মাননীয় সাংসদ, আপনার রোষানলে একজন নিরীহ এবং পেশাদার সাংবাদিক সৌরভকে নিগ্রহ হতে হলো কেন?
কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদারের কবিতা পড়েছিলাম শৈশবে,চিরসুখীজন ভ্রমে কি কখন ব্যথিত বেদন বুঝিতে পারে।/ কী যাতনা বিষে, বুঝিবে সে কিসে/ কভূ আশীবিষে দংশেনি যারে!”কথায় বলে, বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা, পুলিশে ছুঁলে ছত্রিশ ঘা। এ সমাজে অনেকে আছেন, যারা প্রতিনিয়ত পুলিশকে পাল্টা ছুঁয়ে চলেন। যাদের অন্যায় অনিয়ন্ত্রিত জীবন যাপন সমাজের জন্যে ক্ষতিকর। তাদের বিপরীতে সৌরভ হাবিবের মতো পরিচ্ছন্ন এবং পেশাদার সাংবাদিক যে কোন সমাজের জন্যেই সম্পদ। আর তাই সৌরভ হাবিব স্থানীয় সাংসদের অনুকম্পা চাননি কখনো। তিনি ‘হলুদ সাংবাদিকতা’ ঘেন্না করেন।
সেটাই বুঝি কাল হলো তার এবং তার পরিবারের? এমন পেশাদার সাংবাদিককে হয়রানি করে সমাজের কোন মঙ্গলটা করবেন সাংসদ দারা? স্থানীয় জনগণ কি কখনো তার এমন অন্যায় মেনে নেবেন? ইতিহাস সাক্ষী, এর জন্যে একদিন অনেক বড়ো খেসারত দিতে হবে বর্তমান সাংসদকে।
আমি জঙ্গিবাদ এবং অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের কাজে রাজশাহীর প্রত্যন্ত জনপদে কাজ করতে গিয়ে সৌরভের বাড়িতে যাবার সুযোগ হয়েছে। খুবই সাধারণ নিরীহ একটি পরিবার। আমার স্নেহের এই ভাইটি আটক হবার পর তার মা এবং বাবা আমাদের শ্রদ্ধেয় খালাম্মা এবং খালু এবং সৌরভের অত্যন্ত আদরের ছোট বোনটির নিরীহ উদ্বিগ্ন মুখ ভেসে উঠছে মনের গভীরে।
মনে পড়ছে, আমি যেদিন এভাবে আটক হয়ে ছিলাম, আমার অসহায় মা-বাবা কীভাবে থানায় ছুটে গিয়েছিলেন, কী অসহায় পরিস্থিতি যে হয় নিগৃহীতের স্বজন, পরিজনদের! যাদের এমন হয়েছে, তারা ছাড়া কে আর বুঝবে এই বেদনার ভার কতোটা ভারী?
সৌরভের দ্রুত মুক্তির জন্যে ঢাকায় দায়িত্বশীল এবং প্রভাবশালী অনেকের সাথে কথা বলেছি। রাজশাহীর পুলিশ সুপার নিশারুল আরিফের সাথে কথা বললাম। তিনি আশ্বাস দিলেন, ‘সৌরভকে দ্রুত ছেড়ে দেবার প্রক্রিয়া চলছে।’ হাসি পায়, একজন নিরীহ মানুষকে আটকের সময়ে কোন প্রক্রিয়াই লাগলো না! আর এমন অন্যায় আটকাবস্থা থেকে সৌরভের মুক্তির জন্যে কতো যে প্রক্রিয়া! কবে শেষ হবে এসব বাড়াবাড়ি রকমের ‘আনুষ্ঠানিকতা?
সেই সৌরভ গতকাল বিকেল থেকে পুটিয়া থানায় বন্দী। তার অসহায় পিতামাতা এবং আদরের ছোট্ট বোনটির সাথে সাথে আমরা ও তার মুক্তির প্রহর গুণছি। এ পরিস্থিতিতে কোনভাবেই কারো ভালো থাকার কথা না। একজন পেশাদার সাংবাদিক যখন বিনা অপরাধে এভাবে নিগৃহীত হন, তখন সেটা সাংবাদিক সমাজ, সর্বোপরি রাষ্ট্রব্যবস্থার জন্যেও চরম লজ্জার। তবু এ প্রশ্নটি আমার জাগছে। কারণ, বিএনপি জামায়াত সরকার এভাবে আমাকে থানায় ধরে নিয়ে গিয়েছিলো। আমার অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে অনুভব করছি, এখন সৌরভ এবং তার পরিবারের কতোটা কষ্ট হচ্ছে।
সৌরভ এখন কেমন আছেন? তার মা -বাবা,আদরের ছোট্ট বোনটি এবং স্বজনদের মানসিক চাপ উপলব্ধি করছি ঢাকা থেকেও। ভীষণ অতিথিপরায়ণ, নিরীহ এই পরিবারটির এই সংকট কালে আমার গভীর সমবেদনা এবং সহমর্মীতা জানাচ্ছি।
সহকর্মীদের প্রতি আমার আহ্বান, মনে রাখতে হবে, সম্মিলিত প্রতিরোধ ছাড়া এমন চরম অন্যায় এবং এর ধারাবাহিকতা ঠেকানো সম্ভব নয়।
সৌরভ হাবিব, এটিএন নিউজের রাজশাহী ব্যুরোপ্রধান। দীর্ঘদিন কাজ করেছেন দৈনিক সমকালে। গতকাল বিকেলে পুঠিয়ার বিজিবি ক্যাম্প থেকে ইউএনও নুরুজ্জামান হঠাৎ আটক করেন সৌরভকে। নির্বাচনের আগের দিন তথ্য সংগ্রহ করতে সাংবাদিক যেতেই পারেন বিজিবি ক্যাম্পে। বিস্তারিত এখনো না জানলেও এটিএন কর্তৃপক্ষকে বিজিবি কমান্ডিং অফিসার নিশ্চিত করেছেন, তার অনুমতি নিয়েই বিজিবি ক্যাম্পে ঢুকেছেন সৌরভ। তাহলে কেন তাকে আটক করা হলো?
সৌরভের বন্ধু কাজী সাঈদুল ইসলাম সাঈদ লিখেছেন, “গতকাল বিজিবি তাকে গ্রেফতার করে অনুমুতিহীন অনুপ্রবেশের কারণ দেখিয়ে। অথচ তার অনুমুতি ছিলো। আসল কথা উনি স্থানীয় এমপি মহোদয়ের পছন্দের হতে পারেন নি! পারেন নি হলুদ সাংবাদিক হতে !!!!”
এটিএন নিউজের অ্যাসোসিয়েট হেড অব নিউজ প্রভাষ আমিন তার ফেসবুকে পোস্ট লিখেছেন , “এটিএন নিউজের রাজশাহী প্রতিনিধি সৌরভ হাবিব। খুবই ভালো ছেলে, ভালো সাংবাদিক। সে রাজশাহী বিজিবির সিও শাজাহান সিরাজের অনুমতি নিয়ে পুঠিয়া বিজিবি ক্যাম্পে যায় তাদের নির্বাচনী প্রস্তুতি নিয়ে রিপোর্ট করতে। সেখান থেকে তাকে আটক করে থানায় নিয়ে যায় পুঠিয়ার ইউএনও নুরুজ্জামান। সৌরভের সাথে ফটোসাংবাদিক এবং অন্য এক সহকর্মীও ছিলেন। শুনে আমরা পুঠিয়া থানার ওসির সাথে কথা বলি।
তিনি জানান, যেহেতু ইউএনও সাহেব আটক করেছেন। তাই তার পক্ষে ছাড়া সম্ভব নয়। আমরা ইউএনওর সাথে কথা বলি। তিনি জানান, বিনা অনুমতিতে বিজিবি ক্যাম্পে প্রবেশের অভিযোগে তাকে আটক করা হয়েছে। আমরা কথা বলি। তিনি জানান, সৌরভ তার পরিচিত এবং তার অনুমতি নিয়েই তিনি সেখানে গিয়েছেন।
আবার নির্বাচন কমিশন সচিবকে ইউএনও নুরুজ্জামান বলেছেন, সৌরভ একজন প্রার্থীর বিপক্ষে কাজ করছিল। ইউএনওর একেক সময়ের একেক বক্তব্যে আমরা বিভ্রান্ত হয়ে যাই। থানায় অভিযোগ দিচ্ছেন, বিজিবি ক্যাম্পে বিনা অনুমতিতে প্রবেশ আর নির্বাচন কমিশনকে বলছেন, প্রার্থীর বিপক্ষে কাজ করছেন। সকালে বুঝলাম আমাদের রাতভর চেষ্টা আসলেই অর্থহীন ছিল। কারণ দারা নামে স্থানীয় এক এমপির ফোনেই নাকি তাকে আটক করা হয়েছে। সৌরভের মামা সেখানে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী। তাই কৌশলে সৌরভকে নির্বাচন থেকে বাইরে রাখতেই সরকারি দলের প্রার্থী ও এমপি ইউএনওকে দিয়ে ফাঁদ পেতেছেন। যেহেতু মামা প্রার্থী, তাই সৌরভ সেখানে না গেলে ভালো করতেন। কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত বেআইনী কিছু না করছেন,ততক্ষণ তো অসুবিধা নেই। কিন্তু ইউএনও বিনা অপরাধে তিনটি ছেলেকে আটকে রাখলো স্রেফ সরকারি দলকে খুশি করতে। এভাবেই সরকারি দৈ প্রশাসনকে ব্যবহার করে। আমরা ইউএনওর এই বেআইনী তৎপরতার তীব্র নিন্দা, সৌরভসহ আটক তিনজনের মুক্তি এবং ইউএনওকে অপসারণের দাবি জানাচ্ছি।”
এই পোস্ট দেখার আগে সকালে একটি বেসরকারী টিভি চ্যানেলের ব্রেকিং নিউজে দেখতে পাই এটিএন নিউজের রাজশাহী ব্যুরোচীফসহ ৩ জনকে বিজিবি আটক করে পুলিশে দিয়েছে। সাথে সাথে আমি বিজিবি’র রাজশাহীর কমান্ডিং অফিসারকে ফোন করি। তাকে না পেয়ে বিজিবি’র মহাপরিচালককে ফোন করি। তিনি ঘটনা জানতেন না। পরে তিনি জেনে নিয়ে বলেন যে, সৌরভ এক প্রার্থীর পক্ষে কেন্দ্রে ঢুকে কাজ করছিলো, তাই ইউএনও’র নির্দেশে তাকে আটক করা হয়েছে। বিজিবি’র হাতে কিছু নেই। পরে ফেসবুকে বিস্তারিত দেখে প্রচন্ড মেজাজ খারাপ হলো। এই সমাজে আর কতোদিন নিরীহ মানুষদের এভাবে নিগৃহীত হতে হবে? এমন নষ্ট সমাজপতিদের দখল থেকে কবে আমরা মুক্ত হবো?
সৌরভের সহকর্মী, বন্ধুদের পোস্ট থেকে জানতে পারলাম , সৌরভ খাদ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি আব্দুল ওয়াদুদ দারা এমপি কোপানলে পড়েছেন। দারা’র জন্য হুমকি ছিল তার দলের বিদ্রোহী প্রার্থীরা। তাদেরই একজন সৌরভের মামা। সেই হুমকি ঠেকাতে নিরপরাধ সংবাদকর্মী সৌরভ কে আটক করলেন এই অযোগ্য এবং মস্তিষ্কহীন সাংসদ।
তিনি জানেন না এর অনেক বড়ো খেসারত দিতে হবে তাকে। ইউএনও নুরুজ্জামান থানায় অভিযোগ করলেন, ‘বিজিবি ক্যাম্পে বিনা অনুমতিতে প্রবেশ’এর দায়ে আটক করেছেন, আর নির্বাচন কমিশনকে বলছেন, কোন এক প্রার্থীর ‘বিপক্ষে’ কাজ করছেন সৌরভ। ‘এক মিথ্যা অনেক মিথ্যাকে ডেকে আনে। অপরাধের পর অপরাধ!
আব্দুল ওয়াদুদ দারা নামের স্থানীয় এমপির নির্দেশে সৌরভকে আটক করা হয়েছে। সৌরভের মামা সেখানে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী। তাই কৌশলে সৌরভকে নির্বাচনের বাইরে রাখা এবং বিদ্রোহী প্রার্থীকে মানসিক চাপ দেবার জন্যেই আওয়ামী লীগের প্রার্থী ও এমপি ইউএনওকে দিয়ে সেই ফাঁদ পেতেছেন বলে জানা গেছে। ইউএনও বিনা অপরাধে এভাবে কাল বিকেল থেকে তিনজনকে পুঠিয়া থানায় আটকে রাখলেন কোন্ আইনে এবং কোন ক্ষমতায় ? এর জবাব তাকে দিতেই হবে। সাংসদ দারা এবং ই উএনও’র এমন বেআইনী এবং অন্যায় কাজের তীব্র নিন্দা জানাই।
শুধুমাত্র স্থানীয় সাংসদকে খুশি করতে এক তরুণ সৎ সাংবাদিককে এভাবে হেনস্থা করার দায় থেকে কোনভাবেই তাকে মুক্তি দেয়া যাবে না। সৌরভসহ আটক তিনজনের দ্রুত মুক্তির দাবি জানাচ্ছি। একই সাথে এই নির্লজ্জ ক্ষমতার অপব্যবহারকারী সাংসদ নামের কলঙ্ক জনাব আব্দুল ওয়াদুদ দারাকে তার অন্যায় অপরাধ স্বীকার করে ক্ষমা চাওয়ার দাবির পাশাপাশি ইউএনও নুরুজ্জামানকে অপসারণের দাবি জানিয়েছেন সাংবাদিকেরা।
সৌরভের সহকর্মী এবং বন্ধুদের প্রতি আমার বিনীত আহ্বান সৌরভের মতো মেধাবী এবং পেশাদার সাংবাদিকের প্রতি এই চরম অন্যায় কোনভাবেই মেনে নেবেন না এবং বাড়তে দেবেন না। এলাকার সৎ মানুষেরা সংগঠিত হোন। সৌরভের প্রতি এই অন্যায়ের প্রতিবাদে একাত্ম হয়ে স্বাক্ষর সংগ্রহ করেন। আইনজীবীর সাথে কথা বলেন। আর কোন সংবাদকর্মী বা আর কোন নিরীহ নাগরিককে যেন এভাবে হয়রানী হতে না হয়, সে ব্যাপারে কঠোর পদক্ষেপ নেবার জন্যে সাংবাদিক নেতৃবৃন্দ এবং প্রশাসনের প্রতি জোর দাবি জানাচ্ছি। এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে এক হতে হবে আমাদের সকলকে। অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে, তব ঘৃণা তারে যেন তৃণসম দহে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)