লঘু অপরাধে জড়িত অপরাধীর শাস্তি স্থগিত রেখে সংশোধনের মাধ্যমে তাকে সুনাগরিক হওয়ার সুযোগ দিচ্ছেন দেশের আদালত।
‘দ্য প্রবেশন অব অফেন্ডার্স অর্ডিন্যান্স ১৯৬০ (১৯৬৪ সনে সংশোধিত)’ অনুযায়ী সম্প্রতি বিচারিক আদালতের দেয়া ভিন্নধর্মী কিছু আদেশ সর্বমহলে প্রশংসিত হচ্ছে।
নামাজ পড়া ও এতিমদের খাওয়ানো
বিদেশ পাঠানোর নামে প্রতারণার অভিযোগে করা মামলায় কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার সুলতান আহমেদকে ছয় মাসের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছিল। তবে আসামির বয়স ষাটোর্ধ্ব হওয়ার পাশাপাশি আরও কয়েকটি বিষয় বিবেচনায় নিয়ে আদালত আসামির দণ্ডাদেশ স্থগিত রেখে তাকে কারাগারে বাইরে থেকে সংশোধনের সুযোগ দেন।
চকরিয়ার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট রাজীব কুমার দেবের আদালত একজন প্রবেশন কর্মকর্তার তত্ত্বাবধানে সুলতান আহমেদকে শর্ত সাপেক্ষে প্রবেশন প্রদান করেন।
মাদক বা নেশা সেবন না করা
প্রবেশনকালীন আসামি সুলতান আহমেদকে দেয়া শর্তগুলোর মধ্যে ছিল: তিনি কোনো অপরাধে জড়িত হবেন না। মাদক বা নেশাজাতীয় দ্রব্য সেবন করবেন না। নিয়মিত নামাজ পড়বেন। ভিসা সংক্রান্ত কাজ আর করবেন না। মুক্তিযুদ্ধের ওপর কমপক্ষে দুটি বই পড়বেন। ঘরের চারপাশে ৪০টি গাছ লাগাবেন। স্থানীয় এতিমখানার এতিমদের ছয় দিন একবেলা খাওয়াবেন এবং তাদের প্রত্যেককে একটি লুঙ্গি-গেঞ্জি প্রদানের পাশাপাশি ওই প্রতিষ্ঠানে ১০ কপি কোরআন শরিফ দান করবেন।
এছাড়াও স্থানীয় একটি উচ্চ বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণিতে পড়ুয়া ১ থেকে ১০ পর্যন্ত রোলধারী ছাত্র-ছাত্রীর প্রত্যেককে ১২টি বলপেন, ১০টি খাতা, একটি জ্যামিতি বক্স, একটি স্কুলব্যাগ ও একটি ভ্রমণবিষয়ক বই কিনে দেবেন।
আসামি আদালতের এসব নির্দেশনা যথাযথভাবে মানছে কিনা প্রবেশন কর্মকর্তাকে সে ব্যাপারে প্রতি তিন মাস পর-পর প্রতিবেদন দিয়ে আদালতকে জানাতে বলা হয়। আর এসব শর্ত পূরণ সন্তোষজনক না হলে আসামিকে ছয় মাসের কারাদণ্ড ভোগ করতে হবে বলে আদেশ দেন আদালত।
মায়ের দেখাশোনা আর গাছ লাগানো
আরেকটি ঘটনায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে করা এক মামলায় ফেনীর ফুলগাজী উপজেলার এনায়েত পাটোয়ারীকে ১ বছর কারাদণ্ড ও ১ হাজার টাকা অর্থদণ্ড অনাদায়ে ১৫ দিনের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হয়। তবে আসামির বয়স ও অপরাধের ধরন বিবেচনায় ফেনীর সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. জাকির হোসাইনের আদালত ১ বছরের জন্য এনায়েত পাটোয়ারীর দণ্ড স্থগিত করেন।
আদালত ৮টি শর্তে এই আসামিকে একজন প্রবেশনার কর্মকর্তার অধীনে সংশোধনের জন্য প্রবেশন প্রদান করেন। আদালত দেয়া শর্ত ছিল যে: আসামি কখনো মাদক গ্রহণ, পরিবহন ও বিক্রয় করবে না এবং মাদকবিরোধী জনমত ও জনসচেতনতায় ব্যক্তিগতভাবে অংশগ্রহণ করে ভূমিকা রাখবে। মাকে দেখাশোনা ও পর্যাপ্ত ভরণ-পোষণ করবে।
প্রবেশনকালীন সময়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের ওপর দুটি সিনেমা দেখবে এবং দেশপ্রেম বিষয়ে মানুষকে অনুপ্রাণিত করবে। এছাড়া বাড়ির আঙ্গিনায় ৩টি ফলজ গাছ এবং গ্রামে ৩০টি বনজ গাছ রোপণ করবে। এছাড়া ফেনী সদর উপজেলার যে কোন একটি এতিমখানায় ২০ জন এতিমকে এক দিনের খাবার সরবরাহ করবে। আর দৈনিক ৫ ওয়াক্ত নামাজ পড়ার চেষ্টা করবে।
মুক্তিযুদ্ধের বই পড়া ও সিনেমা দেখা
পারিবারিক বিরোধের জেরে সৃষ্ট সহিংসতার এক মামলায় ছয় মাসের কারাদণ্ডের পরিবর্তে মাগুরার মহম্মদপুর উপজেলার ইব্রাহিম হোসেনকে সম্প্রতি প্রবেশন দেয়া হয়। একজন প্রবেশন কর্মকর্তার তত্ত্বাবধানে এক বছর সময়কালের জন্য ৭টি শর্তে ইব্রাহিম হোসেনের প্রবেশন মঞ্জুর করেন মাগুরা চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. জিয়াউর রহমান। প্রবেশনকালীন সময়ে আদালত ইব্রাহিমকে যে সব শর্ত পূরণ করতে বলেছেন তা হলো:
প্রবেশনকালীন সময়ে কোনো অপরাধের সঙ্গে জড়িত হবেন না। আদালত ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থা তলব করলে যথাসময়ে উপস্থিত হবেন। কোনো ধরনের মাদক বা নেশাজাতীয় দ্রব্য সেবন করবেন না। কোনো খারাপ সঙ্গীর সঙ্গে আর মিশবেন না।
এছাড়া প্রবেশনকালীন সময়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের ওপর ২টি বই (জাহানারা ইমামের ‘একাত্তরের দিনগুলি’ ও রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধাদের লেখা ‘একাত্তরের চিঠি’) পড়বে। ইসলাম ও নৈতিকতার ওপর আরো ২টি বই পড়বে এবং ‘আগুনের পরশমণি’ সিনেমাটি দেখবে। আর পরিবেশের প্রতি দায়িত্বশীল হিসেবে ২টি বনজ ও ৩টি ফলদ গাছ লাগাতে হবে।
‘অবশ্যই প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য’
সাম্প্রতিক সময়ে আদালতের দেয়া ভিন্নধর্মী এসব আদেশের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, ‘আমাদের আদালত ছোট ছোট অপরাধে সাজার পরিবর্তে সংসধনের সুযোগ দিয়ে যে আদেশগুলো দিয়েছেন; তা অবশ্যই প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য। আমি মনে করি এটাকে আমাদের পজেটিভ ভাবে দেখতে হবে।’
‘ভাল হওয়ার সুযোগ’
শাস্তির পরিবর্তে সংশোধনমূলক এসব আদেশের বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট এ এম আমিন উদ্দিন বলেন, ‘ছোট অপরাধে শাস্তি ভোগের জন্য আসামিকে কারাগারে পাঠালে সে সেখানে অভ্যাসগত অপরাধীদের সঙ্গে মিশে বড় অপরাধ প্রবণ হয়ে যেতে পারে।’
‘‘তাই ছোট অপরাধে জড়িত অপরাধীকে সংশোধনের সুযোগ দেয়া যেতে পারে। এতে করে ওই অপরাধীর যেমন ভাল হওয়ার সুযোগ তৈরি হবে, তেমনি সমাজে অপরাধীর আধিক্যও কমবে।’’
‘অবশ্যই ইতিবাচক’
দেশের উচ্চ আদালত এইরূপ আদেশের ক্ষেত্রে আরো ভূমিকা রাখতে পারে উল্লেখ করে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল বলেন, ‘পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অপরাধীদের কারাগারের রেখে সাজা দেয়ার পরিবর্তে তাদের সংসধনের সুযোগ দেয়া হয়। কিন্তু আমাদের দেশে তো সেরকম ব্যবস্থা নেই।’
‘‘তাই ছোট অপরাধে আসামিকে কারাগারে না পাঠিয়ে আমাদের আদালতের দেয়া সংশোধনমূলক আদেশগুলো অবশ্যই ইতিবাচক। আর এরকম সংশোধনমূলক আদেশের পরিসর আরো বাড়াতে আমাদের সুপ্রিম কোর্ট সুদূরপ্রসারী ভূমিকা রাখতে পারেন।’’