সাবিনা খাতুন। খ্যাতি যার ‘গোলমেশিন’ নামে! দেশের কিংবা বিদেশি ক্লাবের জার্সি গায়ে, ছুটে চলেছেন দুরন্ত গতিতে। থামাথামির নামই যেন নেই বাংলাদেশ জাতীয় নারী ফুটবল দল অধিনায়কের। গোলের পর গোল করে চলেছেন। পরিণত হয়েছেন লাল-সবুজের নারী ফুটবলের ‘ব্র্যান্ড’এ।
জন্মভূমি সাতক্ষীরা জেলার নবারুণ উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের হয়ে খেলোয়াড়ি জীবন শুরু। পরে ২০০৮ সালে জাতীয় মহিলা চ্যাম্পিয়নশিপে নিজেকে চিনিয়ে ২০০৯ সালে জাতীয় দলে অভিষেক। তার কাঁধে চড়েই সাফ নারী ফুটবলে প্রথমবারের মতো রানার্সআপ হয়েছে বাংলাদেশ।
কেমন ছিল সাবিনার শুরুটা? শুরুর যুদ্ধটা? কোথায় দেখতে পান বাংলাদেশের নারী ফুটবলকে? ব্যক্তি সাবিনার জীবন দর্শন কী? এ সকল প্রশ্নের উত্তরই উঠে এসেছে চ্যানেল আই অনলাইনের সঙ্গে একান্ত আলাপনে-
দেশের নারী ফুটবলের সবচেয়ে বড় তারকা বলা হয় আপনাকে। খ্যাতিটা কেমন উপভোগ করেন?
এটা আমি আমার জায়গা থেকে কতটুকু উপভোগ করি তা আসলে ব্যাখ্যা করতে পারবো না। তবে আমার ভালই লাগে।
রাস্তায় যখন বের হন, মানুষ যখন বলে ‘সাবিনা যাচ্ছেন’; ক্রিকেটে যেমন তামিম ইকবাল, সাকিব আল হাসানদের দেখে মানুষ একটা উত্তেজনা বোধ করে। আপনার ক্ষেত্রে বিষয়টা কেমন?
সেভাবে বলতে পারবো না। খ্যাতিটা মানুষদের কাছ থেকে পাওয়া। বাংলাদেশের মানুষের কাছ থেকে পাওয়া। আমি বাংলাদেশের জন্য কাজ করছি। এই কৃতিত্বটা আসলে সাধারণ মানুষদেরই দেয়া উচিত।
মালদ্বীপে গোলের পর গোল করেছেন। ইন্ডিয়ান্স উইমেন্স লিগে খেলে এলেন। সেথু এফসির ১১ গোলের ৬টিই আপনার। পরের মৌসুমে বা সামনের সময়গুলোতে পরিস্থিতি কেমন হবে বলে মনে করছেন?
আসলে ভারতের ফুটবলের লেভেলটা খুবই ভালো। আর আমাদের বাংলাদেশের অনেকগুলো টুর্নামেন্টে আমরা শিরোপা নিয়েছি। আমি মনে করি এখন ভারতের ফুটবলের সঙ্গে আমাদের ফুটবলের পার্থক্যটা খুব একটা বেশি না। এবার ভারতে আমি আর কৃষ্ণা রানী সরকার(বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৬ নারী ফুটবল দলের অধিনায়ক) গিয়েছি। দুজনেরই লক্ষ্য ছিল যদি আমরা ভালো কিছু করে দিয়ে আসতে পারি, তাহলে পরবর্তীতে হয়তো তারা বাংলাদেশ থেকে আরও খেলোয়াড় নেবে। আমার মনে হয় আমি লক্ষ্য পূরণ করে এসেছি।
প্রথমবারের মতো দেশের বাইরে পেশাদার লিগ, ভারতের লিগে খেলতে যাওয়ার অভিজ্ঞতা কেমন?
আমি মালদ্বীপে তিনবার খেলেছি। দুবার ফুটসাল আর একবার ফুটবল লিগ। এরপরই আমি ভারতে খেলতে গিয়েছি। এটা আমার জন্য খুব বড় একটা ব্যাপার। কারণ বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে প্রথম কোনো নারী ফুটবলার দেশের বাইরে গিয়ে খেলে এসেছে, এটা আমার জন্য খুব গর্বের। দেশের জন্য, আমার পরিবারের জন্যও। আমার জন্য তো বটেই, দেশের জন্যও খুব ভালো একটা দিক।
সেথুতে আপনার সতীর্থ ছিলেন ইংলিশ লিগের দল টটেনহ্যামের ফুটবলার তানভি হ্যানসন। তিনি বলেছেন আপনি ইউরোপিয়ান ফুটবলে খেলার যোগ্যতা রাখেন। সেখান থেকে ডাক পেলে কেমন হবে বিষয়টি?
আমারও এমন স্বপ্ন আছে। যদি এমনটা হয় তাহলে সেটা কাজে লাগাবো। আর তানভি খুবই ভালো একজন খেলোয়াড়। ওর আর আমার খেলার পজিশনটা একটু আলাদা। আমি খেলায় সে খেলার সুযোগ পায়নি। কৃষ্ণাও পায়নি। কারণ কেবল একজন বিদেশি ম্যাচে খেলার সুযোগ পেত। যদি ইউরোপে খেলার সুযোগ পাই তাহলে সেটা কাজে লাগানোর চেষ্টা করবো।
মালদ্বীপে খেলেছেন। ভারতেও খেললেন। অথচ মেয়েদের জন্য বাংলাদেশেই কোনো লিগ নেই। বিষয়টা পোড়ায় কিনা?
লিগটা খুবই জরুরি ব্যাপার বাংলাদেশের জন্য। কারণ বেশিরভাগ মেয়েই এসেছে মধ্যবিত্ত, নিন্মবিত্ত পরিবার থেকে। তারা এই খেলাটাতে এসেছে তাদের পরিবারকে সাহায্য করার জন্য, নিজে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য। যদি বাংলাদেশে লিগটা হয় তাহলে তারা কিছু অর্থ-পয়সা রোজগার করতে পারবে। পরিবারকে সাহায্য করতে পারবে। কেবল আর্থিক দিক থেকেই নয়, দেশের নারী ফুটবলের মান উন্নয়নের জন্যও লিগটা জরুরি। তাহলে ফুটবলের মান উন্নয়ন হবে। আরও আরও নারী ফুটবলার লিগ থেকে বেরিয়ে আসবে। মেয়েদের পারফরম্যান্স আরও বাড়বে।
জাতীয় দলের অধিনায়ক হওয়ার অভিজ্ঞতাটা কেমন?
আমি ২০১৬ সাল থেকে জাতীয় দলের অধিনায়কত্ব করছি। এর আগেও দলের সহ-অধিনায়ক ছিলাম। দায়িত্বটা আমাকে অবশ্য খুব একটা চাপ দেয় না। কারণ আমি খেলোয়াড়দের সঙ্গেই মিশে থাকি। যেহেতু সবাই অনেক জুনিয়র। আমি সেভাবেই তাদের সঙ্গে মিশি। ওরাও আমার সঙ্গে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। আমি চাই না অধিনায়ক হিসেবে ওরা আমাকে ভয় পাক। চাই ওরা মনের আনন্দে আমার সঙ্গে মিশুক। আমার মনেও হয় ওরা সেটা পারে। সেদিন থেকে উপভোগ্য।
তার মানে বলছেন জুনিয়র খেলোয়াড়রা অধিনায়কের কাছ থেকে পর্যাপ্ত প্রেরণা পাচ্ছে?
আসলে সেভাবেই আমি চেষ্টা করে যাই, ওদের মোটিভেট করার। এটাই তো অধিনায়কের দায়িত্ব।
ফুটবলে লাল-সবুজের কিশোরীরা দাপটে খেলে বেড়াচ্ছে বয়সভিত্তিক টুর্নামেন্টগুলোতে। সামনের দিনগুলোতে দেশের ফুটবলকে কোন অবস্থায় দেখতে পান?
আমাদের ফুটবল ফেডারেশন(বাফুফে) সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন স্যার এবং উইমেন্স উইংয়ের চেয়ারম্যান মাহফুজা আক্তার কিরণ আপা যেভাবে আমাদের একটি লম্বা সময় ক্যাম্পে রেখেছেন, সেটা অনেক বড় একটি দিক। কারণ প্রশিক্ষণ পেলেই কিন্তু একজন খেলোয়াড় ভালো একটা জায়গায় যেতে পারে। দুই বছর ধরে যে একটা ক্যাম্প চলছে, সেটা কিন্তু আমাদের জন্য ইতিবাচক ব্যাপার। আমি মনে করি এই ধারাবাহিকতা যদি চলতে থাকে তাহলে ফুটবল সুদিন দেখবে অচিরেই।
মেয়েদের অন্তত ক্যাম্প হচ্ছে। কিন্তু ছেলেদের ক্ষেত্রে ক্যাম্প হয়েই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। যদি আপত্তি না করেন তাহলে বলা যেতে পারে সামগ্রিক অর্থেই দেশের ফুটবল নড়বড়ে। ছেলেদের ফুটবলে করুণদশা। সেখানে আলো ফিরবে বলে মনে হয়? পথটা কতটুকু তৈরি হচ্ছে?
ছেলেদের কিন্তু ১২ মাসই লিগ থাকে। কোনো না কোনো খেলা চলে। মেয়েরা কিন্তু এই সুযোগটা পায় না। তাই বলে ছেলেরা যে কষ্ট করছে না তা কিন্তু নয়। মাঠে কিন্তু তারা পরিশ্রম করে, ক্যাম্পে আসলে নিজেকে উজাড় করে দিতে চায়। একটা খেলোয়াড় যখন মাঠে খেলতে নামে সে চায় না তার দল হেরে যাক। আর সে যখন তার জাতীয় দলের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করে, সেক্ষেত্রে তো কথাই নেই। আসলে বাংলাদেশ চেষ্টা করছে কিন্তু পাশের দেশগুলো এগিয়ে গেছে। এটাই হল বিষয়। আরেকটু চেষ্টা করলে হয়ত ফুটবলের সোনালী দিনগুলো ফিরবে।
বাংলাদেশের মেয়েদের লক্ষ্য ছেলেদের আগে বিশ্বকাপ খেলার যোগ্যতা অর্জনের। কতটুকু সম্ভাবনা দেখছেন?
আমাদের ফুটবলটা বেশি সময় ধরে না। মাত্র ৮-১০ বছরের। ৩-৪ বছর আগেও যে কাঠামোটা ছিল, সেটা সম্পূর্ণ পরিবর্তন হয়ে গেছে। আমার বিশ্বাস ফেডারেশন যে স্বপ্ন দেখে বিশ্বকাপ খেলার সেটা মেয়েরা পারবে।
সি-লেভেলের কোচিং কোর্স করে ফেলেছেন, বি-লেভেলের পরীক্ষা দিয়েছেন। ফুটবল ছেড়ে কোচিংয়েই আসছেন?
আমার আশা আছে আমি ফুটবলের সঙ্গেই সম্পৃক্ত থাকবো। সেটা যেকোনো ভাবেই হতে পারে।
এবার একটু আপনার পরিবারের বিষয়ে কথা বলা যাক। আপনারা সৈয়দ বংশীয় পরিবার। যে বংশের মানুষ তুলনামূলক রক্ষণশীল হন। তেমন পরিবার থেকে আপনি একজন ফুটবলার। এ পথে পরিবারের সমর্থন কেমন ছিল?
আসলে ছোটবেলা থেকেই আমি পরিবার থেকে একটু দূরে দূরে বড় হয়েছি। আমার গ্রামের বাড়ি সাতক্ষীরা থেকে আরও ৬০ কিলোমিটার দুরে পলাশপোলে। আমি বড়ই হয়েছি সাতক্ষীরায়। তাই গ্রামের আত্নীয়-স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ থাকলেও ওভাবে মেলামেশা হয়নি। পরিবারের কাছ থেকে খুব একটা বাধাও পাইনি। আর আমার বড় বোন আমাকে যথেষ্ট সমর্থন যুগিয়েছেন ফুটবলার হতে।
আপনি তো তাহলে পরিবার থেকে সমর্থন পেয়েছেন। অনেক নারী ফুটবলারই এই সমর্থনটা পান না। এমনও হয়েছে অনেককে ব্যাগে বুট লুকিয়ে নিয়ে মাঠে অনুশীলন করতে হয়েছে। সেই মেয়েরা এখন দাপটের সঙ্গে খেলছেন। অনেক মেয়েই এখন আপনার মতো আরেকজন সাবিনা হতে চান। তাদের কী পথে আগাতে হবে?
আমিও শুনেছি আমাদের অনেক খেলোয়াড়কে প্রতিবন্ধকতা সহ্য করতে হয়েছে। বাড়ি থেকে অনেক গঞ্জনা সইতে হয়েছে। নিজের পরিবার থেকে সমর্থনটা অনেক বড় একটি বিষয়। কারণ একটা মেয়ে যখন নিজে কিছু আয় করতে পারছে, পরিবারের উচিত তাকে সাহস যুগিয়ে যাওয়া। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ফুটবলের চিত্রটা অবশ্য এখন সম্পূর্ণ পরিবর্তন হয়ে গেছে। শেষ কয়েকটা টুর্নামেন্টে বাংলাদেশের ফলাফলটা খুবই ইতিবাচক। জাতীয় পর্যায়ে আগে যেখানে ১০-১২টা জেলা অংশ নিতো, সেখানে এখন ৪০-৪৫টি জেলা অংশ নিচ্ছে। প্রচুর খেলোয়াড় আছে। ক্যাম্পেই এখন ৪০এর বেশি মেয়ে আছে। খেলোয়াড়ের অভাবটা এখন দূর হয়ে গেছে। আমাদের উচিত মেয়েরা যখন ভালো কিছু করে, তখন সব নেতিবাচকতা ভুলে তাদের সমর্থন যুগিয়ে যাওয়া। আমি পরিবারের সদস্যদের বলবো যেখানে মেয়েরা সম্মান বয়ে আনছে, তাদের কিছু করতে দেয়া উচিত।
একটু ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ। আপনারা তো পাঁচবোন। সংসারের দায়িত্ব কতটুকু নিতে হয়?
সংসারের দায়িত্ব আসলে সেভাবে নিতে হয় না। আমার বড় বোনরা আছেন। তারাই দেখাশোনা করেন। আমিও সাহায্য করার চেষ্টা করি।
সাবিনার নিজের সংসার কেমন হবে?
এখনো তো সেটা নিয়ে ভাবিনী। আমি আমার বাবা-মায়ের সেবা করতে চাই। যেহেতু তারা এখনো জীবিত। নিজের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে এখনো চিন্তা করিনি। আমি চাই ফুটবলের উপর আপাতত ফোকাস করতে।
সাবিনার অনুপ্রেরণা আসলে কি? কার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে আজকের সাবিনা?
আমি আমার বড় বোনকে খুব অনুসরণ করি। আমার বাকি বোনদের বেড়ে ওঠার পিছনে ওনার অবদানটাই বেশি। ছোটবেলায় যেকয়েকটা ঈদ করেছি বেশিরভাগ সময়ে বড় বোনের কিনে দেয়া পোশাক পরেছি। এখন আমি নিজের জন্য কেনাকাটা করি না। এখনও কিছু প্রয়োজন থাকলে বড় বোনকে বলি। তিনিই কিনে দেন। কখনো সেই সুযোগটা তাদের দিতে চাই না যে আমি বড় হয়ে গেছি বলে তাদের কোনোকিছুর আমার দরকার নেই। আমি তাদের কাছে সেই ছোট সাবিনা থাকতেই পছন্দ করি।
সাবিনার জীবনবোধ, দর্শনের জায়গা কোনটা?
আমি আসলে ভবিষ্যৎ নিয়ে মাথা ঘামাই না। বর্তমান সময়ে আমাকে যেখানে ঠেলে নেবে সেখানেই যাবো। কোনো নির্দিষ্ট লক্ষ্য এখনো ঠিক করিনি। তবে একটা অবস্থানে নিজেকে নিতে চাই। যেখান থেকে সবাই বলতে পারবে সাবিনা আজ এই পর্যায়ে এসেছে পরিশ্রম করে।
ইনিয়েস্তা বার্সেলোনা ছাড়ছেন। বিদায়কালে বলেছেন তাকে সবাই ভালো মানুষ হিসেবে মনে রাখুক। ফুটবল থেকে বিদায় নেওয়ার সাবিনাকে মানুষ কী হিসেবে মনে রাখতে চাইবে? ভালো ফুটবলার, ভালো কোচ, নাকি একজন ভালো মানুষ হিসেবে?
আপনি যখন ভালো কিছু করবেন, তখন সবাই আপনাকে ভালো মানুষ হিসেবেই মনে রাখবে। আমাকে ঘিরে যখন সবকিছুই ভালো যাচ্ছে, আমিও চাই সেটা বজায় থাকুক।
একজন সাবিনা হতে হলে কী করতে হবে?
আমি চাই না কেউ সাবিনা হোক(হাসি)। চাই না কেউ আমার জায়গা নিক। চাই কেউ আমার চেয়ে আরও ভাল খেলোয়াড় হোক। পরিশ্রম করাটা জরুরি। লক্ষ্য ঠিক থাকলে তবেই সে নিজের জায়গায় যেতে পারবে।
কেউ যদি বাংলাদেশের সাবিনাই হতে চান, তাহলে?
আমি কখনোই চাই না মেসি হতে, রোনালদো হতে কিংবা মার্তা হতে। আমি চাই সাবিনাই থাকতে। তবে নিজেকে এমন একটা পর্যায় নিতে চাই যেখানে পিতা-মাতা তাদের মেয়েকে বলুক সাবিনার মতো হও, সাবিনার মতো খেল। নিজেকে সে পর্যায়ে নিতে চাই।
ভিডিও রিপোর্ট-
ভিডিও নির্মাণ : ওবায়দুল হক তুহিন