বাংলাদেশে ‘ভিআইপি’ শব্দটি বহুল ব্যবহৃত। কে ভিআইপি, আর কে ভিআইপি নয়, তা বোঝা বেশ কঠিন। তবে আমাদের দেশে ভিআইপিদের আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে। ‘জানো, তুমি কার সঙ্গে কথা বলছ?’ ‘তুমি আমাকে চেন?’ ‘তুমি জানো, আমি কে?’ অথবা ‘আমারে চিনস?’ বাংলাদেশে এগুলো খুবই পরিচিত বাক্য। কাউকে লাইনে দাঁড়াতে বললে, কাউকে ট্রাফিক আইন মানতে বললে, কারও অন্যায়ের প্রতিবাদ করলে, কারও জবরদখল সরাতে বললে এ রকম কথা শোনা যায়। কারা এ রকম বলেন? যারা ক্ষমতার ভারে আক্রান্ত। এটা হতে পারেন ক্ষমতাবান ভিআইপি কেউ, হতে পারেন ক্ষমতার ছোঁয়া লাগা তাদের ভাই, ভাতিজা, বন্ধু বা বন্ধুর ভাই কিংবা চেলা-শাগরেদ। পুলিশ, র্যাব, আইন, নীতি, শৃঙ্খলা- সবই তাদের ক্ষমতার অধীন। সর্বজনের টাকা তাদের টাকা।
আমাদের দেশে এটাও একটা ব্যাধি একে বলে ভিআইপি রোগ। এক মহাজন লিখেছিলেন, ‘ভিআইপি কারা? যারা ইচ্ছা করলে আইন ভঙ্গ করতে পারেন। মানুষকে লাইনে দাঁড় করিয়ে যেখানে-সেখানে যখন-তখন ঢুকে যেতে পারেন। উল্টো রাস্তায় ভোম্বা সাইজের গাড়ি নিয়ে নিয়মনীতিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে চলে যেতে পারেন। ভিআইপি কারা? আইন যাদের ধরতে পারে না। যাদের কলমের খোঁচায় বা মুখের বাণীতে নদী হয় জমি, পাহাড় হয় সমতল, বিষাক্ত খাদ্য হয় উপকারী, খুনি হয় সাধু। ভিআইপি কারা? যারা যেখানেই যান না কেন সেখানে প্রশাসন, পুলিশ, র্যাব অন্য সব কাজ ফেলে তাদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, আরাম-আয়েশ নিয়ে ব্যস্ত থাকে।’
আমাদের দেশে তো ভিআইপির সংখ্যা নেহাত কম নয়। হাতের কড়ায় এই শ্রেণিকে গুনে শেষ করা যাবে না। মন্ত্রীরা তো আছেনই, আছেন আমলা, সেক্রেটারি, সিনিয়র সেক্রেটারি, পুলিশ অফিসার, বিভিন্ন বিভাগের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা, আছেন সেনাবাহিনী, তারপর আছেন রাজনৈতিক নেতা, উপনেতা, ছাত্রনেতা এবং তাদের ছেলেমেয়েরা, এমন কী তাদের আত্মীয়স্বজন-বন্ধুবান্ধবরাও। যে সমস্ত পুলিশ নিয়ম রক্ষার দায়িত্বে থাকবেন, তাদের ঘাড়ে কয়টা মাথা যে এদের ঠেকায়! তাইতো দেখি ব্যস্ত সড়কে এই ভিআইপিরা দামি দামি গাড়ি নিয়ে, কে কার চাইতে দ্রুত এগিয়ে যেতে পারে তার প্রতিযোগিতা চালান, অন্যদিকে ভিড়ে ঘন্টার পর ঘন্টা জ্যামে আটকে থাকে আমজনতা!
আধুনিক কবি জীবনানন্দ দাশ বলেছিলেন, “সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি”। আমরা জীবনানন্দকে ধার করে বলতে পারি, দেশের সব মানুষ মানুষ নয়, কেউ কেউ কেউ মানুষ। আরেক ধাপ এগিয়ে বলতে পারি, দেশের সব নাগরিক নাগরিক নয়, কেউ কেউ ভিআইপি। আসলে তারাই নাগরিক, তারাই মানুষ তারাই দেবতা। তারাই দেশ চালান। নীতি নির্ধারণ করেন। শিল্প-সংস্কৃতি নির্ধারণ করেন। এমনকি অন্যের মরা-বাঁচাও। তাদের জন্য নিরাপত্তা, বাড়ি-গাড়ি, প্লট, প্রণোদনা, চিকিৎসা, শিক্ষা, পর্যটন, বিনোদন, সম্মান, মর্যাদা-সব কিছু। তারা আছেন বলে অন্য সবাই আছে। তারা বাঁচেন বলেই অন্য সবাই বাঁচে। এই রাষ্ট্র তাদের জন্য।
দেশে ভিআইপি আছে, তাদের জন্য বিশেষ সুযোগ-সুবিধাও আছে। কিছু সুযোগ-সুবিধা ভিআইপি-দাবিদাররা বাগিয়ে নেন, জোর করে আদায় করেন। আবার অনেক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রও এই ভিআইপিদের নানা লোভনীয় অফার দেন। কিন্তু রাষ্ট্র কেন জানি এ ব্যাপারে ঢাক ঢাক গুড় গুড় নীতি অবলম্বন করে। যদিও এর কোনো মানে নেই। রাষ্ট্র পরিস্কারভাবে বলে দিলেই পারে, এইসব মানুষ হচ্ছে ভিআইপি। তাদের জন্য এই এই সুযোগ-সুবিধা পার্মানেন্ট করা হলো। ভিআইপি পদবি তো এই দেশে নতুন আসেনি। যুগ যুগ ধরে চলছে। খেলার মাঠে ভিআইপি, রেলের টিকিটে ভিআইপি, বিমানের টিকিটে ভিআইপি। সংখ্যায় অল্প হলেও সবখানেই ভিআইপি আছেন। আমরা জানি, একটা সময় দক্ষিণ আফ্রিকা বর্ণবাদে জর্জরিত ছিল। সেখানে রাস্তার একপাশে লেখা থাকত- ফর হোয়াইট বা ‘শ্বেতাঙ্গদের জন্য’ আরেকপাশে লেখা থাকত ফর ব্ল্যাক বা ‘কালোদের জন্য’। রাষ্ট্রকে শ্বেতাঙ্গরা দুইভাবে ভাগ করে ফেলেছিল সেদিন। ইতিহাসের সেই কালো অধ্যায়ের সমাপ্তি হয়েছে। কিন্তু আমাদের সেই ইতিহাস ভিন্ন ভাবে, ভিন্ন চেহারায় কিন্তু ঠিকই ফিরে ফিরে আসছে। শাসকরা মাঝে মাঝেই ভিাইপিদের জন্য বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণের চেষ্টা চালান। কখনও ভিআইপিদের জন্য আলাদা সড়ক প্রতিষ্ঠা, কখনও করোনা রোগের চিকিৎসায় আলাদা হাসপাতাল তৈরির উদ্যোগের কথা ঘোষণা করা হয়।
ভিআইপি নামটাকে অপব্যবহার করে বিভিন্ন ধরনের সুযোগ সুবিধা নেয়ার এই সংস্কৃতি অবশ্য আমাদের দেশে নতুন নয়। যদিও এটা নিয়ে মানুষের মধ্যে প্রবল ক্ষোভ রয়েছে। আর এই ক্ষোভের কারণেই শেষপর্যন্ত প্রকাশ্যে ভিআইপিদের জন্য ঘোষিত উদ্যোগগুলো বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। আমাদের দেশের মানুষ এখনও প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির বাইরে এদেশের মানুষ আর কাউকে ভিআইপি হিসেবে দেখতে ও মানতে রাজি নয়।
ভিআইপি জিনিসটি ঠিক সংবিধানের সঙ্গেও যায় না। সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদে আইনের দৃষ্টিতে সমতার সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এই মৌলিক অধিকারটি দিয়ে ২৮(১) অনুচ্ছেদ বলে, ‘কোনো নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র কোনো রকমের বৈষম্য প্রদর্শন করতে পারবে না।’
তবে, সংবিধানের ২৮(৪) অনুচ্ছেদে ‘পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী’ বা নাগরিকদের যে কোনো ‘অনগ্রসর’ অংশের অগ্রগতির জন্য বিশেষ সুবিধার কথা বলা আছে। এখন প্রশ্ন হলো, রাষ্ট্র কেন তাহলে ভিআইপি নাম দিয়ে মন্ত্রী, এমপি, ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তা, শিল্পপতি, কোটিপতিসহ এই তথাকথিত ভিআইপিদের জন্য কিছুদিন পর পরই বিশেষ সুবিধা প্রদানে তৎপর হয়ে ওঠে? তারা কি তবে ‘পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী’ বা সমাজের ‘অনগ্রসর অংশ’? যদি তাই হয়, তবে রাষ্ট্রকে সে কথাও স্পষ্ট করে বলতে হবে।
জীবনের মৌলিক চাহিদা তো সবারই একই রকম। সেখানে কিছু দিন পর পর ভিআইপিদের স্বার্থের পক্ষে জিগির কেন? সংবিধানের ১৫(ক) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দ্বায়িত্ব হলো, তার প্রতিটি নাগরিকের জন্য অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা ও চিকিৎসাসহ জীবনধারণের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। জীবনধারণের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সরকার কি কোনো বৈষম্য সৃষ্টি করতে পারে?
রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী ছাড়া কেউ ভিআইপি মর্যাদা পাবেন কিনা, সেটাও নির্মোহভাবে ভেবে দেখার সময় এসেছে। রাষ্ট্রের শীর্ষ দুই ব্যক্তিত্বের বাইরে যদি ভিআইপি কাউকে বলতেই হয় তবে সেটা হতে পারেন বিরোধী দলীয় প্রধান, সংসদের স্পিকার এবং প্রধান বিচারপতি। বিচার বিভাগের সদস্যরা বিবেচিত হবেন সন্মানীয় বলে। রাষ্ট্র ও সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বাকিরা হবেন প্রজাতন্ত্রের ‘কর্মচারী’ অথবা নাগরিকদের ‘প্রতিনিধি’। রাষ্ট্রের মালিক জনগণের কিংবা গণপ্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এর বাইরে কোনো ভিআইপি থাকতে পারে না। থাকা উচিতও নয়।
হ্যাঁ, ভিআইপিদের জন্য দেশে অনেক কিছুই আছে, আরও অনেক কিছুই হতে পারে। কিন্তু সেটা সাধারণ মানুষের টাকায় নয়। সাধারণ মানুষের টাকায় বানানো সব প্রতিষ্ঠানে সেবা নিতে হলে সাধারণ মানুষের মতোই সেখানে লাইন দিয়ে দাঁড়াতে হবে। আগে এলে আগে পাবেন ভিত্তিতে সেবা নিতে হবে।
বড়লোক, শিল্পপতি, কোটিপতি, ধনপতিদের জন্য এমনিতেই অবারিত সুযোগ। টাকার জোরে তারা যেখানে খুশি সেখানে যেতে পারেন, যা খুশি তাই করতে পারেন। তারা সেটা করেনও। এই নিয়ে আমজনতার কোনো বক্তব্য নেই। কিন্তু দেশের জনগণের টাকায়, সাধারণ জনগণের প্রতি বৈষম্য করে তাদের ভিআইপি হিসেবে চিহ্নিত করে সরকারিভাবে কোনো বাড়তি সুবিধা প্রদান করা যাবে না। রাষ্ট্রীয়ভাবে মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করে বড়লোকদের জন্য বাড়তি সুযোগ-সুবিধা প্রদানের এই অশ্লীল বেহায়াপনা বন্ধ করতে হবে এবং তা এখনই।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)