সীমান্ত নিয়ে রিপোর্টিংয়ে বরবারই আমার আগ্রহ বেশি। সেই আগ্রহ থেকেই পেশাগত দায়িত্ব পালনে দেশের নানা সীমান্ত ঘুরে বেড়িয়েছি। বাংলাদেশের সীমান্ত পিলারে পাকিস্তান শব্দ টিকে থাকা, বাড়ির উঠানে কাঁটাতার, ছিটমহলের সুখ-দুঃখ, এমনকি এগারো রাত সীমান্তে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পড়ে থেকে গরু পাচার নিয়ে রিপোর্ট করার অভিজ্ঞতাও আছে। স্বভাবতই সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবির সাথেও জানাশোনা আছে। কিন্তু দেশের সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত স্থলবন্দর বেনাপোলে পাসপোর্টধারী যাত্রী হিসেবে যাতায়াতের অভিজ্ঞতায়, বিজিবির “আতিথেয়তা” মোটেও সুখকর নয়। সুখকর হয়েছে এমন কারো সাথে আজ পর্যন্ত পরিচয়ের সৌভাগ্য হয়নি।
সীমান্ত রক্ষা ও চোরাচালান রোধে বিজিবির ভূমিকা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। কিন্তু বেনাপোলে বিজিবির আচরণ ও তল্লাশির ধরন নিয়ে ইতিবাচক কিছু লেখা খানিকটা কষ্টকর। তাও একবার নয়, যাত্রার ধকল পেরিয়ে, দুই দেশের ইমিগ্রেশন কাস্টমস পার করে আসার পরও দুবার বিজিবির “আতিথেয়তা” নিতে হয়। একবার ঠিক বন্দর ভবনের সামনে, আরেকবার আমড়াখালীতে। বাণিজ্যিকভাবে যারা পণ্য আনেন, তাদের কথা বলছি না, সাধারণ পাসপোর্টধারী যাত্রীরা যে হয়রানির সম্মুখীন হন, তাতে বাহিনীটির সাফল্য খানিকটা ফিকে হয় বৈকি।
সংক্ষেপে নিজের অভিজ্ঞতাটুকু আগে বলি। ১৯ আগস্ট দুপুর আনুমানিক একটায় যখন পেট্রাপোল বন্দর হয়ে হরিদাসপুর সীমান্ত পার হয়ে বেনাপোল বন্দরে পৌঁছাই, তখন ট্রেন ধরা নিয়ে মাথায় রাজ্যের টেনশন। একটার ট্রেন। জানতাম আধাঘণ্টা বিলম্ব হবে। হাতে সময়ও ছিল আধাঘণ্টা। তিন বছর বয়সী পুত্র না খাওয়া সকাল থেকে। কাহিল হয়ে স্রেফ স্ত্রীর কাঁধে পড়ে আছে। সাথে ছোট ভাই, এক সহকর্মী আর তার স্ত্রী। পাঁচজনের পাঁচটা লাগেজ। বন্দর থেকে কাস্টমসে সব লাগেজ স্ক্যান করে বেরিয়েই ম্যানেজ মাস্টারদের ফিসফাস, বিজিবি সেট করে দেই? ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে এগিয়ে গেলাম। সেটাই কাল হলো। ছোট্ট টেবিলে তৈরি “চেকপোস্টে” দুজন সৈনিক প্রতিটি যাত্রীর প্রতিটি লাগেজ চেক করছেন। তবে কারো লাগেজ যে টেবিল অবদি পৌঁছায়ই না তা চোখ এড়ালো না। আমি অনুরোধ করলাম বাচ্চাটা অসুস্থ, ট্রেনটাও মিস করবো। আমি অবৈধ কিছুই আনিনি। তাতে মন গললো না। অগত্যা প্রতিটি লাগেজ চেক করে কিছু না পেয়ে ছেড়ে দিলো। কোনোভাবে ভ্যানে করে স্টেশন পৌঁছালাম। ভাগ্যিস ট্রেন আরও বিলম্ব ছিলো। তবে যারা বাসে ফেরেন তাদের বন্দর থেকে দুই কিলোমিটার দুরেই পুনরায় আমড়াখালী চেকপোস্টে আরেক দফা বিজিবির তল্লাশির মুখে পড়তে হয়। অতীতে সেখানকার অভিজ্ঞতাও সুখকর নয়।
এবার আইনের কথায় আসা যাক। বিজিবি কোন আইনের বলে এভাবে ব্যাগ চেক করে? কাস্টমস আইন ১৯৬৯ এর সেকশন ৬ এর সাব সেকশন ১ এ বলা আছে: “কাস্টমস কর্মকর্তাগণের দায়িত্ব কতিপয় অন্য কর্মকর্তাগণের উপর অর্পণ। বোর্ড, সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা, শর্ত সাপেক্ষে অথবা বিনা শর্তে, এই আইনের অধীন কোনো কাস্টমস কর্মকর্তার যেকোনো দায়িত্ব অন্য কোন সরকারি কর্মকর্তার উপর অর্পণ করিতে পারিবে।”
এই আইনের বলে ২০১৭ সালের ১৫ নভেম্বর আদেশ জারি করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। তাতে চারটি শর্ত সাপেক্ষে বিজিবি সদস্যদের চোরাচালানবিরোধী কার্যক্রম পরিচালনার জন্য কাস্টমস আইন ১৯৬৯ এর ছয়টি ধারার ক্ষমতা অর্পণ করে। এই ছয়টি ধারার প্রথম ধারা ১৫৮ তে “যুক্তিসঙ্গত কারণে তল্লাশির ক্ষমতা” দেয়া হয়েছে। বাস্তবতা হলো বিজিবির যে সদস্যরা টেবিল চেকপোস্টে দায়িত্ব পালন করেন তারা প্রতিটি যাত্রীর প্রতিটি লাগেজ বা ব্যাগেই তল্লাশির যুক্তিসঙ্গত কারণ খুঁজে পান। তদুপরি তাদের যা ব্যবহার তাতে যাত্রীরা নিজেরাই নিজেদের চোর অনুভব করেন। বিজিবির ওপর অর্পিত ক্ষমতার ধারাগুলোর ১৫৯ এ বলা আছে: তল্লাশি করা হইবে এইরূপ ব্যক্তি তাহাকে গেজেটেড কাস্টমস কর্মকর্তা অথবা ম্যাজিস্ট্রেটের সম্মুখে নেওয়ার অভিপ্রায় ব্যক্ত করিতে পারিবেন। আমি এইরূপ অভিপ্রায় ব্যক্ত করার পর তাদের হাবভাব এবং চাহনিতে মনে হয়েছে আমি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের নয়, বরং ভিনগ্রহের কোনো দেশের আইনের কথা বলেছি। আর বাস্তবতার নিরিখে সেই সুযোগটাই বা তারা কই রেখেছেন?
কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স নিয়ে বের হওয়ার ঠিক পরপর বিজিবির এই চেকপোস্টের প্রয়োজনীয়তা কতোটুকু? এমন প্রশ্ন নিয়ে অনেকবারই বিতর্ক হয়েছে, কিন্তু তাতে হয়রানি কমেনি সিকিভাগও। তল্লাশি করার বিপক্ষে নয় সচেতন কেউই। কিন্তু সেই তল্লাশির নামে হয়রানি, অসদাচারণ কোন আইনের বলে? প্রতিটি যাত্রীর প্রতিটি লাগেজেই সন্দেহ খুঁজে পাওয়ার মানে কি? কাস্টমসের ওপর ভরসা নেই বিজিবির। কাস্টমস ধোয়া তুলসি পাতা নয়। কিন্তু বেনাপোলে লাগেজ স্ক্যানের ব্যবস্থা থাকায় এখন আর প্রতিটা লাগেজ খোলার মতো হয়রানি হয় না শুল্ক বিভাগে। শুধুমাত্র সন্দেহজনক ব্যাগই তল্লাশি করা হয়। আইনি ভাষায় যুক্তিসঙ্গত কারণে। কিন্তু বিজিবির যে সদস্যরা তল্লাশি করেন, তাদের আচরণই প্রথম আপত্তির কারণ যাত্রীদের কাছে। তথাপি হাজার হাজার যাত্রীর জন্য বন্দরের গেটের ঠিক বাইরে, অনেকটা রাস্তার ওপর ছোট্ট একটা টেবিলে দুতিনজন সদস্য কতোটাই বা চেক করতে পারবেন? যাত্রীদের বেশভূষা দেখেওতো আন্দাজ করা যায় কে চোরাচালানকারী হতে পারেন কে পারেন না। যদিও তা কপালে লেখা থাকে না। তাই বলে সব যাত্রীকেই চোরাচালানকারী সন্দেহে ব্যাগ তল্লাশির যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যেতেই পারে। আর যদি করতেই হয় তাতে প্রথমেই শৃঙ্খলা আনা জরুরি। উপরন্তু দায়িত্বরতদের আচরণ সংযত করার কোনো বিকল্প নেই। কোনো আইনই একজন নাগরিককে অসম্মান, হেনস্থা করার অধিকার দেয় না।
যাত্রীদেরও নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হওয়া প্রয়োজন। স্থলপথে দেশে আসা পাসপোর্টধারীরা অধিকাংশই আইন তথা নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন নন বলেই, কাস্টমস এবং বিজিবিকে হয়রানির সুযোগ দেন। একজন বাংলাদেশি যখন স্থলপথে দেশে ফিরবেন তখন তিনি কি আনতে পারবেন কতোটুকু আনতে পারবেন তা আইনে সুস্পষ্ট। “যাত্রী (অপর্যটক) ব্যাগেজ (আমদানি) বিধিমালা, ২০১২” এর ধারা ৪ অনুযায়ী “বিদেশে অবস্থানের মেয়াদ নির্বিশেষে স্থলপথে আগত একজন যাত্রী সর্বোচ্চ [৪০০ (চারশত)] মার্কিন ডলার মূল্যের ব্যাগেজ সকল প্রকার শুল্ক ও কর পরিশোধ ব্যতিরেকে আমদানি করিতে পারিবেন। তবে শর্ত থাকে যে, উক্তরূপ সুবিধা একজন যাত্রী এক পঞ্জিকা বৎসরে ৩ (তিন) বারের অধিক প্রাপ্ত হইবেন না”। তবে তফসিলভুক্ত পণ্যের ক্ষেত্রে পরিমাণ নির্দিষ্ট করে দেয়া আছে। এখন একজন যাত্রী যদি ডলার কেনা রশিদ, ডলার ভাঙানোর রশিদ এবং পণ্য ক্রয়ের রশিদ সাথে রাখেন তাতে আইন অনুযায়ী-ই তাকে কিছু বলার এখতিয়ার রাখেন না কেউই, সে কাস্টমসই হোক আর বিজিবিই হোক। যেহেতু এটা অধিকাংশ যাত্রীই জানেন না, ফলে হয়রানির সুযোগ তৈরি হয়।
হয়রানিমুক্ত হতে স্পিড মানির ব্যবহারও “জায়েজ” হয়। তবে নিজের অভিজ্ঞতা থেকে সন্দেহ করতে পারি, বিজিবির যে সদস্যরা চেকপোস্টে চোরাচালান রোধের মহান দায়িত্ব পালন করেন তারা এই ব্যাগেজ রুলস জানেন কিনা? সন্দেহের কারণ হলো বছর তিনেক আগে বিজিবির যশোর রিজিয়নের একজন কর্মকর্তা সাথে এই ব্যাগেজ রুলস নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ বাদানুবাদ হয়েছিলো আমার। পরে একদিন তিনি ফোন করে ব্যাগেজ রুলসের কপিও চেয়ে নিয়েছিলেন। তখন ভেবেছিলাম হয়তো অবস্থার উন্নতি হবে। কিন্তু সে আশায় গুঁড়েবালি।
এই তল্লাশি কার্যক্রম নিয়ে বিজিবি কাস্টমস দ্বন্দ্ব বেশ পুরনো। সরকারি বেসরকারি বহু বৈঠকে স্রেফ এই বেনাপোলে বিজিবির কার্যক্রম নিয়ে তর্ক-বিতর্ক হয়েছে। সিএন্ডএফ এজেন্টরা ধর্মঘট করেছেন বহুবার। কিন্তু যাত্রীদেরতো আর অ্যাসোসিয়েশন নেই। তাই মুখ বুজে সহ্য করাই একমাত্র উপায়। প্রতিবাদ করে উপরি বিপদ ডেকে আনতে কেইবা চাইবে। কাস্টমস বিজিবি দ্বন্দ একাধিকবার প্রকাশ্যে এসেছে। এমনকি সিলেটের তামাবিল সীমান্তে এই দুই সংস্থা সদস্যদের মধ্যে মারামারি হওয়ার নজিরও আছে। আর বিভিন্ন সময় আলাপে দুই সংস্থার কর্মকর্তাদের মুখে একে অপরকে দোষারোপ করতে শোনার অভিজ্ঞতা হয়েছে আমার একাধিকবার।
সম্ভবত এই দ্বন্দেরই বলি হন সাধারণ যাত্রীরা। নচেত, যাত্রীদের ওপর এতো ক্ষোভ থাকার কারণ দেখি না। বেনাপোলে বিজিবির তল্লাশিতে সাপের বিষ, হুন্ডির অর্থ, সোনা, মাদক এসব উদ্ধারের ভুরি ভুরি সাফল্যমণ্ডিত উদাহরণ দেয়া যাবে। কিন্তু তার অধিকাংশই গোপন সংবাদের ভিত্তিতে চালানো অভিযানের ফসল। ডিজিটাল বাংলাদেশে এখনও যদি ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে লাগেজ হাতড়ে চেক করে চোরাচালানকারী ধরতে গিয়ে সাধারণ মানুষকে হয়রানি হতে হয়, তা দুঃখজনক। আর প্রতিজনকে চেক করেই যদি অপরাধী ধরতে হয় তাতে গোয়েন্দা তৎপরতা বোধহয় প্রয়োজনীয়তা হারায়। বাংলাদেশ রাইফেলস থেকে অন্ধকার এক অধ্যায় কাটিয়ে উঠে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ হয়ে ওঠা চৌকস বাহিনী বিজিবির কাছে একজন নাগরিক হিসেবে এতোটুকু অনুরোধ তো করতেই পারি যে, আমাদের সবাইকে চোর ভাববেন না।
আঠারো শতকের প্রখ্যাত ব্রিটিশ বিচারক ও সংসদ সদস্য স্যার উইলিয়াম ব্ল্যাকস্টোনের একটি উক্তি দিয়ে শেষ করবো, যা ব্ল্যাকস্টোন রেশিও নামে পরিচিত। তার “Commentaries on the Laws of England” বইয়ে তিনি লিখেছেন, “It is better that ten guilty escape than that one innocent suffer.
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)