দেশের নষ্ট রাজনীতির বিকারগ্রস্তাতার নতুন এক উপসর্গ দেখা দিয়েছে। বিকারগ্রস্তাতার সংস্কৃতি এখন এমন এক মাত্রায় পৌছেছে যে, আমাদের তথাকথিত ফেসবুক সেলেব্রেটিরা রীতিমত স্যোশাল মিডিয়ায় ঘোষণা দিয়ে স্বগর্বে জানান দিচ্ছেন তাদের নীচতার। যেন প্রতিযোগিতা চলছে কে কার নীচতাকে, ভোট লুটের বিভৎসতাকে সমর্থনে ছাড়িয়ে যেতে পারেন। উদ্বেগের কথা হলো এই নীচতার, বিকারগ্রস্তাতার মাত্রা দিয়ে তারা আবার নিজের দলের, নেতার প্রতি আনুগত্যের পরীক্ষা দিচ্ছেন।
রাজনীতির নামে নীতিহীনতার, দলান্ধ আনুগত্যের দাসত্ব আমাদের রীতিমত অন্ধ করে দিয়েছে। আমরা ভুলে যাচ্ছি আমাদের সামাজিক সংস্কৃতির সৌন্দর্যের ঐতিহ্যে। সামাজিক, রাজনৈতিক ভারসাম্য বিহীনতায় বাস করতে করতে আমরা সম্ভবত বিবেকের জায়গাটুকু ঢেকে ফেলছি, ব্যক্তি স্বার্থের-সুবিধার প্রাচীরে।
বাংলাদেশের মানুষ বিশ্বের দেশে দেশে সহমর্তিতা, মমতা নিয়ে অন্য দেশের মানুষের পাশে দাঁড়ান। আমি যে দেশটিতে থাকি, সেই ব্রিটেনে নানা জালিয়াতি, ধান্ধাবাজি, জোচ্চুরির জন্য পাকিস্তানীদের ব্রিটিশ শ্বেতাঙ্গরাও সকৌতুকে ‘পাকি’ নামে আড়ালে আবডালে ব্যঙ্গ করে ডাকে। কিন্তু, জাতি হিসেবে বাঙালির এরকম বদনাম নেই দুনিয়ার কোনো দেশে।
অথচ, সেই দেশে আজ আমরা দেখছি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে হাতুড়ি দিয়ে এক তরুণ আরেক তরুণকে পেটাচ্ছে। সে ছবি যখন সোশাল মিডিয়ায় আসছে তখন একটি পক্ষ গত জোট সরকারের আমলের সন্ত্রাসের ছবি ফেসবুকে পাল্টা পোষ্ট দিয়ে বলছে, পেটাও। মাহমুদুর রহমানকে কুষ্টিয়ায় ছাত্রলীগ হামলা করার পর জোট সরকার আমলে প্রয়াত সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত বা মতিয়া চৌধুরীকে রাজপথে পুলিশের নির্যাতনের ছবি পোষ্ট করা হচ্ছে। ষ্ট্যাটাসে স্বদম্ভে বলা হচ্ছে, “জোট সরকার আমলে তো এভাবে পেটানো হয়েছিল, এখনে তো কম পেটানো হচ্ছে।”
যারা এগুলো লিখছেন, পোষ্ট করছেন, অবাক করবার বিষয় হলো, এদের অনেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বচ্চো ডিগ্রিধারী।
আমরা আসলে যতটা বিস্মিত হই, তার চেয়ে বেশি হই হতবাক।
ডিমরালাইজেশন, ইনফিলট্রেশন বা প্রোপাগান্ডা, শিক্ষার মান ও সামাজিক মুল্যবোধের অবক্ষয়, ক্ষমতাকেন্দ্রিক সমাজব্যবস্থা, কনফ্লিক্ট রেজুলেউশন বর্তমান সমাজ ব্যবস্থাকে এ পর্যায়ে নিয়ে গেছে। দেশে এখন এমনই ভয়াবহ মাত্রায় একদল চাটুকারের সৃষ্টি হয়েছে, যারা ব্যাংক লুট, সন্ত্রাস, শিক্ষা আর অর্থনীতির অবনতি, উন্নয়নের নামে লুটপাট সবকিছুতে ভালো দেখেন। তারা মাহমুদুর রহমানকে পুলিশের সামনে পেটানো, ছাত্রদের হাতুড়িপেটা সবকিছুকেই ‘ন্যায় বিচার’ হিসেবে দেখেন। তাদের ব্যাখ্যা থাকে, মাহমুদুর রহমান তো ব্লগার হত্যার উস্কানিদাতা, তাকেও এভাবে হত্যা করাই সমীচিন ছিল! সরকারের অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলাই মানে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী, জঙ্গিবাদকে সমর্থনকারী। কি ব্যাখ্যা সরকারের পোষ্যপুত্রদের!
এখন সরাসরি ঘোষণা দিয়ে অদ্ভুত এক বিকারগ্রস্ততাও দেখছি। দেশে এখন প্রজন্মের মধ্যে কৌশলে ঢুকিয়ে দেখা হয়েছে বৈষম্য, বিভেদ আর ঘৃণার মন্ত্র। কোনো মানুষকে রক্তাক্ত করলে, পিটিয়ে আহত করলে তাতেও দেশে দুটি পক্ষের সৃষ্টি হয়। একপক্ষ সমবেদনা জানান, অন্য পক্ষটি বিভৎস, পৈশাচিক আনন্দ পান। পৈশাচিক বিকৃত আনন্দ পাওয়া লোকগুলি তখন বলে, বিএনপি-জামাতের আমলে তো এরচেয়ে খারাপ করা হয়েছিল। সেই দিনের বদলা…।
হায়রে ঘৃণা, সে কী বিদ্বেষ! দেশে এখন জনগণের ভোটের অধিকার নেই। ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে গিয়ে দেখেন, তাদের ভোটটি দেওয়া হয়ে গেছে। যাদের বয়স এখন উনিশ-বিশ বা বাইশ; দেশের তারুণ্যের সে প্রতিনিধিরা এখন আর কোনো নির্বাচনে তাদের ভোটে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত করতে পারেন না।
সিলেটের আজকের ভোটের আগে আমরা দেখলাম, ৩৯ মামলার আসামী জামায়াত প্রার্থী বিপুল বিক্রমে নির্বাচন করছেন। হাজার হাজার জামায়াত শিবির কর্মী মাঠে। অথচ এই জামায়াত শিবিরের নেতারা রাজনীতি তো দূরে থাক, স্বাভাবিক চলাফেরাও বহুকাল করতে পারেননি। সিলেটে নির্বাচনের আগে আমরা দেখলাম, হাইকোর্টের নির্দেশনা থাকার পরও বিএনপির নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করা হলেও জামায়াতের ব্যাপারে ব্যাতিক্রম!
সিলেট সিটিতে এখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার রাজনীতি করা দলটির সাথে জামায়াত শিবিরের গোপন সমঝোতার গুঞ্জন ডালপালা মেলছে। এই যে আদর্শের নামে প্রবঞ্চনা, ভয়াবহ দেউলিয়াত্ব, অনৈতিকতা; আশ্চর্যের বিষয় হলো এটাকেও অনেকে জাষ্টিফাই করার চেষ্টা করছেন। অনেকে এই রাজনৈতিক লাস্পট্যের মধ্যেও দেশের অগ্রযাত্রা, গণতন্ত্রের বিকাশের ঘনঘটা দেখছেন! ফেসবুকে তার স্ব-পক্ষে যুক্তি তুলে ধরছেন। কী চমৎকার!
বাংলাদেশে একসময় সুষ্ঠ নির্বাচনের ঐতিহ্য ছিল। আজকের বাস্তবতায় তা কেবল ইতিহাস। বেশি উন্নয়ন আর কম গণতন্ত্রের নাম ভাঙ্গিয়ে কেড়ে নেয়া হয়েছে জনতার ভোটাধিকার। তাতেও দেশে অনেকে জনগণের কল্যাণ দেখছেন। বেহায়া বাক্যে, শব্দের চাতুরিতে সেটাকে সমর্থন করছেন।
আর সেই পুরনো ব্যাখ্যা তো আছেই। “বিএনপি-জামাতও তো বিষ্টা খেয়েছিল ঐ ঐ ক্ষেত্রে…, আর আমরা খেলেই অসুবিধা!”
বিশ্ববাস্তবতার নিরিখে নিগুঢ় সত্যের কথা বলি। পরিবর্তনের পদধ্বনি কিন্তু দুয়ারে। সমাজতন্ত্রী কাল মার্কসের জন্মের দুই শতক পর সমাজতন্ত্র বা কমিউনিজমের কী পরিণতি দেখছি আমরা? রাশিয়া বা পুর্ব ইউরোপের দেশগুলো যেখানে এ ধারার বিকাশ ও চর্চা ছিল, তা কিন্তু মুছে গেছে। অথচ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশ, যেখানে পুজিঁবাদের উগ্র উত্থান, সেখানে আজ পালে হাওয়া পাচ্ছে বামপন্থা। আমেরিকা এক সময় সমাজতন্ত্রের নিশানা সমাজ থেকে মুছতে কী না করেছে! দুঃখিত,পাঠক আমাদের উপত্যকায় ও যে সমাজতন্ত্র আসছে, আসবে সে অনুমানে আমি একথা বলছি না। বলছি এ কারণে যে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট যখন স্বদম্ভে পুজিঁ আর পেশীর জোরের জানান দিচ্ছেন তার স্বভাবের নগ্নতায়, প্রকাশের বিভৎসতায়। ঠিক তখনই আমেরিকার ১৮ থেকে ২৯ বছর বয়সী ৫১ শতাংশ মার্কিনী বলছেন, তারা ধনতন্ত্র বা পুজিঁবাদের সমর্থক নন। দেশটিতে এখন ধনতন্ত্রী মানুষের সংখ্যা মাত্র ৪২ শতাংশ। আমি নই, হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ের জরিপ তথ্য বলছে একথা।
কোন সময়ে,সমাজে, রাষ্ট্রে যখন কম গণতন্ত্র আর বেশি উন্নয়নের সরকারি অসভ্যতা আসে, রাজনীতির ক্ষমতায়ন যখন পুরোপুরি অসভ্যদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়, তখন পরিবর্তন আসলে এভাবেই অবশ্যম্ভাবী হয়ে দাঁড়ায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মানুষের মতো দেশে দেশে জনগণ তখন চলতি স্রোতের বিপরীত ধারাটিকেই বেছে নেন। এবং তা করেন প্রবল যাতনা, বেদনা থেকে নিহিত পরিবর্তনের সুতীব্র প্রয়াস থেকে। তবে জনতার পরির্বতনকামী আগ্রহের বিস্ফোরণের ফলাফল সব সময় ইতিবাচক হয় না। কখনো কখনো তা আত্মঘাতীও হয়, সে শিক্ষা ইতিহাসের।
তবে পরিবর্তন আসে, প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মের পথ ধরে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)