পাঠশালা নামে দেড় যুগ আগের অবৈধ প্রতিষ্ঠানটি বৈধতা পায় ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে নির্বাচিত সরকারের কাছ থেকে। শুধু তাই নয়, এই প্রতিষ্ঠানটি সরকারের কাছ থেকে জমি পেয়েছে, অনুদান নিয়েছে আরও কত কী! এই পাঠশালা প্রতিষ্ঠানের মালিকপক্ষের নাম কী? হয়তো জানেন না, কিংবা জেনেও স্বীকার করতে চাইবেন না।
পাঠশালা প্রতিষ্ঠানের মালিকপক্ষ হলো দৃক গ্যালারী, অর্থাৎ ফটোগ্রাফার শহিদুল আলম, যিনি গত ৫ আগস্ট কাতারভিত্তিক গণমাধ্যম আল জাজিরার প্রশ্নের উত্তরে ‘এই সরকার অবৈধ, এই সরকার অনির্বাচিত’ শব্দসহ নানা ‘সমস্যাগুলো’ তুলে ধরেছেন। এখন স্বাভাবিক নিয়মেই যদি প্রশ্ন করি, যে ব্যক্তির চোখে মননে মগজে অর্থাৎ শহিদুল আলম যদি বিশ্বাস করেন ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি জন্ম নেওয়া সরকার টোটাল অবৈধ, নন ইলেক্টেডসহ আরো নানান অভিযোগে অভিযুক্ত, তাহলে কোন যুক্তি বা লজিকে জনাব শহিদুল আলম একটা অবৈধ সরকারের কাছ থেকে নিজের প্রতিষ্ঠানের বৈধতার সার্টিফিকেট, জমি বরাদ্দ, আর্থিক অনুদান নিয়েছিলেন? আর নিলেও সেই দেড় যুগ আগের প্রতিষ্ঠানটি তাহলে এখন কিভাবে বৈধতা পেল? আর তিনি (শহিদুল আলম) কিভাবে নিজেকে বৈধ প্রতিষ্ঠানের মালিক হিসেবে দাবি করার যোগ্যতা রাখেন?
এসব ছোট ছোট প্রশ্নগুলোর অবশ্যই বড় উত্তর পাওয়ার দরকার আছে। কারণ, আপনি মুখে দেখাবেন নীতির জাহাজের ক্যাপ্টেন্সির দারুণ গল্প, আর ব্যক্তিগত সামান্য কিছু স্বার্থ আদায়ের জন্য গোপনে অবৈধদের সাথে থাকবেন, তা হয় না। সেজন্য জনাব শহিদুল আলম ভক্তদের উত্তর দিতেই হবে।
বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা বা বিরোধিতা করতে হবে বলেই বিরোধিতা করছি, এই নীতির বিরুদ্ধে আমার মতবাদ। জনাব শহিদুল আলম কার নাতি, কার ছেলে, অথবা কার সাথে তার পিতা-মাতার ছবি আছে, এসব প্রশ্ন চাওয়া ও পাওয়া কিংবা ডিফেন্সে তুলে ধরা উভয় পক্ষের কেউ নই আমি।
তবে একটা জায়গা থেকে না বললেই নয়। আপনি নিশ্চয়ই ডেভিড বার্গম্যানের নাম শুনেছেন। বার্গম্যান প্রখ্যাত আইনজীবী ড. কামালের মেয়ে ব্যারিস্টার সারা হোসেনের স্বামী। ব্রিটিশ নাগরিক ডেভিড বার্গম্যান। বার্গম্যান যখন বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বিতর্কিত করার মাধ্যমে চাপ তৈরি করে বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ করার জন্য ‘চুক্তিবদ্ধ’ হন, তখন থেকে এদেশে ডেভিড বার্গম্যানের পেছনে ২৩ জনের একটা ক্লাস বেইজড সহযোগী টিম অন্তরালে ছিল। বিভিন্ন তথ্য, বক্তব্য, বিবৃতি বা অন্যান্য সহযোগিতা করত তারা। উল্লেখ্য যে, এরাও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাইতো। সেটার ধরণ ছিল ‘তবে, কিন্তু, অথবা’ টাইপ। সেই ২৩ জনের ১ জন ছিলেন জনাব শহিদুল আলম। এমনকি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় নিয়ে মন্তব্যের কারণে যখন ডেভিড বার্গম্যানের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনাল অবমাননার অভিযোগ উঠে, তখন বার্গম্যানের জন্য বিবৃতি দাতা ৪৯ জনের অনেকে নিজেদের বক্তব্য প্রত্যাহার করে নিলেও শেষ পর্যন্ত সেই ২৩ জন ছিলেন, সাথে ছিলেন জনাব শহিদুল আলম। এছাড়া শহিদুল আলম ট্রাইব্যুনাল অবমাননার রায়ে সাজাও খেটেছিলেন।
এখন প্রশ্ন হলো- এ রকম একটা বিতর্কিত লোককে সরকারের কোন স্তরের কোন মন্ত্রী, এমপি বা কর্মকর্তা সহযোগিতা করেছিলেন পাঠশালা নামের প্রতিষ্ঠানের বৈধতা পেতে, প্রতিষ্ঠানের স্থায়ী ভবনের জন্য জমি পেতে, প্রতিষ্ঠানের এগিয়ে চলার জন্য সরকারী অনুদান পেতে? জেনে শুনে বিতর্কিত ব্যক্তিকে সুবিধা দেওয়ার সাথে জড়িত এবং আজকের শহিদুলের জন্য ব্যবস্থা করে দেওয়া সরকারের সেই মন্ত্রী, এমপি বা সরকারী কর্মকর্তারা কেন দায়ী হবে না ?
অনেককে বলতে শুনি, শহিদুল আলম কী ভুল বলেছেন? তাদের কাছে আমার প্রশ্ন, এই গ্রহের অনেক দেশেই বাংলাদেশ থেকে খারাপ নির্বাচনের সরকার চলমান আছে। সেসব দেশের সরকার প্রধান যদি আমাদের দেশে বসবাস করা কোনো না কোনো মহলের কাছে চরমভাবে ‘রিয়েল হিরো’, বা ‘জনতার নেতা’ বলে আখ্যা পেতে পারেন, তাহলে আমাদের দেশের সরকার ঠিক তাদের চোখেই কিভাবে নন ইলেক্টেড বা অবৈধ হয়? যেখানে আমাদের দেশে গণতান্ত্রিক একটা নির্বাচন হয়েছে, নির্বাচনে একটা দল আসেনি, সেটার দায় কেন বহন করতে হবে যারা নির্বাচিত হয়েছিল তাদেরকে?
সাংবিধানিকভাবে পুরোপুরি একটা বৈধ সরকারকে যখন একজন ব্যক্তি আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় ‘অবৈধ, নন ইলেক্টেড সরকার’ বলে দায়ী করে বক্তব্য দেন, তখন স্বাভাবিক কারণেই প্রশ্ন এসে যায়, এটা কিভাবে বাকস্বাধীনতা প্রকাশের পর্যায়ে পড়ে? তাছাড়া সড়ক দুর্ঘটনায় একটা পক্ষ হলো বাস মালিক পক্ষ আরেকটা পক্ষ ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষ। সেখানে বরাবরই মধ্যস্থতাকারী তৃতীয় পক্ষ হিসেবে সরকার কাজ করে। তাহলে এই দুর্ঘটনার দায় সরকারের ওপর কেন চাপিয়ে দিতে হবে? এটা কেমন বাকস্বাধীনতার পর্যায়ে পড়ে? যারা দ্বিমত করছেন বা করবেন তাদেরকে বলবো এখনই বাংলাদেশের কোনো না কোনো মিডিয়া সাংবাদিককে বলুন তুরস্ক, রাশিয়া, মিডল ইষ্টের যেকোনো দেশের সুশীল বা সাংবাদিককে ফোন দিয়ে তাদের দেশের সমসাময়িক সমস্যা ধরে প্রশ্ন করতে, সেখানে তারা তাদের দেশের সমস্যা ও সমাধানের কথা বলবে নাকি সরকারকে অবৈধ বা নন ইলেক্টেড বলে বাকস্বাধীনতা প্রকাশ করবে? জিজ্ঞেস করে দেখুন, তখন উত্তরে কী বলে সেটা জানার চেষ্টা করুন। আর উত্তর শুনে অবশ্যই বুঝে যেতে পারবেন আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় কথা বলার লজিক বা থিওরিটা কী। অবশ্যই নিজের দেশের ইজ্জত নিলামে তোলার থিওরি বা লজিককে তারা বৈধতা দিবে না। এটাই হলো বাস্তবতা। অন্তত মিনিমাম দেশপ্রেমিক পাগলেও এটা বুঝে।
এই লেখায় দালালীর লজিক খোঁজার লোকের অভাব হবে না। বলছি তাতে কিচ্ছু যায় আসে না। মোটেও বিশ্বাস করি না, একটা অপরাধকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়ার জন্য আরেকটা অপরাধ করা আপনার জন্য ফরজ কাজ। মতের ভিন্নতা থাকতেই পারে, কিচ্ছু যায় আসে না। শুধু বলেন, শুধু ঢাকা শহরেই আপনি/আপনারা ৪শ’রও বেশি যানবাহন ভাংচুর করেছেন। কেন? নিরাপদ সড়ক চাচ্ছেন। উত্তর খুঁজে দেখেন। নিরাপদ সড়ক চায় না কে? সবাই নিরাপদ সড়ক চায়। আবার নিরাপদ সড়ক যেভাবে হবে সেটাও নষ্ট করে এ দেশের নাগরিকরাই।
আপনার মনে রাখতে হবে, আপনার কাছে আপনার জীবন বা সম্পদ যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি অন্যের কাছেও তার জীবন বা সম্পদ তেমনি গুরুত্বপূর্ণ। আপনি সেন্টিমেন্টাল আচরণ করবেন, বাস গাড়ি ভাঙবেন, অরাজকতা চালাবেন, আপনি গুজবের হিড়িক ছড়িয়ে একটি পার্টি অফিসে গিয়ে হামলা করবেন, আপনি কেন বুঝেন না সব কিছুর একটা প্রতিক্রিয়া আছে। কেন বুঝেন না আপনি যা করছেন ঠিক উল্টোটাও ওদের করার অধিকার আছে, যারা ক্ষতিগ্রস্ত। আপনার কাজ যদি আপনার চোখে বৈধতা পেতে পারে তাহলে ক্ষতিগ্রস্ত অন্য ব্যক্তির প্রতিরোধ করাটাও তার কাছে অবৈধ বলে বিবেচিত হবে কেন?
যেখানে একটা আন্দোলন দানা বাঁধার আগেই সরকার প্রধান মধ্যস্থতাকারী হিসেবে না থেকে একটা পক্ষ হয়ে সেই আন্দোলনে একাত্মতাবোধ করে দাবী পূরণের সকল আশ্বাস দেয় কিংবা উত্থাপিত দাবিগুলোর বেশ কিছু পূরণ করেও ফেলে সেখানে আপনার আন্দোলনের বাকী কী থাকে?
কথায় কথায় আপনি বলছেন ইউরোপ আমেরিকার সড়ক ও আইনের কথা। আপনি এটা বলছেন না যে আমাদের দেশেও ইউরোপ আমেরিকার মত সড়ক চাই, সারাদেশে সড়ক মহাসড়কের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করতে হবে, নগরের ফুটপাত হকার মুক্ত করতে হবে, কম গতির গাড়ি মহাসড়কে নিষিদ্ধ করতে হবে। অথচ আপনি বলছেন চালককে ফাঁসি দিলেই সড়ক নিরাপদ কাছাকাছি চলে যাবে! বাস্তবতা কি এতোই সোজা? যেখানে আপনি নিজেই আইন মানছেন না, সেখানে অন্যকে আইন শেখাতে উঠে পড়ে লেগেছেন! কেন? আইন মান্য করার শিক্ষাটা ঘর থেকেই শুরু করছেন না কেন?
আজকে যারা বলছেন, শহিদুল ঠিক করেছেন, তাদের মুখ থেকেই শুনেছিলাম ২০১৫ সালে এক সরকারী প্রজ্ঞাপনের বিরুদ্ধে কথা বলতে। শুনতে চান কি সেই প্রজ্ঞাপন? ২০১৫ সালের জুলাই মাসে সরকারী এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছিল সারাদেশের ৩৪১২ কিলোমিটার মহাসড়কে থ্রি হুইলার সিএনজি, কম গতির যানবাহন চলাচল করবে না। টক শো বা ফেসবুকে প্রতিক্রিয়ায় কী বলেছিলেন মনে আছে? মনে করে দেখুন। আপনারা বলেছিলেন, এসব সিএনজি চালকেরা কোথায় যাবে, কী করবে, তাদের সংসার কিভাবে চলবে ইত্যাদি ইত্যাদি।
তাহলে কেন আপনাদের এই ডাবল স্ট্যান্ডার্ড? কিভাবে পারেন আপনারা? সরকারকে আপনাদের ভালো লাগে না, বেশ ভালো কথা। এটা অবশ্যই আপনাদের গণতান্ত্রিক স্বাধীনতার অংশ। সমালোচনা করুন, রাস্তায় দাঁড়ান। আপনি আজব গুজব তথ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে ছিটিয়ে হ্যাশ ট্যাগ মেরে বিদেশী গণমাধ্যমের দৃষ্টি টেনে আনছেন কেন? এই দেশের গণমাধ্যমের প্রতি কি আপনাদের ভরসা নাই?
আরও একটা প্রশ্নের উত্তর চাই। হ্যাশ ট্যাগ বিদেশী মিডিয়ার অংশ গ্রহণ বা বিদেশী মিডিয়ায় প্রচার হলেই আপনাদের সমস্যার সমাধান হয়ে গিয়ে দেশের মান সম্মান অনেক উঁচু হয়ে যাবে। এইসব ভাবনা কিভাবে বৈধ হয়, প্লিজ বলবেন?
তারপরে দেখেন আপনি কী করলেন? ইউটিউব কন্টেন্ট ভিডিও বানানোর জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ইউটিউবারদের কাছে ২০১৩, ২০১৪, ২০১৫ সালের আপনাদের আন্দোলনের ছবি বা ক্লিপ যুক্ত করে মেইল পাঠালেন এইসব নিয়ে ভিডিও বানানোর জন্য। একবারের জন্যও ভাবলেন না, এতে করে দিন শেষে আপনার নিজের দেশকে তুলে দিলেন আরেকজনের কাছে যিনি এইসব প্রচার করে তার জন্য রুটি রুজির ব্যবস্থা করবে। মোটকথা আপনি নিজেই করলেন বড্ড উন্মাদের মত আচরণ। অথচ প্রতিরোধকে আপনি ধরে নিলেন সন্ত্রাসী কর্ম হিসেবে! এ কেমন বাক স্বাধীনতা?
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)