কোনো ধরনের সীমা লঙ্ঘন না করে অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটের ‘হার্ড এন্ড অ্যাগ্রেসিভ’ ব্র্যান্ড ধরে রাখার শপথ নিয়েই ২০১৫ সালে মাইকেল ক্লার্কের হাত থেকে অধিনায়কত্বের দায়িত্ব নিয়েছিলেন স্টিভ স্মিথ। কিন্তু সেই শপথ ৩২ মাসের বেশি টিকিয়ে রাখতে পারলেন না অস্ট্রেলিয়ান অধিনায়ক।
সাউথ আফ্রিকা সফরের মাঝপথ থেকে তাকে দেশে ফিরিয়ে নিয়েছে অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট বোর্ড। তাও আবার যেনতেন কারণে নয়, বল টেম্পারিংয়ের মত গুরুতর কেলেঙ্কারির মাস্টারমাইন্ড হিসেবে কাজ করায়। আইসিসি অনুমোদিত সবধরনের ক্রিকেট থেকেও এক বছরের জন্য নিষিদ্ধ হয়েছেন স্মিথ।
পুরো নাম স্টিভেন পিটার ডেভেরিউক্স স্টিভ স্মিথ। জন্ম ১৯৮৯ সালে, সিডনিতে। একজন প্রতিভাবান লেগস্পিনার হিসেবে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক ২০০৮ সালে। এর দুই বছর পর পাকিস্তানের বিপক্ষে ব্যাগি গ্রিনে অভিষেক। সেই ম্যাচে অবশ্য আট নম্বরে নেমেছিলেন।
অভিষেকের পরের ম্যাচেই আবার বাদ পড়তে হয়েছিল স্মিথকে। সেটি আবার ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ঐতিহ্যের অ্যাশেজ থেকে। এরপর আবার জাতীয় দলে ডাক পান ২০১৩ সালে। ঘরের মাঠে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজের পঞ্চম টেস্টে ডাক পেয়ে হাঁকান দুর্দান্ত এক সেঞ্চুরি।
ইংলিশদের বিপক্ষে টেস্টের প্রথম সেঞ্চুরিটা করেছিলেন তখনকার নিয়মিত অধিনায়ক মাইকেল ক্লার্কের ইনজুরি কারণে দলে ডাক পেয়ে। কিন্তু পরের সিরিজে আবারও প্রতিভার ঝলক দেখান স্মিথ। (২০১৪-২০১৫) ভারতের বিপক্ষে চার টেস্টে চারটিতেই শতরান করেন।
পরের বছর (২০১৫) অস্ট্রেলিয়ার ৪৫তম অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব নেন স্মিথ। তার হাতে অধিনায়কত্বের পতাকা তুলে দেয়ার সময় সাবেক নির্বাচক রড মার্শ বলেছিলেন, ‘চমৎকার এই যুবকের ভেতরে রয়েছে অসাধারণ প্রতিভা। সেই সঙ্গে চমৎকার নেতৃত্বের গুণাবলী এবং একটি ভয়ঙ্কর মেজাজ।’
তিনি একজন ভাল নেতাই হতে পারতেন। এখনো পর্যন্ত তার ডান হাতের দুর্দান্ত ব্যাটিং নিয়ে কোনো প্রশ্ন না উঠলেও তার অধিনায়কত্ব নিয়ে কিন্তু আগেও প্রশ্ন উঠেছে। ২০১৬ সালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ক্রাইস্টচার্চ টেস্টে আম্পায়ারদের একটি সিদ্ধান্তে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করতে গিয়ে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গির করেন। পরে অভিযুক্ত হয়ে ম্যাচ ফি’র ৩০ শতাংশ কাটা যায়।
গত বছর ভারত সফরের সময়ও সমালোচনার মুখে পড়েন স্মিথ। বেঙ্গালোর টেস্টে এলবিডব্লিউ হওয়ার পর রিভিউ নেবেন কিনা তা নিয়ে দ্বিধায় থাকা অজি অধিনায়ক অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকেন ড্রেসিংরুমের দিকে। সেটা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন ভারতীয় অধিনায়ক বিরাট কোহলি।
পরে স্মিথ বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করেন ‘মস্তিস্ক বিভ্রম’ হিসেবে। শুধু কোহলি নন, স্লেজিংসহ কয়েকটি কারণে অস্ট্রেলিয়ান অধিনায়ককে নিয়ে ‘সীমারেখা’ অতিক্রমের অভিযোগ তোলেন ইংল্যান্ড পেসার জেমস অ্যান্ডারসনও।
নিষিদ্ধ হওয়া কেপটাউন টেস্টের আগের ম্যাচে সাউথ আফ্রিকান পেসার কাগিসো রাবাদার সঙ্গে ঝামেলায় জড়ান স্মিথ। যদিও স্মিথের কোনো শাস্তি না দিয়ে রাবাদাকেই শাস্তি দেয় আইসিসি। তিন ম্যাচের জন্য প্রোটিয়া পেসারকে নিষিদ্ধ করলেও পরে মুক্ত ঘোষণা করে বিশ্ব ক্রিকেটের নিয়ন্ত্রক সংস্থা।
বলে টেস্পারিং কেলেঙ্কারিতে অধিনায়কের সঙ্গে জড়িত ও পরে এক বছরের জন্য নিষিদ্ধ হওয়া সহ-অধিনায়ক ডেভিড ওয়ার্নারও রাবাদার সঙ্গে বিতর্কে জড়িয়েছিলেন। তারও ম্যাচ ফি জরিমানা করা হয়।
কিন্তু আগের বিতর্ক ছাপিয়ে পুরো সাউথ আফ্রিকা সিরিজটি অন্ধকারে ডুবল ক্যামেরন বেনক্রফটের বল টেম্পারিংয়ের জন্য। যার মূল হোতা আবার দলের অধিনায়ক ও সহ-অধিনায়ক।
প্রথমে স্মিথকে এক টেস্টের জন্য নিষিদ্ধ ও ম্যাচ ফি’র পুরো কেটে নেয় আইসিসি। পরে তো এক বছরের জন্য নিষিদ্ধ করল নিজ দেশের বোর্ড। নিষিদ্ধ হয়েছেন আসন্ন আইপিএল থেকেও। সেই সঙ্গে আগামী দুই বছর অস্ট্রেলিয়া দলের অধিনায়ক বা সহ-অধিনায়ক কিছুই হতে পারবেন না তিনি। যার ফলে এখন ক্রিকেট ভবিষ্যতই ধোঁয়াশায় ঢাকা স্মিথের।
৬৪ টেস্টে ৬১’র বেশি গড়ে ৬ হাজারের বেশি রান করেছেন স্মিথ। ২৩টি শতরান করেছেন। ওয়ানডেতেও তার ব্যাটিং গড় ৪০’র উপরে। টেস্ট ব্যাটিংয়ে তাকে অনেকেই তুলনা করেন স্বদেশি সাবেক গ্রেট ডন ব্র্যাডম্যানের সঙ্গে।
কিন্তু কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে প্রতিভাধর এই ব্যাটসম্যানের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এখন মাঠ ফিরে আসা, কারণ তিনি একটি কলঙ্কিত খ্যাতিকে খারাপভাবে পুনর্বাসন করতে চেয়েছিলেন। যার ফলে তিনি মাঠে অসাধারণ কৃতিত্বের পরিবর্তে অন্যকে ঠকানোর জন্য স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।