বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া করোনা ভাইরাসকে বৈশ্বিক মহামারি ঘোষণা করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। গত বছরের নভেম্বরে চীনের হুবেই প্রদেশের উহান থেকে উৎপত্তি হওয়া এই ভাইরাস এখন সারা বিশ্বের আতঙ্ক। বৈশ্বিক এক আতঙ্কের নাম করোনা ভাইরাস যা কোভিড -১৯ নামে পরিচিত।
বিশ্বের প্রায় ১৫৯ টি দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমিত হয়েছে এর প্রভাবে সমগ্র বিশ্বে মোট আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ১ লক্ষ ৭৫ হাজারের বেশি, মৃতের সংখ্যা প্রায় ৭ হাজার বেশি। চীন, ইটালি, ইরান, কোরিয়া, ইউরোপ, আমেরিকা, এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্যে, পূর্ব আফ্রিকাসহ পৃথিবীর অন্যান্য দেশগুলোতে ব্যাপকভাবে এই ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ছে।
২০১৯ সালে ৮৪ বিলিয়ন মানুষ বিশ্ব ভ্রমণ করেছে। স্পেনে ভ্রমণ করেছে ১৮ মিলিয়ন, চীনে ১৪৩ মিলিয়ন ও বাংলাদেশে প্রায় ১ মিলিয়ন। ২০০১ সালে ৯/১১ সন্ত্রাসী হামলায় পর্যটনে ক্ষতি হয়েছিল ৭.৭ মিলিয়ন ডলার, অন্যদিকে ২০০২ সালে সার্স ভাইরাসের প্রভাবে পর্যটনে লোকসান হয়েছিল ৮.২ মিলিয়ন ডলার এবং ২০২০ সালে করোনা ভাইরাসে পর্যটনে ২৪ মিলিয়ন ডলার লোকসানের সমূহ সম্ভবনা রয়েছে।
করোনা ভাইরাসের বড় আঘাত লেগেছে আকাশ পথে। সিভিল অ্যাভিয়েশন ও অন্যান্য বিমান সংস্থার তথ্য অনুযায়ী ২০২০ সালের জানুযারি মাস থেকে মার্চের ১৫ তারিখ পর্যন্ত ৩৩.৫৭ শতাংশ আর্ন্তজাতিক ফ্লাইট এর সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে। এই ভাইরাসের প্রভাব যদি আর ও বাড়ে। আর্ন্তজাতিক ফ্লাইট ৫০ শতাংশ কমে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। প্রতিদিন গড়ে ১০ হাজার যাত্রী বাংলাদেশে প্রবেশ করতেন কিন্তু করোনা ভাইরাসের ফলে বিভিন্ন দেশ তাদের ফ্লাইট সংখ্যা কমিয়ে দিয়েছেন বিধায় এই সংখ্যা ৪ হাজারে নেমে এসেছে ।
করোনা ভাইরাসের প্রভাবে তাইওয়ানের ফ্লাইট বন্ধ হয়ে গেছে ৯০ দশমিক ৬ শতাংশ, হংকং এ ৮৬ দশমিক ৪ শতাংশ, ভিয়েতনামে ৮৫ দশমিক ৯ শতাংশ, থাইল্যান্ডে ৭৬ দশমিক ৯ শতাংশ, মালয়েশিয়ায় ৭৫ দশমিক ২ শতাংশ, জাপানে ৭৪ দশমিক ৬ শতাংশ, দক্ষিণ কোরিয়ার ৬৯ দশমিক ৩ শতাংশ, কানাডার ৫৮ দশমিক ২ শতাংশ এবং কম্বোডিয়ার ফ্লাইট বন্ধ ৪৫ দশমিক ৫ শতাংশ। থাইল্যান্ডের মোট পর্যটনের মালয়েশিয়া, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, সিঙ্গাপুর, হংকং, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান ও পর্যটনে চীনা পর্যটকরা অন্যান্য। থাইল্যান্ডের মোট পর্যটকের ৩০ শতাংশ চীনা পর্যটক। থাইল্যান্ড ট্যুরিজম অথরিটি সূত্র অনুযায়ী থাইল্যান্ডে পর্যটন হতে ৩.০৫ বিলিয়ন ডলার আয় কমতে পারে। ভিয়েতনামে ৫.৯ বিলিয়ান ডলার, ইন্দোনিশায় পর্যটন দ্বীপ বালিতে ২০ হাজার হোটেল বুকিং বাতিল করা হয়েছে বিধায় ৪ বিলিয়ন ডলার লোকসানের সম্ভাবনা রয়েছে।
বাংলাদেশে ৩টি আর্ন্তজাতিক বিমানবন্দর থেকে দেশি ও বিদেশি মিলিয়ে ২৮টি বিমান সংস্থা আকাশ পথে যাত্রী পরিবহন করে থাকে যার মধ্যে দেশীয় বিমান সংস্থা ৪টি। কোভিট ১৯ প্রাদুর্ভাবের পুর্বে প্রতি সপ্তাহে ২৮টি বিমান সংস্থা ৭০৬ টি ফ্লাইট পরিচালনা করত যা কমিয়ে ৪৬৯ এ আনা হয়েছে এবং ২৩৭ টি ফ্লাইট বাতিল করা হয়েছে।
ফ্লাইট কমে যাওয়ার তুলনামূলক সবচেয়ে বেশী ক্ষতির সম্ভাবনায় বিমান বাংলাদেশ এয়ার লাইন্স, নভোএয়ার, ইউএস বাংলা, ও রিজেন্ট এয়ার ওয়েজ। বিমানের প্রতি সপ্তাহে ২১৮ টি আর্ন্তাজাতিক ফ্লাইট ছিল তা এখন নেমে এসেছে ৮৪ তে এবং ১৭ টি আর্ন্তজাতিক রুটের মধ্যে ৮ টি চালু আছে বাকিগুলো বাতিল করা হয়েছে। ইউএস বাংলা রিজেন্ট এয়ার ওয়েজ ও নভোএয়ার ওয়েজ সপ্তাহে বাংলাদেশ থেকে ৪৯টি ফ্লাইট আর্ন্তজাতিক রুটে এটি বর্তমানে ২৮ টিতে নেমে এসেছে। ২৪টি বিদেশি বিমান সংস্থার প্রতি সপ্তাহে ৩০৫ টি ফ্লাইট ছেড়ে যেত সেই সংখ্যা কমে ১৯৩ এ চলে এসেছে তবে আর ও কমার সম্ভাবনা রয়েছে।
করোনা ভাইরাস যত ছড়াচ্ছে, ততই বিচ্ছিন্ন হচ্ছে আকাশপথের যোগাযোগ। এই ভাইরাস প্রতিরোধের অংশ হিসাবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সেখানে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। একই সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ। ১৫ মার্চ মধ্যরাত থেকে যুক্তরাজ্য ছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশের কোনো উড়োজাহাজ বাংলাদেশে আসছে না। বাংলাদেশের বিমান সংস্থাগুলো বাধ্য হয়ে ফ্লাইট সংখ্যা কমিয়ে দিয়েছে। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ফ্লাইট ৩০ শতাংশ কমেছে। বিমানের পাশাপাশি দেশের অন্য তিনটি বেসকারি এয়ারলাইনস ও বিদেশি এয়ারলাইনসগুলোও এ ধারা অব্যাহত আছে।
বিশ্বজুড়ে শেয়ার বাজারে ধস নেমেছে। করোনা ভাইরাস বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ায় ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক মন্দার পর এই প্রথম এত মারাত্মক দরপতন হল বৈশ্বিক শেয়ার বাজরে। যুক্তরাষ্ট্রে অর্থনৈতিক সূচকে ৭ শতাংশ অন্যদিকে যুক্তরাজ্যে শেয়ার বাজারে ৮ শতাংশ দরপতন হয়েছে যা বৈশ্বিক বাজার ব্যবস্থার চূড়ান্ত খারাপ অবস্থা। করোনা ভাইরাসের প্রভাবে বাংলাদেশি পোশাক কারখানার পণ্যের চলমান ক্রয়াদেশ স্থগিত করেছেন বিভিন্ন দেশের খুচরা বিক্রেতা ব্র্যান্ড। একাধিক ব্র্যান্ড পণ্য উৎপাদনে বিলম্ব ও জাহাজীকরণের জন্য বার্তা দিয়েছেন।
প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাসের প্রভাবে সৌদি, কাতার, কুয়েত সহ মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশগুলোতে শ্রম বাজার প্রায় বন্ধের পথে, এমনকি করোনা ভাইরাস ঠেকাতে সৌদি আরব সকল আর্ন্তজাতিক ফ্লাইট বন্ধ করে দিয়েছেন বিধায় বৈধ ট্রাভেল এজেন্সিগুলো আজ বন্ধের পথে। বিএমইটি তথ্য অনুযায়ী গত বছর সবচেয়ে বেশী কর্মী গিয়েছিল সৌদি আরবে প্রায় ৫৭ শতাংশ, ওমান ১০ দশমিক ৩৮ শতাংশ, কাতার ৭ দশমিক ১৮ শতাংশ।
বৈশ্বিক পর্যটন শিল্পে বাংলাদেশেই সবচেয়ে বেশি কর্মসংস্থানমুখী। এখানে প্রতি ১০০ জন বিদেশি ভ্রমণকারী বা পর্যটকের বিপরীতে কর্মসংস্থান হয় ৯৪৪ জনের। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের ধারে-কাছেও নেই বিশ্বের আর কোনো দেশ। যেমন দ্বিতীয় স্থানে থাকা ভারতে প্রতি ১০০ আর্ন্তজাতিক পর্যটকের বিপরীতে ১৭২ জনের কর্মসংস্থান হয়ে থাকে। অফিশিয়াল-এস্তা ডট কম নামের একটি ওয়েবসাইট সম্প্রতি বিশ্বে পর্যটন খাতের সর্বোচ্চ শ্রমঘন বা কর্মসংস্থানমুখী দেশগুলোর তালিকা প্রকাশ করেছে। প্রতিষ্ঠানটি বিশ্বব্যাংক ও যুক্তরাষ্ট্রের নিউইর্য়কভিত্তিক বেসরকারি ডেটা ম্যানেজমেন্ট বা উপাত্ত ব্যবস্থাপনার প্ল্যাটফর্ম নোয়েমার তথ্য-উপাত্তের ভিওিতে পরিলক্ষিত হয় বাংলাদেশের প্রতি ১০০ জন পর্যটকে কর্মসংস্থান হয় ৯৪৪ জনের।
২০১৭ সালে এ দেশে মোট ১০ লাখ ২৬ হাজার পর্যটক এসেছে। এখানকার পর্যটন খাতের আকার মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৪ দশমিক ৪ শতাংশের সমান। ভারতে ২০১৭ সালে ১ কোটি ৫৫ লাখ ৪৩ হাজার পর্যটক গেছেন। দেশটির পর্যটন খাতের আকার জিডিপির ৯ দশমিক ২ শতাংশ। পূর্ব এশিয়ার দেশ ফিলিপিন্সে প্রতি ১০০ পর্যটক আসার কারণে কর্মসংস্থান হয় ৮৩ জনের, ২০১৭ সালে দেশটিতে ৬৬ লাখ ২১ হাজার পর্যটক এসেছিলেন যা জিডিপির ২৪.৭ শতাংশ। করোনা ভাইরাস সংক্রমিত হওয়ার ফলে পর্যটক কমে যাওয়ায় বিশ্বে কর্মসংস্থানে নেতিবাচক প্রভাব পড়া শুরু হয়ে গেছে।
বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণ পর্যটনে করোনা ভাইরাসের ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। বিভিন্ন হোটেল, মোটেল, রির্সোট বুকিং বাতিল হয়েছে ৫০ শতাংশ অধিক। ট্যুর অপারেটরদের ব্যাবসায় নাই বলে চলে। ইতোমধ্যে দেশের মানুষ বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্রে ভ্রমণ পরিকল্পনা বাতিল করেছেন এমনকি ভিড় এড়িয়ে চলতে গুগল অ্যাপের ব্যবহার শুরু করেছেন। কোভিড-১৯ এর প্রভাবে বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণ ও আর্ন্তজাতিক পর্যটনে ব্যাপক ধস নেমে এসেছে, ইতোমধ্যে মানুষ দেশের এক স্থান থেকে অন্যস্থান ভ্রমণ পরিকল্পনা বাতিল করেছেন এবং গণপরিবহন ও ভীড় এড়িয়ে চলছেন।
এতে পর্যটন সংশিষ্ট সবরকমের ব্যবসায় পড়েছে নেতিবাচক প্রভাব। সমগ্র অর্থনীতি যেমন বাধাগ্রস্থ তেমনি বিশ্ব পর্যটন প্রায় স্থবির। পর্যটন শিল্প হুমকির মুখে পড়ায় বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার কবলে পতিত হচ্ছে। তবে করোনা ভাইরাসে আতঙ্কিত না হয়ে তা মোকাবেলায় সচেষ্ট হওয়া দরকার। পরিস্থিতির প্রতি নজর রেখে, সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে, তবেই বাঁচবে পর্যটন শিল্প- আসবে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)