পাহাড়ে সমস্যার অভাব নেই। কখনও কখনও সমস্যা দেখা না গেলেও সমস্যা তৈরি হতে খুব বেশি সময় লাগে না। তার মধ্যে, আবার, সমতলের সমস্যা তৈরিকারী সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারিদের শাস্তিস্বরূপ বদলির স্থান হিসেবে পাহাড়ের ‘সুনাম’ রয়েছে বেশ। সমতলে কেউ যদি রডের বদলে বাঁশ দিয়ে নির্মাণ কাজ করেন তাকে পাঠানো হয় পাহাড়ে। আর যদি কোন চিকিৎসক হাসপাতালে ধূমপান করেন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী তার জন্য উপযুক্ত স্থান হিসেবে বান্দরবানকেই ঠিক করে রেখেছেন ( দেখুন: প্রশান্ত ত্রিপুরা, বন্ধ হোক হিল-খাটানোর বর্ণবাদী চিন্তা ও অপচর্চা, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম, ৪ জুন, ২০১৬; জোবাইদা নাসরিন, পার্বত্য চট্টগ্রাম কি ‘পানিশমেন্ট জোন’? প্রথম আলো, ১৬ জুন ২০১৬)।
পাহাড়ে নানাবিধ সমস্যার সাথে গত বছর থেকে নতুন এক আতংক যুক্ত হয়েছে। এর নাম বৃষ্টি। আমরা জানি, মানুষ প্রকৃতির কাছে যায়, প্রকৃতিতে গেলে প্রশান্তি মেলে । অনেক প্রশ্নের উত্তরও পাওয়া যায় এই প্রকৃতি থেকে। কিন্তু পাহাড়ে নানা উছিলায় প্রকৃতির ওপর খবরদারি করার কারণে প্রকৃতি মহাবিরক্ত হয়ে প্রতিশোধ নিতে শুরু করেছে।আমাদের ছেলেবেলায় বৃষ্টি নামলে মহাআনন্দে উঠানে নাচানাচি করতাম। গৃহপালিত পশুপাখিসহ গাছের পাখিরা নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে কিচির মিচির করে পরিবেশকে ছন্দময় করে তুলতো। তরুণ আর মধ্যবয়সি পুরুষরা মাছ ধরার নানা আয়োজন করতো। সেই সময়ে কোথায় মাছ পাওয়া যেতো না? দুই একদিন ভারী বৃষ্টি হলে খালি হাতে বড় বড় মাছ ধরা যেতো। ঘোলা পানিতে (বিশেষ করে ধানক্ষেতে) মাছের ছোটাছুটিতে হাতে থাকা দা দিয়েও অনেকে বড় বড় মাছ ধরতো। বাজারে বৃষ্টির দিনে মাছ ধরার এক ধরনের ফাঁদ (স্থানীয় মারমা ভাষায় যেটিকে বামবু বলা হয়ে থাকে) বিক্রির ধুম চলতো।
কিন্তু, আড়াই থেকে তিন দশকের ব্যবধানে, এখন গ্রামীণ মানুষ বৃষ্টির দিনগুলোতে আনন্দ আর মাছ ধরার উৎসবে মেতে ওঠার বদলে কালো মেঘ দেখলে আতংকিত হয়ে পড়ে। পাহাড়ের কোথাও কালো মেঘ দেখা গেলে তার খবর মূহুর্তেই ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। টানা দুই একদিন বৃষ্টি হলে সবার ঘুম হারাম হতে থাকে। পাহাড়ে দু দশক আগেও দুই এক জায়গায় ছোটখাট বন্যা হওয়ার খবর শোনা যেতো মাত্র। যেমন বাঘাইছড়ি ছিল তার মধ্যে একটি। এখন সামান্য বৃষ্টিতে পাহাড়ের দুই জেলা সদর (খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান) সহ বেশ কিছু উপজেলা সদর বন্যায় প্লাবিত হয়।এক সময়ে বৃষ্টির দিনে পাহাড়ের মানুষের মাঝে যে আনন্দ ছিল, কাঁঠাল বিচি ভেজে খাওয়ার যে প্রচলন ছিল, ছোট মলামাছ ধরে পাতায় মুড়িয়ে কিংবা বাঁশের মধ্যে দিয়ে রান্নার যে ঐতিহ্য ছিল, কাপ্তাই বাঁধে পানি ভরে উঠলে ছোট ছোট নৌকায় করে এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে বেড়াতে যাওয়ার যে চল ছিল তার বদলে এখন আমরা শুধু আতংক নিয়ে দিন কাটাতে থাকি। সেই সময়ে আমাদের মাঝে কাপ্তাই বাঁধের বিদ্যুৎ (কিছু সদর উপজেলায় বিদ্যুৎ সরবরাহ ছিল মাত্র) না থাকলেও মনে কিছুটা আনন্দ ছিল, যার কারণে নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও বর্ষা মৌসুমে মানুষ বৃষ্টি উপভোগ করতো। ছেলেরা দলে দলে বৃষ্টিতে ভিজে ফুটবল খেলতো। আর এখন ঝড়-বৃষ্টিতে বিদ্যুৎ না থাকার কারণে ফেসবুকে হাহাকার করি, বিদ্যুৎ বাবুকে বকাঝকা করি। আর মোবাইল হাতে দুশ্চিন্তা নিয়ে খারাপ খবরের প্রত্যাশায় এখানে সেখানে ফোন করতে থাকি।
খারাপ খবর পাওয়া যেন রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। খারাপ খবরের আতংকটি তৈরি হয়েছে ২০১৭ সাল থেকে। সেই বছর শুধু রাঙ্গামাটিতে পাহাড় ধসে ১২০ জনের প্রাণহানি ঘটেছিল। আর আহত হয়েছিল আরো প্রায় দু’শতাধিক মানুষ। এই বছর প্রায় একই সময়ের ব্যবধানে ইতিমধ্যে পাহাড় ধসে ১২ জন প্রাণ হারিয়েছে। ঝড় বৃষ্টি হলে হতাহতের ঘটনাই শুধু নয় পুরো যোগাযোগ ব্যবস্থাও ভেঙে পড়ছে। অবশ্য, বৃষ্টি স্থায়ী বাসিন্দাদের জন্য একটি আতংক হলেও কিছু অর্থপিপাসু লোকের জন্য সুযোগ তৈরি করছে। রাস্তাঘাট মেরামতের নামে কোটি কোটি টাকা খরচ করার সুযোগ তৈরি হচ্ছে ( দেখুন: কালের কন্ঠ, ১৪ জুন ১৮)।
পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে কচ্ছপ গতির পাশাপাশি পার্বত্য জেলা পরিষদের ন্যায় গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোতে দশকের পর দশক জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধির অনুপস্থিতির সুযোগে যেখানে খুশি সেখানে ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, দালানকোঠা, বাজারহাট নির্মাণ চলছে।এক সময় রাস্তাঘাটে’র দু’ধারে খুব একটা ঘরবাড়ির দেখা না মিললেও এখন নানাবিধ কারণে প্রচুর ঘরবাড়ি গড়ে ওঠেছে। যেখানে ঘরবাড়ি হওয়ার কথা নয় সেখানেও তা হয়েছে। পাহাড়ের যে নিজস্ব সংস্কৃতি রয়েছে তা অস্বীকার করে পাহাড় কেটে সমতল করে ঘরবাড়ি গড়ে উঠছে।
নিত্য নতুন জায়গায় নানা ‘আর্কষণীয়’ নামে পাড়া সৃষ্টি হচ্ছে। গাছপালা কেটে পানির উৎসসমূহকে ধ্বংস করা হচ্ছে। পাহাড়ে জুম চাষীরা ছোট ছোট দা দিয়ে গর্ত করে নানা জাতের বীজ বপন করলেও নতুন বসতি স্থাপনকারীরা কোদাল দিয়ে মাটি কুপিয়ে ঢালু পাহাড়ে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে হলুদ, আদা, কচু, আনারস চাষ প্রচলন করেছে। মাছ ধরার নানা ক্ষতিকর কৌশলের আমদানি ঘটেছে। ছোট রাস্তাঘাট গুলোকে প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে বড় রাস্তাঘাটে পরিণত করা হয়েছে। রিজার্ভ বন ধ্বংস করা হচ্ছে। অবাধে গাছ, বাঁশ কেটে রাজকীয় খাট পালং তৈরি করে প্রতিদিন তা বাইরে চালান করা হচ্ছে। নিত্যদিন পাথর উত্তোলন করে স্থানীয় মানুষের জীবনযাত্রা হুমকির মুখে ঠেলে দেয়া হয়েছে। স্থানীয় বৃক্ষ প্রজাতি রক্ষা না করে বিদেশি প্রজাতিসহ চা, রাবার আর সেগুন বাগান গড়ার দিকে ঝোঁক বাড়ছে। এ সব নিয়ে খবরের কাগজে কম লেখালেখি হয়নি কিন্তু কাজের কাজ খুব একটা হয়েছে বলে জানা যায় না।
পাহাড়ের পরিবেশ প্রকৃতিকে বাঁচানোর উদ্যোগ একেবারে নেই বললেই চলে। অবশ্য, সেখানকার প্রকৃতিকে আঁকড়ে বেঁচে থাকা আদিবাসীদের জীবন যেখানে বিপন্ন সেখানে প্রাকৃতিক পরিবেশকে বাঁচিয়ে রাখার উদ্যোগ থাকার কথা নয়।
যা হোক, দেরিতে হলেও পরিবেশ রক্ষায় আদিবাসীদের জীবন পদ্ধতি, প্রথা যে পরিবেশ ও প্রকৃতি বান্ধব তা আজ বিশ্বের সর্বত্র স্বীকৃত। পাহাড়ের মাটি ও পরিবেশ বান্ধব উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে দেরি হলে ওই এলাকাটি আরও ঝুঁকিপূর্ণ আর বসবাসের অনুপযোগী হয়ে ওঠতে পারে। সরকারকে এখনই সব ধরনের পরিবেশবিরোধী কার্যক্রমকে পুরোদমে বন্ধ করতে হবে। পাশাপাশি সচেতন মহলকেও এগিয়ে আসার বিকল্প দেখি না। ফেসবুক ব্যবহারকারী হিসেবে কালো মেঘ দেখলে দু-লাইন লিখে হা-হুতাশ আর দুঃখ ছড়ানো বা অতীত সুখ-স্মৃতি রোমন্থন করলে হবে না। আমাদের সকলকে পরিবেশ নিয়ে ভাবতে হবে। পরিবেশবিরোধী সকল কার্যক্রমকে উম্মোচন করার মাধ্যমে সচেতনতা তৈরিতে ভূমিকা রাখতে হবে। আমরা বিশ্বকাপ ফুটবলের প্রতিটি ম্যাচকে নিয়ে যদি চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে পারি আমাদের আশপাশে উন্নয়নের নামে যে অনুন্নয়ন চলছে তা নিয়ে কেন সোচ্চার হব না?
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)