ভ্যাট নিয়ে সরকারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে রাজপথে আন্দোলন করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সফল হলেও তাদের বিশ্ববিদ্যালয়েই নিজস্ব অনিয়ম-দুর্নীতি কম নয়। তাদের মুখেই যেমন এসব অনিয়মের কথা উচ্চারিত হয়, তেমনই ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)’র প্রতিবেদন থেকে শুরু করে প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতায় উঠে এসেছে ওইসব অন্যায়-অনিয়মের কথা। উচ্চশিক্ষায় দেশের সবচেয়ে বড় এ খাতটিকে নিয়ম-নীতির মধ্যে আনতে তাই শতভাগ নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা চায় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)।
দেশের দুর্নীতির নিয়মিত চিত্র তুলে ধরা টিআইবির গবেষণায় অবৈধভাবে অসংখ্য ক্যাম্পাস গড়ে তোলা, অনিয়ন্ত্রিত টিউশন ফি গ্রহণ, যথাযথ শিক্ষা না দিয়েই সার্টিফিকেট দেওয়াসহ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আরো নানা অনিয়মের কথা উঠে এসেছে।
আর দশম জাতীয় সংসদের সপ্তম অধিবেশনের সমাপনী বক্তব্যে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামো এবং অনিয়ম নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যে টিউশন ফি নেয়, তার কোনো হিসাব-নিকাশ নাই।
একটি বিল্ডিংয়ে যেভাবে একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় চলে তাতে সেগুলোকে বিশ্ববিদ্যালয় বলা যায় কিনা সেই প্রশ্নও তুলেন প্রধানমন্ত্রী।
তার বক্তব্যের প্রমাণ পাওয়া যায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের হালচাল নিয়ে টিআইবির প্রতিবেদনে।
অবৈধভাবে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৪০টিরও বেশি ‘আউটার ক্যাম্পাস’ পরিচালনা করার কথা বলা হয়েছে সেখানে। সরকারি আদেশে কিছু বন্ধ ঘোষণা করা হলেও, কেউ কেউ ‘ভর্তি ও পরামর্শ কেন্দ্র’-র নামে আউটার ক্যাম্পাস চালু রাখছেই।
প্রতিবেদনে ক্লাস না করিয়ে, পরীক্ষা না নিয়ে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে জনপ্রতি তিন লাখ করে টাকার বিনিময়ে সনদ প্রদানের কথা বলা হয়। নির্ধারিত টিউশন ফি’র চেয়ে বেশি টাকা আদায় এবং ইউজিসিকে না জানিয়ে তহবিলের টাকা ট্রাস্টি দ্বারা ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার এবং ব্যবসায় খাটানোর প্রমাণও পাওয়া গেছে।
শুধু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নয়, শিক্ষক ও সেখানে পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের অনিয়মের কথাও উঠে আসে টিআইবির গবেষণামূলক প্রতিবেদনে।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের ইউজিসির নির্দেশনা অনুসারে দুটির বেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো নিষিদ্ধ থাকলেও তা মানেন না অনেকে। পাঠদান না করে শিক্ষার্থীদের ডিগ্রি দিতে কর্তৃপক্ষকে সহায়তা ও অর্থ গ্রহণ, শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে উপঢৌকন ও নগদ অর্থ গ্রহণ করে পাশ করিয়ে দেয়ার অভিযোগও আছে তাদের বিরুদ্ধে।
আর শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ: পাঠগ্রহণ না করে বা পরীক্ষা না দিয়ে সার্টিফিকেট নিয়ে পরে চাকরি বা পদোন্নতির কাজে সেটা ব্যবহার করা। শিক্ষকদের নম্বর বাড়িয়ে দেয়া বা পাশ করানোর জন্যও চাপ প্রয়োগ করে অনেক শিক্ষার্থী। এমনকি গবেষণা জরিপে শিক্ষকদের অন্যায়ভাবে চাকরিচ্যুতির ক্ষেত্রে অনেক শিক্ষার্থী ভূমিকার প্রমাণও পাওয়া যায়।
আর কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ শিক্ষকদের বেশি নম্বর দিতে বাধ্য করা।
‘যে শিক্ষার্থী শতকরা ৪০ নম্বরও পাওয়ার যোগ্যতা রাখে না তাকে ৮৫ পর্যন্ত দিতে হয়। কর্তৃপক্ষ থেকে বলা হয়, তা না হলে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেলেমেয়েরা থাকবে না, তারা অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যাবে,’ এমনটাই বলছিলেন একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের খণ্ডকালীন এক শিক্ষক।
টিঅিইবির প্রতিবেদনসহ বিভিন্ন সময় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপক্ষে যেসব অভিযোগ উঠে তার সঙ্গে একমত বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান প্রফেসর মোহাব্বত খান।
চ্যানেল আই অনলাইনকে তিনি বলেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ উঠে আসছে সেগুলো আমরা নিজেরাও জানি। এ ব্যাপারে আমরা আলোচনাও করেছি অনেকের সঙ্গে। শিক্ষামন্ত্রী বিষয়টি নিয়ে আমাদের সঙ্গে বসতেও চেয়েছেন।
‘সবগুলো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় না হলেও বেশিরভাগ প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিই নানা সমস্যায় জর্জরিত। সেসব সমস্যা চিহ্নিত করতে আমরা না জানিয়েই অনেক বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শন করছি। তাতেও কি শেষ রক্ষা হচ্ছে? আমাদের যে জনবল তা দিয়ে সব কাজ করা সম্ভবও হচ্ছে না।’
তিনি বলেন: সবচেয়ে বড় কথা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের হাতে কোনো ক্ষমতা নেই। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো অনিয়মের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে গেলে তারা আদালতের দ্বারস্থ হন। তাই চাইলেও ইউজিসি অনেক পদক্ষেপ নিতে পারে না।
সমস্যার সমাধানে দুটি প্রস্তাব করেছেন তিনি: প্রথমতঃ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের হাতে পুরোপুরি দায়িত্ব দিতে হবে। পাশাপাশি আমরা যদি সবগুলো সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাঙ্কিং করতে পারতাম তাহলে হয়তো ভালো করে বুঝতে পারতাম আমাদের কোথায় কোথায় সমস্যা আছে এবং কী কী সমস্যার সমাধান করতে হবে।
তবে ইউজিসি যে ক্ষমতার কথা বলছে সেটা তাদের আছে বলেই জানিয়েছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ড. গোলাম রহমান চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেছেন, দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্বায়ত্ত্বশাসিত আর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চলে ট্রাস্টি বোর্ডের মাধ্যমে।
‘এখন ইউজিসি যদি কিছু একটা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে সেটা তাদের ক্ষমতাহীনতার জন্য না। সেটা তারা লোকবলের অভাবে পারে না,’ বলে মন্তব্য করেন ড. গোলাম রহমান।
একইরকম মনে করে টিঅাইবি। তবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০ সংশোধন করে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় বোর্ড অব ট্রাস্টি ও একক ক্ষমতার সুযোগ নিয়ন্ত্রণ করার পাশাপাশি নিজস্ব নীতিমালা প্রণয়ন করে ইউজিসির জনবল ও আর্থিক সক্ষমতা বাড়ানো এবং ইউজিসির এখতিয়ার বাড়িয়ে নিয়ম লঙ্ঘনে দ্রুত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ নিশ্চিত করার সুপারিশ তাদের।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে টিআইবির আরো কিছু সুপারিশ আছে: বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনের পূর্ণ বাস্তবায়ন করার জন্য বিধিমালা প্রণয়ন, এ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিল গঠন করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গুণগত মান উন্নয়নে সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করা, সব ধরনের আউটার ক্যাম্পাস কার্যক্রম বন্ধ করা এবং প্রয়োজনীয় আইনি প্রক্রিয়াকে দ্রুত গতিসম্পন্ন করা, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সার্টিফিকেট বাণিজ্য বন্ধ করতে চূড়ান্ত সনদ দেওয়ার আগে বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষককে সম্পৃক্ত করা, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আর্থিক কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা, ভিসি, প্রো-ভিসি এবং অন্যান্য পদে নিয়োগ প্রক্রিয়া সহজ ও দ্রুতগতির করা, সাধারণ তহবিল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা সংক্রান্ত উন্নয়নে বিনিয়োগ নিশ্চিত করা ও তার পূর্ণাঙ্গ বিবরণ ইউজিসিতে নিয়মিত পাঠানো বাধ্যতামূলক করা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন ও অন্যান্য সুবিধা এবং ছাত্র বেতন ও অন্যান্য ফি সংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন করা।