ঘের টিকিটে লোকসভার সদস্য হয়েছিলেন। নায়ারপত্নী শকুন্তলা নায়ার ‘৫২ সালে উত্তরপ্রদেশের ‘ গোন্দা’ কেন্দ্র থেকে সঙ্ঘের অপর রাজনৈতিক সংগঠন, প্রত্যক্ষভাবে গান্ধী হত্যার সঙ্গে যুক্ত হিন্দু মহাসভার টিকিটে লোকসভার সদস্যা হয়েছিলেন।
‘৪৯ সালে মসজিদের ভিতরে ধাতু মূর্তি রেখে যাওয়ার ঘটনার তুমুল বিরুদ্ধতা করেও সেটিকে মসজিদ চত্ত্বর থেকে নিস্ক্রাসিত করতে পারেন নি নেহরু মূলত বল্লভভাই প্যাটেল ও তাঁর সহযোগীদের হিন্দু সাম্প্রদায়িক মানসিকতার জন্যে।প্যাটেলের মৃত্যুর পর(‘ ৫০) বাবরি মসজিদ ঘিরে ঘরে বাইরে কোনো সাম্প্রদায়িক শক্তিকেই এতোটুকু মাথা তুলতে দেন নি নেহরু।ইন্দিরা , তাঁর বহু রাজনৈতিক সীমাবদ্ধতা স্বত্ত্বেও বাবরি মসজিদ ঘিরে এমন কিছু করেন নি, যাতে কোনো অংশের সাম্প্রদায়িক শক্তি উৎসাহিত হতে পারে।
মাতামহ নেহরু, মা ইন্দিরার রাজনৈতিক বিন্দুবিসর্গ ও রাজীবের ছিল না।ফলে শাহবানু মামলা ঘিরে দেশের উত্তাল পরিবেশ ,বোরফর্স দুর্নীতি ঘিরে সরাসরি তাঁর এবং তাঁর পরিবারপরিজনেদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের মোকাবিলা করতেই রাজীব খুশি করতে চেয়েছিলেন হিন্দু সাম্প্রদায়িকদের।তাই মসজিদের তালা খুলে দেওয়ার অনুমতি।সেই কারন থেকেই একটি মসজিদের ভিতর অপর ধর্মের এক বিতর্কিত ধাতুমূর্তির ভজনপূজনের অনুমতি।বস্তুত রাজীব যদি সেদিন বাবরি মসজিদের তালা না খুলে দিতেন, তথাকথিত ‘ রামলালা’ র পুজোর অনুমতি না দিতেন, তাহলে পবিত্র মসজিদ ভাঙতে এতোখানি তৎপর হতে পারত না হিন্দু সাম্প্রদায়ীক, মৌলবাদী শিবির।রাজীব বোফর্স দুর্নীতি থেকে বাঁচতে, দেশের ধর্মনিরপেক্ষতাকে বাজি রেখেছিলেন।
বাবরি মসজিদকে রক্ষা করে ভারতের সংবিধান, ভারতের চিরপ্রবাহমান ধর্মনিরপেক্ষতার ধারাকে সঞ্জীবিত রাখতে রাজীব থেকে নরসিংহ রাও কেউ যে যত্নশীল ছিলেন না, তাই ই নয়, এঁরা যে মানসিক ভাবে চেয়েছিলেন বাবরি মসজিদ ধ্বংসপ্রাপ্ত হোক , আর সেই ধ্বংসস্তুপের উপর তথাকথিত ‘ রামমন্দির ‘ গড়ে উঠুক, তা এখন রাজীব তনয়া প্রিয়াঙ্কা থেকে শুরু করে প্রথম সারির কংগ্রেস নেতা কমলনাথের প্রকাশ্য বক্তব্য থেকে জলের মত পরিস্কার। বাবরি ধ্বংসের দিন, যে কোনো মূলে এই ধ্বংস রোখার আর্জি নিয়ে জ্যোতি বসু , ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাও কে ফোন করেছিলেন।রাও সেই ফোন ধরেন নি। কেন রাও সেই ফোন ধরেন নি, তা আজ যখন কংগ্রেস দলের পক্ষ থেকে রাজীব গান্ধীকে রামমন্দিরের প্রকৃত ভিতপূজক হিসেবে দাবি করা হয়, তখন ই পরিস্কার হয়ে যায়।
এই বিষয়টি পরিস্কার হওয়ার সাথে সাথে যে প্রশ্নটি সবথেকে বড় হয়ে ওঠে সেটি হল, তাহলে কেন ভারতের অবিজেপি, অবাম রাজনৈতিক দলগুলি ভারতের সংখ্যালঘু মুসলমানদের সঙ্গে এই ছলনা করে আসছিলেন? বাবরি মসজিদের ধ্বংসস্তুপের উপর মন্দিরের ভিতপুজোকে ঘিরে উত্তরপ্রদেশের বিভিন্ন সময়ের মুখ্যমন্ত্রী মায়াবতী থেকে অখিলেশ যাদব, কার্যত ইতিবাচক বিবৃতি দিয়েছেন। প্রশ্ন এটাই যে, মুসলমান সমাজের অধিকারের কথা, দলিত সমাজের অধিকারের কথা তাহলে কি এইসব নেতারা এতকাল কেফল ভোট রাজনীতির জন্যেই করেছেন? নিছক ভোট কমোডিটি হিসেবেই তাঁরা দেখেছেন মুসলমানদের?
অখিলেশের মুখ্যমন্ত্রীত্বকালে উত্তরপ্রদেশের মুজফফরনগরে ভয়াবহ দাঙ্গা করে আরএসএস-বিজেপি। বস্তুত সেই দাঙ্গাজনিত সামাজিক মেরুকরণ’ই ছিল ২০১৪ সালের লোকসভার ভোটে বিজেপির একক ক্ষমতায় জেতার অন্যতম চাবিকাঠি। সেই সময়ের উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ দাঙ্গাকারীদের ক্ষেত্রে একদম নরম মনোভাব নিয়েছিলেন। কেন্দ্রে তখন দ্বিতীয় দফার মনমোহন সিংয়ের সরকার। সেই সরকার ও দাঙ্গাকারীদের ঘিরে এতোটুকু দৃঢ় মানসিকতা দেখায় নি।
আজ, বাবরি মসজিদের ধ্বংসস্তুপের উপর তথাকথিত মন্দিরের শিলান্যাসের পর কংগ্রেস, সমাজবাদী পার্টি, বহুজন সমাজ পার্টির শীর্ষ নেতা নেত্রীদের ভিতর যেভাবে ধরম হিন্দুত্ব, একদম গরম হিন্দুত্বে পর্যবসিত হতে আমরা দেখলাম, তাতে করে মনে হয়, মুজফফরনগরের দাঙ্গার ভিতর দিয়ে গোটা উত্তর ভারতের সমাজজীবনকে হিন্দু মুসলমানে আড়াআড়িভাবে ভাগ করে দিয়ে, বিজেপিকে ২০১৪ র ভোটে জেতানোটা ছিল,’মহা বন্দোবস্তি’র একটা ভানুমতির খেল।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)