বাঙালির প্রাণের উৎসব পয়লা বৈশাখ উদযাপনের অন্যতম অনুসঙ্গ মঙ্গল শোভাযাত্রাকে বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষণার পর এ বছর বৃহৎ পরিসরে তা আয়োজনে প্রস্তুত হচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদসহ সারাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো।
অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতীক হিসেবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জনের পর সকল অশুভকে দূর, সত্য ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ এবং জাতিগত সব ধরনের বৈশিষ্ট্য এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মের কাছে নিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়ে আড়ম্বরপূর্ণভাবে এ শোভাযাত্রা আয়োজনে স্কুল-কলেজগুলোতে বিরাজ করছে সাজসাজ রব।
এতদিন কেন্দ্রীয়ভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন করলেও এবছর তা ছড়িয়ে যাবে দেশের প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। ইউনেস্কো মঙ্গল শোভাযাত্রাকে বিশ্বঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত করায় বিষয়টি গুরুত্বসহকারে উল্লেখ করে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের আওতাধীন সব প্রতিষ্ঠান প্রধানকে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় এ অনুষ্ঠান আয়োজনের অনুরোধ করে নির্দেশনা জারির পরিপ্রেক্ষিতে বিশেষভাবে মঙ্গল শোভাযাত্রা আয়োজনের প্রস্তুতি নিয়ে ব্যস্ত স্কুল-কলেজগুলো।
দেশের বিভিন্ন এলাকার কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধানদের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলেছে চ্যানেল আই অনলাইন। তারা বলছেন, প্রতিবছরের চেয়ে এবারের পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠান ভিন্ন মাত্রা পাবে। মঙ্গল শোভাযাত্রা ছাড়াও স্কুলগুলোতে আয়োজন করা হবে বৈশাখী মেলা, লোকগান, নৃত্য, সাংস্কৃতিক পরিবেশনা, যেমন খুশি তেমন সাজোসহ নানা অনুষ্ঠানের।
রাজধানীর তেজগাঁও সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নাসরিন সুলতানা চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, আমরা এবার বৃহৎ পরিসরে পয়লা বৈশাখ উদযাপনের পরিকল্পনা করছি। মঙ্গল শোভাযাত্রাসহ মেয়েরা স্কুল প্রাঙ্গনে আয়োজন করবে বৈশাখী মেলা। সাংস্কৃতিক পরিবেশনাও থাকবে। বর্ষবরণ উপলক্ষে খুব দ্রুতই আমরা বৈঠক করে শিক্ষক শিক্ষার্থীদের মধ্যে দায়িত্ব বন্টন করে দেব।’
পিছিয়ে নেই মফস্বলের স্কুলগুলোও। তারাও নিজস্ব আঙ্গিকে এবার বর্ষবরণের জন্য বিস্তারিত কর্মসূচি হাতে নিয়েছে।
গোপালগঞ্জের বাটিকামারী উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রিন্সিপাল নজরুল ইসলাম চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, পয়লা বৈশাখ বাঙালির প্রাণের উৎসব। এ উৎসবকে ঘিরে প্রতি বছরই আমরা নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকি। তবে এবার আরও বৃহৎ পরিসরে আয়োজনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। বৈশাখের প্রথম সকালেই শিক্ষক-শিক্ষার্থী এবং এলাকার গন্যমান্য ব্যক্তিদের উপস্থিতিতে মঙ্গল শোভাযাত্রা হবে। এরপর সারাদিন শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে থাকবে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। সন্ধ্যায় থাকবে স্থানীয় শিল্পীদের পরিবেশনায় লোকগানের আসর।
ফরিদপুর পুলিশ লাইনস স্কুলের প্রধান শিক্ষক মুহম্মদ আবদুল কাইয়ুম শেখও জানালেন বৃহৎ পরিসরে, আড়ম্বরপূর্ণভাবে পয়লা বৈশাখ উদযাপনের কথা।
চ্যানেল আই অনলাইনকে তিনি বলেন, পয়লা বৈশাখ সারাদিনই আমরা ব্যস্ত থাকবো বর্ষবরণের নানা অনুষ্ঠান নিয়ে। সকালে জেলা প্রশাষকের নেতৃত্বে আমরা শোভাযাত্রা করবো। এরপর সারাদিন শিক্ষার্থীরা বৈশাখী মেলাসহ নানা ধরনের দেশীয় সাংস্কৃতিক পরিবেশনায় অংশ নেবে।
গত ১৬ মার্চ আন্তঃমন্ত্রণালয়ের বৈঠকের পর মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতর (মাউশি) থেকে একটি নির্দেশনা জারি করা হয়। মাউশি’র সহকারী পরিচালক (এইচআরএম) আশেকুল হক স্বাক্ষরিত ওই নির্দেশনায় বলা হয়, বাংলা নববর্ষ ১৪২৪ আয়োজন উপলক্ষে একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে পহেলা বৈশাখে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় উৎসবমুখর পরিবেশে ও আড়ম্বরের সঙ্গে বাংলা বর্ষবরণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
মঙ্গল শোভাযাত্রা’কে বিশ্বঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত করার বিষয়টি উল্লেখ করে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের আওতাধীন সব প্রতিষ্ঠান প্রধানকে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় এ অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য অনুরোধ করা হয় ওই নির্দেশনায়।
গেল বছরের ৩০ নভেম্বর ইথিওপিয়ার রাজধানী আদ্দিস আবাবায় অনুষ্ঠিত ইউনেসকোর ‘স্পর্শাতীত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যবিষয়ক আন্তরাষ্ট্রীয় কমিটির (ইন্টার গভর্নমেন্টাল কমিটি অন ইনট্যানজিবল হেরিটেজ) ১১তম সভায় এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার জন্য মঙ্গল শোভাযাত্রার আবেদনপত্রটি বাংলা একাডেমির মাধ্যমে ইউনেসকোর কাছে জমা দেওয়া হয়।
ইউনেস্কো তার ওয়েবসাইটে মঙ্গল শোভাযাত্রার ইতিহাস তুলে ধরতে গিয়ে বলেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে এই শোভাযাত্রা বের হয়। ১৯৮৯ সালে সামরিক স্বৈরশাসনের হতাশার দিনগুলোতে তরুণেরা এটা শুরু করেছিল। শিক্ষার্থীরা অমঙ্গলকে দূর করার জন্য বাঙালির নানা ধরনের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতীক, প্রাণির প্রতিকৃতি ও মুখোশ নিয়ে শোভাযাত্রা করে।
এর আগে ২০১৩ সালে জামদানি শাড়ি ও ২০০৮ সালে বাউলসংগীত ইউনেসকোর স্পর্শাতীত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়।