১৯৭২ সাল। চারদিকে তখন বিজয়ের নিশান। সাড়ে সাত কোটি বাঙালি আর বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা। ফেব্রুয়ারি মাস। শীত কিছুটা কমে এসেছে। দেখতে দেখতে এসে গেল ২১শে ফেব্রুয়ারি। আমার সেজো বোনসহ মহল্লার বড় আপাদের সাথে অতি ভোরে দিনের আলো ফোটার আগেই ফুল জোগাড় করে আমরা প্রভাতে ফেরীতে গেলাম। আমরা গেলাম ময়মনসিংহ রাধাসুন্দরি গার্লস (আমার বোন রাধাসুন্দরি স্কুলে পড়ে) স্কুলের সাথে শহীদ মিনারে ফুল দিতে। খালি পা, সবার হাতেই ফুল। বড় আপারা পরেছে সাদা শাড়ি কাল পাড়, কপালে কাল টিপ, কী সুন্দর-ই- না লেগেছে তাদের দেখতে। আমরা চলছি গাইতে গাইতে
“আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি?
আ—–আ—–আ—-আ—-
ছেলে হারা শত মায়ের অশ্রু
গড়ানো ফেব্রুয়ারি।”
টাউন হলের মোড় থেকে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দেখতে আমরা গেলাম মুমিনননিসা কলেজে। অনেক সুন্দর সুন্দর দেশের গান হল। একটি নাটক মঞ্চায়ন হল। নাটকের দৃশ্য একটি কম বয়সী মেয়ে সাদা শাড়ি পরে মা সাজলো। তার মুক্তিযোদ্ধা ছেলেকে পাকিস্তানী সেনারা হত্যা করে; মুক্তিযুদ্ধের নাটক। এতো সব দেখে শুনে আমরা খুবই অনুপ্রাণিত।
১৯৭২ সালের মার্চ অথবা এপ্রিলের দিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ময়মনসিংহে আসেন। তার আগমন বার্তা ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে। তাকে এক নজর দেখার জন্য তার বলিষ্ঠ কণ্ঠের ভাষণ শুনার জন্য দলে দলে লোকজন ছুটে গেল সার্কিট হাউজের মাঠে। এই উপলক্ষে বেশ কিছু আত্মীয় স্বজন এল আমাদের বাসায়। আমরা ছোটরা ঈদের খুশির মত মহল্লায় সে-কি হৈ হুল্লোড় কাণ্ড।
বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সম্পর্কে যা-ই বুঝি আর না বুঝি, তবে আমার বাবা আমাদের বুঝিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু মানে বাংলার বন্ধু। বড়রা যখন বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে কোন আলোচনা করতেন, তখন দেখতাম তাকে একাধিক নামে ডাকা হচ্ছে- “ শেখ সাব, শেখ, শেখ মুজিব, মজিবর, জাতির পিতা, শেখ মজিবর, শেখ মুজিবুর রহমান।”
এদিকে রেডিওতে আর আমাদের মুখে মুখে চলত-
“বাংলার স্বাধীনতা আনল যে
মুজিব মুজিব মুজিব”
“মুজিব বাইয়া যাও রে”
“শোন একটি মুজিবরের থেকে
লক্ষ মুজিবের কণ্ঠ স্বরে ধনি-প্রতিধনি
আকাশে বাতাসে উঠে রণী
বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ”
অনেক পথ পেরিয়ে আজ ২০১৮ সাল। ৪ নভেম্বর ২০১৮ ময়মনসিংহবাসীর দীর্ঘ দিনের স্বপ্ন কে বাস্তবায়ন করতে বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ময়মনসিংহে পদার্পণ করেন। তার আগমনে ময়মনসিংহবাসী ছিল আনন্দিত-গর্বিত-কৃতজ্ঞ। শেখ হাসিনার সরকারের আমলে সমগ্র দেশের সার্বিক উন্নয়নের পাশাপাশি ময়মনসিংহকে বিভাগীয় শহরে পরিণত করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বৃহত্তর ময়মনসিংহ উন্নয়নের লক্ষ্যে ১৯২টি প্রকল্পের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। যার পরিপ্রেক্ষিতে ময়মনসিংহবাসীর অনেক দু:খ দুর্দশার অবসান ঘটবে। বেকার সমস্যা দূর হয়ে নতুন নতুন পেশার কর্ম সংস্থান সৃষ্টি হবে। তিনি বিভাগীয় শহরে কলকারখানা নির্মাণের কথা বলেছেন। তিনি জানিয়েছেন, ব্রহ্মপুত্র নদের উপর কেওয়াট খালি ব্রিজ নির্মাণ হবে।যে পুত্র নদ তার নব্যতা হারিয়ে শ্রীহীন হয়ে পড়েছে সেই নদ খনন করা হবে। এক সময় এদেশের প্রধান প্রধান নদীগুলোর মধ্যে ব্রহ্মপুত্র নদ ছিল অন্যতম।
ব্রহ্মপুত্র নদ কতটা বিশালতায় পরিপূর্ণ ছিল তা তসলিমা নাসরিনের “ফেরা” গল্প থেকে জানা যায় বিবাহিত জীবনে কল্যাণী কলকাতায় বসবাসরত অবস্থায় নিজ পুত্রের সাথে বাক্যালাপে স্বদেশের তৃষ্ণা নিয়ে বেড়ে ওঠা প্রিয় শহর ময়মনসিংহের সুবিশাল নদ ব্রহ্মপুত্রের বর্ণনা করেন। পুত্রকে নিয়ে মাতৃভূমি বাংলাদেশে বেড়াতে এসে কল্যাণী দেখেন ব্রহ্মপুত্র নদ শুকিয়ে সেই জৌলুস আর সৌন্দর্য হারিয়ে ফেলে।
বালক মাকে ব্রহ্মপুত্র নদ দেখিয়ে বলে, মা ঐ নালাটা কি! কল্যাণী লজ্জায় পুত্রকে বলতে পারে না যে, ঐ নালাটাই সেই বিশাল ব্রহ্মপুত্র নদ।
নদীকে ভালবেসে সৈয়দ শামসুল হক বাংলাদেশকে তেরোশত নদীর দেশ বলেছেন। নদীর সাথে এ দেশের মানুষের গভীর মিতালি এমন মুগ্ধকর কথা কবি সাহিত্যিকরা তাদের লেখনিতে এনেছেন। সত্যিই, এদেশের নদীগুলো বিচিত্র নাম আর কাহিনীতেও ভরপুর। ব্রহ্মপুত্র নদ নিয়েও সংক্ষেপ: ব্রহ্মপুত্র নদের সাথে মেঘনা নদীর বিয়ের পাকা কথা হয়ে যাওয়ার পর না বুঝে নিজের বাগদত্তাকে চিনতে না পেরে ব্রহ্মপুত্র মেঘনাকে মা ডেকে ফেলে। যে ভুলের কারণে বিয়ে আর হলো না। তাইতো লোকে বলে একগায়ে একসাথে চলেছে দুই নদীর দুই রং।
একবার ভৈরব থেকে আশুগঞ্জ নৌকায় যাওয়ার পথে দেখলাম মেঘনা নদীর পানি দুই রঙে প্রবাহিত সাদা আর কালো।
প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক ১৯২টি প্রকল্প উদ্বোধনের মধ্যে রয়েছে শিল্প প্রতিষ্ঠান নির্মাণ সংস্কার ও উন্নয়ন। রয়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন। উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় তিনি অনেকগুলো জায়গার নাম উল্লেখ করেছেন যেমন-চেচুয়া, শ্যামগঞ্জ, জারিয়া, ঝাঞ্জাইল ইতাদি।
ময়মনসিংহের নেত্রকোনা জেলায় ৫০০ একর জায়গা জুড়ে শেখ হাসিনা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে।
আনন্দ মোহন কলেজ, যেখানে (ব্রিটিশ আমলে) আমাদের পূর্বপুরুষরা অধ্যয়ন করেছেন। সেই আনন্দ মোহন কলেজে দশতলা নতুন ভবন নির্মাণ করা হবে। নির্মাণ হবে মহিলাদের জন্য কারিগরি প্রশিক্ষণ কলেজ। উন্নয়ন করা হবে ময়মনসিংহ চরপাড়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।
পূর্বকাল থেকেই ময়মনসিংহকে শিক্ষার শহর বলে গণ্য করা হয়। এখানে রয়েছে এশিয়া মহাদেশের মধ্যে সর্বপ্রথম স্থাপিত ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।
বাংলাদেশের প্রথম গার্লস ক্যাডেট কলেজ স্থাপিত হয় ময়মনসিংহে। প্রথম মহিলা টিচার ট্রেনিং কলেজসহ এখানে রয়েছে অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। শ্রদ্ধেয় শহীদ চার নেতার মধ্যে একজন সৈয়দ নজরুল ইসলাম। তার একতলা সাদা বাসভবনটি ময়মনসিংহের তিনটি শিক্ষা (আনন্দ মোহন কলেজে মুসলিম গার্লস হাই স্কুল, মুমিনুননিসা কলেজ) প্রতিষ্ঠানের নিকটতম স্থানে অবস্থিত।
বৃহত্তর ময়মনসিংহের ৩৫ টি উপজেলা সহ সকল অঞ্চল সমূহের রাস্তা ঘাট সেতু সমূহ নির্মাণ ও মেরামত করা হবে। ঢাকা ময়মনসিংহ মহাসড়কে ৪ লেন সড়ক সম্প্রসারণ করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বৃহত্তর ময়মনসিংহ বাসীর বিমানবন্দর চাওয়ার স্বপ্ন হয়ত একদিন পূরণ করবেন।
তিনি তার বক্তব্যে জানিয়েছেন কৃষিঋণ, যুবকদের বিনা জামানতে ঋণ দান এবং ভূমিহীনদের ভূমি দান করা হবে। তিনি ক্ষুধামুক্ত, ভিক্ষুকমুক্ত দেশ গড়তে জনগণের সহযোগিতা চেয়েছেন। তিনি বৃহত্তর ময়মনসিংহে গ্যাস, বিদ্যুৎ, ফায়ার সার্ভিস সহ আরও বহু বিষয়ে উন্নয়নের কথা জানিয়েছেন। সব শেষে তিনি ময়মসিংহবাসীর প্রতি ভালোবাসা জানিয়ে বিদায় নিয়েছেন, ‘আবার দেখা হবে’ বলে। আমি তার সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করি।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)