সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন প্রায় দ্বিগুণ হওয়ায় দুর্নীতি অনেক কমবে বলে সরকার আশা করলেও সাবেক সরকারি কর্মকর্তা এবং অর্থনীতিবিদরা উল্টো কথা বলেছেন। তারা বলছেন, অতীতে কখনোই বেতন-ভাতা বাড়িয়ে দুর্নীতি কমানো যায়নি। এজন্য শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। আর এখন সরকারি চাকরি পেতে শুরুতেই যে পরিমাণ টাকা ঢালতে হয়, তা উঠিয়ে নিতে শুরু থেকেই একজন দুর্নীতি শুরু করেন এবং সেটা অবসর পর্যন্ত চলতে থাকে।
এবারও তার ব্যতিক্রম হবে না বলে সরকারের সাবেক সচিব এবং অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন।
তবে বেতন বাড়ানোর ঘোষণার একদিন পর অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত বলেছেন, এমন কথা প্রচলিত যে বেতন-ভাতা কম বলে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারিরা ঘুষ খায়। কিন্তু নতুন বেতন স্কেল যেহেতু একজনের প্রয়োজন মেটানোর জন্য যথেষ্ট তাই ঘুষ-দুর্নীতি অনেক কমে আসবে।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের (সমন্বয় ও সংস্কার) সচিব মো. নজরুল ইসলাম বলেন, মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য পর্যাপ্ত অর্থের প্রয়োজন। নতুন পে-স্কেলে বেতন বৃদ্ধির ফলে চাহিদাগুলো পূরণে তাদের সুবিধা হবে। আর মৌলিক চাহিদা পূরণ হলে তা দুর্নীতি কমাতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে।
মো. নজরুল ইসলাম জানান, দেশে দুর্নীতি কমানোর জন্য সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। এর মধ্যে কেবিনেট ডিভিশন থেকে বাস্তবায়ন করা হয়েছে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য ‘জাতীয় সদ্াচার কৌশল’।
‘সরকারি চাকুরেদের আচার-আচরণ, পেশাদার মনোভাব ইত্যাদি উন্নয়নে এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়। এর অধীনে প্রশিক্ষণ, প্রণোদনা ইত্যাদির মাধ্যমে কর্মচারীদের দক্ষতা বৃদ্ধি, ‘কর্মজীবন উন্নয়ন পরিকল্পনা’সহ বেশকিছু সুপারিশ রয়েছে,’ বলে তি জানান।
তিনি জানান: পাশাপাশি আরো একটি সুপারিশ ছিলো যে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জীবনযাত্রার ব্যয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ বেতন নির্ধারণ করা হোক। এই উদ্দেশ্যেই নতুন পে-স্কেলে তাদের বেতন বাড়ানো হয়েছে। নতুন বেতন কর্মচারীদের জীবনযাত্রার ব্যয় নির্বাহের জন্য উপযোগী হবে।
সুতরাং এটি দুর্নীতি হ্রাসে সহায়ক হবে বলে মনে করেন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের (সমন্বয় এবং সংস্কার) সচিব।
তবে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা, সাবেক সচিব এবং ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ’র (টিআইবি) ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য ড. আকবর আলি খান ভিন্ন কথা বলেছেন।
তিনি বলেন, ‘সরকারের এ ধরণের পদক্ষেপ অতীতে দুর্নীতি কমাতে কোনোরকম সাহায্য করেছে বলে মনে হয় না। এবারও যদি অতীতের ঘটনারই পুনরাবৃত্তি হয় তবে নতুন পে-স্কেলও দুর্নীতি কমাতে তেমন কোনো ভূমিকা রাখতে পারবে না।’
আকবর আলি খান মনে করেন, দুর্নীতি কমাতে শুধু বেতন বৃদ্ধিই যথেষ্ট নয়। এর সঙ্গে দুর্নীতিবাজদের শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। যতদিন দুর্নীতিবাজরা উপযুক্ত শাস্তি না পাবে, ততোদিন শত বেতন বাড়ালেও দেশে দুর্নীতি কমবে না।
একই ধরনের কথা বলেছেন অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ।
তার মতে, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধি দুর্নীতি হ্রাসে তেমন কোনো ভূমিকা রাখবে না। কারণ দুর্নীতির কেন্দ্র প্রশাসনের অনেক ওপরের স্তরে। মানুষ অর্থের অভাবে দুর্নীতি করে না; করে আরো বেশি অর্থবিত্ত ও ক্ষমতা পাওয়ার জন্য।
তিনি বলেন, দুর্নীতি করে মূলত ক্ষমতাবানরা, ক্ষমতাহীনরা নয়। ওপরের ক্ষমতাবানদের জন্যই দুর্নীতি নিচের দিকে ছড়ায়। তাই দুর্নীতি তখনই কমানো সম্ভব যদি তা প্রশ্রয় না পায়, দুর্নীতির পৃষ্ঠপোষকতা না করা হয়, দুর্নীতিবাজরা ক্ষমতায় না থাকে।
আনু মুহাম্মদ বলেন, সরকারি-আধা সরকারি পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রায় সব পর্যায়েই অর্থ খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি মাধ্যম। এই ‘নিয়োগ বাণিজ্য’ দুর্নীতি বৃদ্ধির পেছনে বড় একটি কারণ।
‘সরকারি কর্মচারী, তিনি পুলিশই হোন, আনসারই হোন, বা শিক্ষক, তাকে যদি টাকা দিয়ে নিয়োগ পেতে হয় তাহলে তিনি সেটা তুলে আনার চেষ্টা করবেনই,’ বলে মন্তব্য করেন তিনি।
ড. আনু মুহাম্মদও ড. আকবর আলি খানের মতো দুর্নীতিবাজদের শাস্তির কথা বলেন। একইভাবে মানুষের নৈতিকতা জনসচেতনতার কথাও বলেন তারা।
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিতও এই জনসচেতনতার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিচ্ছেন। উপযুক্ত বেতন-ভাতা সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারিদের ঘুষ কমাবে বলার পাশাপাশি তিনি বলেছেন, কেউ যেনো কাউকে ঘুষ না দেন সে বিষয়টি যার যার অবস্থান থেকে নিশ্চিত করতে পারলে ঘুষ-দুর্নীতি অনেক কমবে।
‘তারপরও কিছু মানুষ আছে যারা ঘুষ খাবেই, এটা তাদের অভ্যাস,’ বলে মন্তব্য করেন অর্থমন্ত্রী।