সময়ের কথক বলা যায় তাকে। যার কথা বলার মাধ্যম সিনেমা। অপার কৌতুহলে সমকালীন বাস্তবতার ভিজ্যুয়াল ধারণ করে চলেছেন তিনি। সেই কৌতুহলই হয়তো তার সিনেমার চরিত্রদের মতো কখনো কখনো জটিল উদ্যানে ফেলে দেয় তাকে। দমে যান না। ফাঁক গলে পৌঁছে যান মানুষের ভালোবাসার ডেরায়। সৃষ্টি সেখানে কথা বলে উঠে। বলছি, থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার, টেলিভিশন, ডুব এর নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর কথা।
১ জানুয়ারি দুপুর। বিগত হয়ে যাওয়া বছরের সূত্র ধরে কথা হয়, মুঠোফোনে। কথায় কথায় বলছিলেন, সেই মুহূর্তে তিনি দুপুর রোদের বারান্দায় আলস্য পোহাচ্ছেন। দুপুরের এই মিস্ট্রি রোদ, হয়তো এ কারণেই এই মুহূর্তে নির্মাতা ফারুকীর চেয়ে ‘কবি ফারুকী’ ধরা পড়েন। আলাপে। নতুন বছরের শুরুর দিনে তার সঙ্গে সেই আলাপের কিছু অংশ থাকলো চ্যানেল আই অনলাইনের পাঠকদের জন্যও:
হ্যাপি নিউ ইয়ার…!
হ্যাপি নিউ ইয়ার।
নতুন বছরের প্রত্যাশার কথা যদি জানতে চাই। মানে আপনার রেজ্যুলেশন?
নতুন বছরে নতুন কোনো কাজ করবো। যে কাজটা আমি আগে করিনি। নতুন কোন পথে হাঁটবো, যে পথে এর আগে হাঁটিনি। ওই কাজটা হবে একেবারেই নতুন।
আপনি করেননি এরকম নতুন কাজ কি তাহলে ওয়েব সিরিজ, এরকম কোনো ইঙ্গিত?
আমি জানি না সেটা (হেসে উত্তর দিলেন)! তবে এটুকু বলতে পারি নতুন কিছু করতে যাচ্ছি। কাজ সম্পন্ন হওয়া একাধিক সিনেমা আপনার হাতে। ‘শনিবার বিকেল’ এর মুক্তির কোনো খবর আছে?
‘শনিবার বিকেল’ নিয়ে আমি কিছু বলতে চাই না, কারণ এটা নিয়ে বললে আমার প্রচণ্ড রাগ হয়। রাগটা প্রকাশ করতে চাইনা, আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছি। এর চেয়ে বড় বেদনার কিছু নাই। এই ‘বেদনা’ শব্দটা নিয়েই আমাদের বসবাস।
কিছু তরুণ ‘শনিবার বিকেল’ মুক্তির পক্ষে জনমত গঠন করার কাজ করছে?
আমাকে বলল ওরা ‘শনিবার বিকেল’ ছবিটির টিশার্ট করছে, প্রতিবাদী কনসেপ্ট। আমি তাদের বলেছি, ‘ঠিকাছে, করতে চাইলে তোমরা করো।’ যেভাবেই হোক, এরাতো অন্তত কথা বলতে চাইছে সিনেমাটা নিয়ে।
‘নো ল্যান্ডস ম্যান’ এর কি ধরনের আপডেট আছে?
এডিটিং শেষ পর্যায়ে আছে। মিউজিক রেকর্ডিংয়ের কাজ প্রায় বিশ থেকে ত্রিশ শতাংশ হয়েছে। সাউন্ড এর কাজ বাকি আছে প্রায় ৭০ শতাংশ। এগুলো হয়ে গেলে সব ফাইনাল করবো।
মাঝখানে আপনার একাধিক বিজ্ঞাপন সাড়া ফেলেছে। বিশেষত জুঁইয়ের বিজ্ঞাপনটি…
বিজ্ঞাপন আমার কাছে ‘ব্রেড এন্ড বাটার’ প্রজেক্টের মত। তবে কখনো কখনো এমন কিছু করার সুযোগ থাকে যেটা মানুষ হিসেবে ব্যক্তিগতভাবে কিংবা ফিল্মমেকার হিসেবে আমাকে এক্সাইট করে। সেরকম কাজ মাঝেমধ্যে আসে, মাঝেমধ্যে সুযোগ হয় তেমন কাজগুলো করার। জুঁই এর বিজ্ঞাপনটা ডেফিনেটলি তেমন একটা কাজ। আকাশ ডিটিএইচ এর কাজটাও এনজয় করেছি, আমি অনেকদিন এই হিউমারটা নিয়ে কাজ করিনি, অনেকদিন পর এরকম হিউমার নিয়ে কাজ করার ফলে একধরনের রিফ্রেশমেন্ট পেয়েছি।
বাংলাদেশের এই মুহূর্তের বিজ্ঞাপনের হালচাল কেমন দেখছেন?
বিজ্ঞাপন নিয়ে এত সিরিয়াস মন্তব্য করার কিছু নাই। বাংলাদেশের বিজ্ঞাপন নিয়ে অবস্থা কী বোঝা যাচ্ছে জানতে চাইলে বলব, ২০০৫ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের বিজ্ঞাপনে বিরাট বাঁকবদলের যুগ ছিল। আমার মনে আছে, তখন ইমোশনাল বিজ্ঞাপনের অনেক নতুন নতুন কিছু বিষয় করতে পেরেছিলাম আমরা, বিজ্ঞাপনের মধ্য দিয়ে হিউমারের নতুন নতুন ভেইন ওপেন করতে পেরেছিলাম। ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টরদের মধ্যে পাল্লা দিয়ে প্রতিযোগিতা চলত, কেউ যদি গ্রামীণফোনের জন্য একটা ভালো এড করেন, তাহলে অন্যজন বাংলালিংকের জন্য একটা ভালো করবে, আবার বাংলালিংকের জন্য অন্য আরেকজন দারুণ বিজ্ঞাপন করলে আরেকজন অন্য আরেকটা বিজ্ঞাপনের জন্য ভালো কিছু করবে- এরকম একটা দারুণ প্রতিযোগিতা তখন ছিল। আমার মনে আছে যে, দর্শকরাও নতুন কী বিজ্ঞাপন ঈদে আসছে, তারজন্য অপেক্ষায় থাকতো। যতদূর মনে পড়ে বাংলাদেশের প্রথম সারির পত্রিকাগুলো এ নিয়ে রিপোর্ট করতো। এবারে আলোচিত বিজ্ঞাপন কোনগুলো? এরকম আরকি। প্রথম আলো রিভিউ পর্যন্ত করত। বাংলাদেশের বিজ্ঞাপনে ওইটা একটা দারুণ সময় ছিল। এখন বোধহয় বিজ্ঞাপন সেই জায়গায় আছে এটা বলা যাবে না, কারণ এখন আগের মত সময় আর প্যাশন দিতে পারে তা নয়, ফলে বিজ্ঞাপন অনেকটা কাস্টমারি পর্যায়ে চলে গেছে। অবশ্য এর জন্য নানা বাস্তবতাও আছে। তো কাস্টমারি যে পর্যায়ে, সে পর্যায়েও মাঝে মাঝে কিছু ভালো কাজ হয়। তবে সেগুলো অবশ্যই হাতেগোনা।
সোশাল মিডিয়ায় মাঝেমধ্যে আপনাকে কবিতা পোস্ট করতে দেখা যায়। তবে কবিতার বই বের করছেন না কেন?
শরমে। আমি জানিনা এটা কেন, কবিতার কথা শুনলেই আমি খুব লাজুক হয়ে যাই। লজ্জাবোধ করি। সারাজীবন আমিও কবিতায় লিখতে চেয়েছিলাম, কিন্তু কখনো নিজের কবিতা কোথাও ছাপতে দেবো, এটা সাহস করে উঠতে পারিনি। তাছাড়া আমি যা লিখেছি সেগুলো কবিতা কিনা, তাও জানিনা। কেউ এগুলোকে কবিতা বলতে পারেন, নাও বলতে পারেন সেটা তার ব্যাপার। আবার মাঝে মাঝে কিছু মনে হলে তা লিখি, কিছু ফেসবুকে প্রকাশ করি, কিছু আমার মোবাইলের নোটসে থাকে। একটা-দুইটা হয়তো আমার একটা বই প্রকাশ হয়েছিলো ‘রাফকাট’ নামে, ওইটাতে আছে।
কবিতার বই বের করব কিনা সেটা, এরমধ্যে অনেক প্রকাশক যোগাযোগ করেছেন। গতবারের আগের মেলাতেও যোগাযোগ করেছেন, গত বছরও করেছেন, এই মেলাতেও করছেন। একজন এটার পেছনে লেগে আছেন, যদিও আমি তাকে আগেই বলেছি আমি মনস্থির করতে পারছিনা, আবার লজ্জা কাটাতে পারলে হয়তো বই ছাপবো, নয়তো না। কবিতার বইয়ের নাম হইতে পারে ‘কবিতার খালাতো বোন’, যেহেতু কবিতা বলতে আমার লজ্জা লাগছে।
আপনার লজ্জা কাটুক দ্রুতই…!
হ্যাঁ সত্যি, ‘কবিতার খালাতো বোন’ – নামে কবিতার বইটি এবছর প্রকাশ হতেও পারে।
শোক বেদনা বিষাদের বছর ছিল ২০২০। শুধু কাজে থমকে থাকা নয়, আপনজন হারানোর বেদনাও আছে। আদিত্য কবিরকে নিয়ে আপনার যে লেখাটা, যে কোন মানুষকে স্পর্শ করে যাবে। নতুন বছরে পা রেখে বিগত বছরকে মনে রাখতে চান কিনা?
বিগত হওয়া বছরকে স্মরণ করতে না চাইলেও, ২০২০ সাল কিন্তু আমাদের জন্য বিরাট বাস্তবতার। এই বছর বোধহয় আমাদেরকে বাস্তবতার কম্পাসটা আরেকবার একটু খেয়াল করিয়ে দিয়েছে। টাইপরাইটারের সময়টায় কিন্তু আমার বড় হওয়া, মানে ছোটবেলা থেকে যখন বড় হই তখন কিন্তু আমরা টাইপরাইটার দেখেছি। আর তারওয়ালা ফোন (ল্যান্ডফোন)। এই তারওয়ালা ফোনে বাবা-মা বা পরিবারের লোকজনদের সামনে মেয়ে বন্ধুদের সাথে কথা বলতে সংকোচ হত আমাদের, এমনকি তারটা বারান্দা পর্যন্ত টেনেও নেয়া যেত না। আমরা সেই যুগে বড় হয়ে ছিলাম। তারপর একটা প্রাযুক্তিক উল্লম্ফন দেখলাম চোখের সামনে, ১০-১২ বছরের মধ্যে। এবং দেখলাম ফোনটা তার ছাড়া হয়ে গেল, শুধু তাই না আমি প্রেমিকার ঘরে ভিডিও হয়ে ঢুকে যেতে পারছি, তেমনি প্রেমিকাও আমার ঘরে ভিডিও হয়ে ঢুকে যেতে পারছে। কত ধরনের জিনিস দেখলাম, গাড়ি আকাশে উড়বে সে গাড়ী রেডি হচ্ছে; আমরা দেখলাম চালকবিহীন গাড়ি (অলরেডি পরীক্ষামূলক টেস্ট হয়ে গেছে)। আমরা দেখলাম মঙ্গল গ্রহে মানব বসতি করার চেষ্টা করা হচ্ছে- এইযে এত কিছু দেখলাম, এবং দেখতে দেখতে হয়তো কোথাও নিজেদের অলক্ষ্যে উপলব্ধি হয়ে গিয়েছিল -আমরা অসীম ক্ষমতার অধিকারী! এবং আমরা এই পৃথিবীকে নিয়ে যা ইচ্ছা তাই করতে পারি। আমাদের ক্ষমতার কোনো সীমা-পরিসীমা নাই। তো সেই সময়ে প্রকৃতি মনে হয় তার নিজের প্রয়োজনেই ছোট্ট করে একটা কলিংবেল বাজিয়ে দিলো। কলিংবেল বাজিয়ে বললো, হ্যালো! এতো যে তোমার উল্লম্ফন, কিন্তু দেখো চোখেও দেখা যায় না এমনই তুচ্ছ এক ভাইরাস তোমাদের দুনিয়াটা থমকে দিলো! তোমাকে ঘরে বসিয়ে দিলো দশ মাস। তোমার বিমানগুলোকে মুখ থুবরে ফেলে দিলো টারমার্কে। সে আমাদের খেয়াল করিয়ে দিলো, যেকোনো মুহূর্তে আমরা চলে যেতে পারি। এই যাওয়া আসাটা অনেকটা স্টেশনে ট্রেনে উঠা নামার মত। এটাই লাইফ। এটা ভুলার কোনো সুযোগ নাই। আমাদের একটু খেয়াল করিয়ে দিল যে, তুমি কে, আমি কে! আর বলে গেলো “হ্যালো”!