পথের মাঝে দেয়াল তুললে পথ বন্ধ হয়ে যায়। তবে কিছু উদ্যমী মানুষের উদ্ভাবনী শক্তির জাদুতে সেই দেয়ালই কখনো আবার পথ দেখায়। বিজয় সরণী-তেজগাঁও ফ্লাইওভার কাঠামোর একটি দেয়ালে উড়ালসড়কটির নিচে বাস করা মানুষগুলোকে সুন্দর আগামীর স্বপ্ন দেখাচ্ছে ‘দেয়ালকোঠা’ নামের একটি বিশেষ প্রকল্প।
‘দেয়ালকোঠা’র সঙ্গে শিক্ষার আলো ছড়াতে সঙ্গী হয়েছে আলোর মশাল হাতে এগিয়ে আসা ‘লাইট অব হোপ’ নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা।
ফ্লাইওভারটি নির্মিত হওয়ায় ছাদখুঁজে পায় কিছু ভাসমান মানুষ। সেখানকার ৩০-৪০টি পরিবারের শিশু ও অভিভাবকদের নিয়েই কাজ করছে দেয়ালকোঠা ও লাইট অব হোপ। শুধু একটি দেয়ালকে কেন্দ্র করে কিছু মানুষের জীবন বদলে দেয়ার গল্পের শুরুটা জানানোর আগে ‘দেয়ালকোঠা’র বর্ণনা না দিলেই নয়।
দেখতে যেমন ‘দেয়ালকোঠা’
ফ্লাইওভারটির তেজগাঁও পয়েন্টে সরকারি শিশু পরিবারের গেটের সামনের দেয়ালটি এখন দেয়ালকোঠা হয়ে গেছে। দেখতে উড়াল সড়কের সাধারণ দেয়ালগুলোর থেকে একেবারেই ভিন্ন।
পুরো দেয়ালটি কোনো বইয়ের বিশাল এক পৃষ্ঠা যেনো! বর্ণিল রঙে সেখানে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে বিশাল একটি অক্ষর গাছ।
গাছে বাংলা স্বরবর্ণ-ব্যঞ্জনবর্ণগুলো ঝুলে আছে ঠিক রঙিন ফলের মতো। দেয়ালে লেখা ‘আমার সোনার বাংলা…’, হলুদ রঙের মানচিত্র আর লাল-সবুজের পতাকা বলে যায় দেশের কথা।
দেয়ালটির বাকি অংশ পুরোটাই একটা ব্ল্যাক বোর্ড। অত উচুঁ দেয়ালে ছোট ছোট শিশুরা লিখবে, আঁকবে কিভাবে? এই ‘ঝামেলা’ মিটে গেছে চমৎকার এক মঞ্চে। দেশীয় প্রযুক্তিতে বাঁশের তৈরি একটি মঞ্চ জুড়ে দেয়া হয়েছে দেয়াল ঘেষে।
শক্ত পাটাতনের ওপর স্ক্রু দিয়ে আটকানো বাঁশের রেলিং বেশ রঙচঙে। কাঠের সিড়ি দিয়ে উঠতে হয় দেয়ালকোঠার মঞ্চে। সেখানেই সপ্তাহে ৩ দিন বসে কচিকাঁচাদের লেখালেখি-আঁকিবুঁকির হাট।
হেবরন হোসেন, অলীদ হোসাইন কিংবা নাঈম ‘ভাইয়া’দের দেখলেই সোহাগী, মারিয়া, মারুফ, রোকসানার মতো নানা বয়সী শিশুরা দৌড়ে আসে আঁকা-লেখা-হাতের কাজ শিখতে। এভাবেই ওরা নিজের নাম লেখতে, গুনতে শিখেছে। রঙের ব্যবহারেও পটু এখন ওদের কয়েকজন।
আসলে এখান থেকে অন্তত ১০ জন শিশুকে মূলধারার স্কুলে ভর্তি করাতে চায় দেয়ালকোঠা ও লাইট অব হোপ। এজন্য কম বয়সী অর্থাৎ স্কুলে ভর্তিযোগ্যদের প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষাতেই বেশি জোর দেয়া হচ্ছে।
আর যেসব কিশোর-কিশোরীরা স্কুলে যেতে পারে না তাদেরকে প্রাথমিক শিক্ষা দিয়ে পেইন্টিং, ব্লক-বাটিকের মতো কর্মমূখী শিক্ষায় শিক্ষিত করা হচ্ছে। এমনকি বাচ্চাদের মায়েদের জন্যও নানা রকম হাতের কাজের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রেখেছে দেয়ালকোঠা।
গুরু-শিষ্য আর অভিভাবকদের কথা
সোমবার বিকালে ‘দেয়ালকোঠা’র শিশুদের আর্ট ক্লাস নিতে আসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার শিক্ষার্থী হেবরন হোসেন। তার বন্ধু-সহপাঠী নাঈমও আসেন নিয়ম করে।
হেবরন জানান,“শিশুরা সাধারণত আঁকাআঁকি, রং করতে ভালোবাসে। স্বল্প আয়ের পরিবারগুলো তাদের বাচ্চাদের মনের খোরাক জোগাতে রং-কাগজসহ নানা অনুষঙ্গ দিতে পারেন না। এই শিশুদের রঙিন জগতের একমাত্র ভরসা এই দেয়ালকোঠা”।
একধরণের দায়িত্বশীলতার জায়গা থেকেই সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের লেখা-পড়ায় হাতেখড়ি দিতে এসেছেন বলে জানালেন আরেক স্বেচ্ছাসেবী অলীদ হোসাইন।
অলীদ বলেন,“এই পরিবেশে একমাত্র শিক্ষাই পারে ওদের নেশা-অপরাধের মতো অন্ধকার জগৎ থেকে দূরে রাখতে”।
সারাদিন দৌড়ঝাঁপের পর বেশ পরিপাটি হয়েই দেয়ালকোঠায় হাজির হয় মারুফ-সোহাগীরা। নিজেদের পরিবর্তনের গল্প বললো ওরাই।
১২ বছরের সোহাগী আগে একটি স্কুলে ভর্তি হলেও অভাবে তা আর চালিয়ে নিতে পারেনি। ওকে আশার আলো দেখিয়েছে দেয়ালকোঠা।
সোহাগী উচ্ছাস ভরা কন্ঠে জানায়, “আগে কিছুই পারতাম না। এখন নাম লেখবার পারি, গুনবার পারি। ভাইয়ারা আমাগো ফুল, গাছ, মানুষ আঁকতে শিখাইছে। বাড়ির ফেলনা জিনিস দিয়া কাজের জিনিস আর ব্লকও করবার পারি”।
পরিবর্তনের কথা শোনালো ১০ বছরেরও মারুফও। ছোট বোন মারিয়া আগেই এসেছিলো দেয়ালকোঠায়। তবে বন্ধুদের নিয়ে ঘুরে বেড়ানোই, মার্বেল খেলা নিয়েই ব্যস্ত থাকায় সে আসেনি এতোদিন। কিন্তু গত কয়েকমাসে এখানে নিয়মিত হওয়ার পর এখন সেও চায় আঁকতে-পড়তে।
সন্তানদের আচরণ পরিবর্তনে খুব খুশি মারিয়া-মারুফের মা আফরোজা বেগম। দেয়ালকোঠার অভিভাবক কর্মশালা থেকে কাজ শিখে গাড়িচালক স্বামীর উপার্জনে চলা সংসারে এখন তিনিও কিছু যোগ করার আশা করেন। শিখছেন ব্লক-বাটিকের কাজ।
মারিয়াকে স্কুলে ভর্তি করাবেন বলেও জানান আফরোজা। দেয়ালকোঠা হওয়ার পর এখানকার ৩০-৪০ ঘর মানুষের সন্তানরা ‘বস্তির পোলাপান’ পরিচয় পাবে না এটাই অনেক বড় পাওয়া বলে মনে করেন এই অভিভাবক।
যেভাবে শুরু পথ চলার:
যেখানে দেশের বেশিরভাগ উচ্চশিক্ষিত নবীনের মধ্যে বিদেশগামী প্রবণতা প্রবল, সেখানে এক কৃতি দেখালেন নতুন পথ। তিনি সাজাবিন কবির, দেয়ালকোঠা আর লাইট অব হোপের সবাই যাকে ‘জেবিন আপা’ নামে ডাকে।
বুয়েটে প্রকৌশলবিদ্যা শেষ করে হার্ভার্ডের স্কুল অব ডিজাইনে পড়া সাজাবিন কবির ভাবছিলেন দেশেই একটা কিছু করবেন। সেই ভাবা থেকেই ২০১৪ সালে যাত্রা শুরু দেয়ালকোঠা’র। তবে শুরুতে এটা স্কুল হবে এমনটা নাকি তিনি নিজেই ভাবেননি!
দেয়ালকোঠার গল্প শোনাতে গিয়ে ‘জেবিন আপা’ বলেন,“উড়ালসড়কের বক্স স্পেসকে কিভাবে কাজে লাগানো যায় এটা নিয়ে কাজ করছিলাম।
সরেজমিনে দেখতে এলাম বিজয় সরণী-তেজগাঁও ফ্লাইওভারের এই জায়গাটি। তখনই কোত্থেকে যেনো একঝাঁক বাচ্চা দৌড়ে এলো ‘আপা আপা’ বলে। ওরা আমাকে ঘিরে দাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো “আপা, আপনি আমাগো পড়াইতে আইছেন?”।
ওদের কথা থেকেই আইডিয়া এলো, দেয়ালটিকে শিক্ষাউপকরণ হিসেবে ব্যবহার করার। আসলে দেয়ালকোঠা হচ্ছে দেয়ালজুড়ে একটা গল্পের মতো। ঠিক করলাম স্কুলই হবে। অনেক চেষ্টার পর সিটি কর্পোরেশনের অনুমতি যোগাড় করলাম। বুয়েটের সৃজন, সামাইনরা মিলে বানিয়ে দিলো দেয়ালকোঠার মঞ্চটি।
একাডেমিক কার্যক্রমে সহযোগিতার করতে পাশে পেলাম লাইট অব হোপকে। দেশে ডিজিটাল মাধ্যমে শিক্ষার আলো ছড়াতে কাজ করছে এই সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবিরা। সহযোগিতায় এগিয়ে আসে বাংলাদেশে মার্কিন দূতাবাস, ইএমকে সেন্টার ও বেসরকারি সংস্থা ভয়েস অব বাংলা ”।
এই পথ যেনো না শেষ হয়:
দেশে-বিদেশে উচ্চ শিক্ষার পরও দেশে ‘দেয়ালকোঠা’ কেনো এমন প্রশ্নের জবাবে সাজাবিন বলেন,‘দেশে এখন পরিবর্তন আসছে, কাজ করার সুযোগ অনেক। যে বিষয় নিয়ে পড়েছি তার জন্য বাংলাদেশেই চমৎকার সুযোগ আছে’।
দেয়ালকোঠা ঘিরে নিজের ভাবনার কথা তুলে ধরে সবার প্রিয় ‘জেবিন আপা’ বলেন,“একটা দেয়াল বাচ্চাদের জন্য ক্যানভাস। আমি চাই দেয়ালগুলোই যেনো বই হয়ে যায়। এখানে ওরা আঁকে,নিজ মনে কথা বলে। খুব দামী ব্যাগ-বই-খাতা ওদের দরকার নেই। ওরা ভালো মানুষের সান্নিধ্যে অল্পতেই ঝটপট শিখে যায়”।
তিনি জানান,‘ভবিষ্যতে দেয়ালকোঠা এই ভাসমান মানুষগুলোর জীবনমান উন্নয়নে শিক্ষা ও হাতের কাজ চালিয়ে যাবে। ইচ্ছা আছে দেয়ালকোঠাকে ছড়িয়ে দেয়ার।’
পথ শিশুদের নিয়ে কাজ করা সংস্থাগুলোর সঙ্গে সমন্বিতভাবে কাজ করার কথা জানান তিনি। শহরের মাঠ বঞ্চিত শিশুদের মানসিক বিকাশে একটি প্লে-স্কুল খোলার চিন্তাও আছে তার।
বেশ নিভৃতে কাজ করলেও গত এক বছরে ‘ওয়াক টুয়েন্টিওয়ান ভিয়েনা’র মতো কয়েকটি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও পেয়েছে দেয়ালকোঠা।
“কোনো সনাতনি এনজিও’র মতো শিশুদের দামী ব্যাগ-বইখাতা দিয়ে নয়, বরং মানুষ হিসেবে ওদের মনে শিক্ষা-শিল্পবোধ জাগাতেই আমাদের দেয়ালকোঠা”, এমনটাই আশা দেয়ালকোঠা সংগঠকদের।