আগাঁরগাও প্রবীণ হাসপাতাল সংলগ্ন বৃদ্ধাশ্রম, তখনও ইফতারের অনেকটা সময় বাকি। সব মুসলিম পরিবারে সেসময় হয়তো ইফতারের আয়োজন চলছে। কিন্তু সম্পূর্ণ এক ভিন্ন চিত্র দেখা গেলো ওই বৃদ্ধাশ্রমের। নেই কোন কোলাহল, কারো মাঝে নেই ইফতার নিয়ে বাড়তি কোন অায়োজন। জীবন সেখানে স্থবির।
বৃদ্ধাশ্রমের চারতলায় মোবাইল ফোন হাতে নিয়ে ধবধবে পোশাকে এক বৃদ্ধা বসে ছিলেন। যেনো কারো ফোনের অপেক্ষা করছেন তিনি।
মোবাইল ফোন হাতে কেনো বসে আছেন জিজ্ঞেস করতেই শ্বেতশুভ্র ওই বৃদ্ধা যেন সম্বিৎ ফিরে পেলেন। কথা বলে জানা গেলো, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করা এই বৃদ্ধার ব্যক্তিজীবন ও কর্মজীবন ছিল বর্ণিল। একমাত্র সন্তান আমেরিকা প্রবাসী। স্বামী মারা যাবার কিছুদিন পরই সন্তান পাড়ি জমান বিদেশে। তখন থেকেই এই বৃদ্ধাশ্রমই তার ঠিকানা।
পরিচয় প্রকাশ না করা ও ছবি না তোলার শর্তে ওই বৃদ্ধা জানান, একমাত্র সন্তান যদি তাকে ফোন করে। ফোন করে যদি না পায়। এজন্যই তার এ অপেক্ষা। মাসে দু’বার ফোন করেন তার ছেলে। সেই দু’ বার ছেলের কণ্ঠ শোনার জন্যই মায়ের অপেক্ষা।
ইফতারে কী খাবেন প্রশ্ন করতেই বাচ্চাদের মতো হেসে ফেললেন এই বৃদ্ধা। করুণ হাসি হেসে জানালেন, ‘ আমাদের আবার ইফতার। একসময় কত ইফতার বানাতাম। কত মানুষ আসতো বাসায়। স্বামীর চাহিদা মতো, ছেলের চাহিদা মতো সবকিছু বানাতাম। ছেলেটার আমার বায়নার শেষ ছিল না, আর এখন ছেলেও নাই স্বামীও নাই। বায়না করার লোকও নাই।’
চিড়া-কলা খেয়েই ইফতার সারেন এই বৃদ্ধা। বৃদ্ধাশ্রমের সবার গল্পই প্রায় একই রকম। একদিন তাদের সব ছিলো। স্বামী-সন্তান, শ্বশুর-শাশুড়ি নিয়ে ছিলো জমজমাট সংসার। প্রচণ্ড ব্যস্ততার মধ্য দিয়ে পার করেছেন জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত। কিন্তু এখন তাদের কিছুই নেই । নেই কোন ব্যস্ততা। স্বজন থেকে দুরে থাকা এই বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের বুকের মাঝে শুধুই হাহাকার।
রোজা, ইফতার, ঈদ কোন কিছু নিয়েই নেই তাদের বাড়তি উৎসাহ উদ্দীপনা।এখানে বসবাসরত প্রবীণরা নিজ নিজ কক্ষে বসেই সারেন ইফতার। একাকী তাদের এই জীবনের সঙ্গী হয়না কেউ।
যারা নিবাসের মেসের ইফতারি খেতে আগ্রহী, তারা আগের দিন অর্ডার দিয়ে রাখেন। সময়মতো তাদের ঘরে পৌঁছে যায় ইফতার।এই তালিকায় থাকে খেজুর, পেয়াজু, ছোলা, বেগুনি, মুড়ি। আর যারা মেসের খাবরে আগ্রহী নন তারা নিজেরাই তৈরি করে নেন খাবার। সেক্ষেত্রে কলা চিড়াকেই প্রাধান্য দেন তারা। অনেকে আবার ইফতারে খান ভাত-মাছ-ডাল। বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে মাঝে মাঝে সেখানে বাহারি ইফতারের আয়োজন করা হয় সেখানে। সেসবেও কোন আগ্রহ নেই এই প্রবীণদের।
কিছুটা এগিয়ে গিয়ে বৃদ্ধাশ্রমের বারান্দায় হুইল চেয়ারে বসে ছিলেন আরেকজন বৃদ্ধ। একা একা হাটাচলা করতে পারেন না, হুইল চেয়ারই তার ভরসা। গলায় ঝুলিয়ে রেখেছেন একটি মোবাইল ফোন আর টাকার ব্যাগ। কথা বলে জানা গেলো, কবরবাসী মা-বাবার জন্য দোয়া করছেন তিনি। ছোট ভাই-বোনদের বড় করতে গিয়ে ‘চীরকুমার’ হয়ে জীবন পার করছেন। অষ্টম শ্রেণীতে থাকাকালেই বাবা-মারা মারা যাওয়াতে পরিবারের বড় ছেলে হিসেবে হাল ধরেন সংসারের। ছোট ভাই-বোনদের বড় করেছেন সমাজে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। কিন্তু বিয়ে না করায় না হয়েছে নিজের সংসার, নেই কোনো সন্তান। হয়ে গেছেন একা, তার এই একাকীত্বের ভাগিদার হতে চায়না কেউই। শরীর অসুস্থ হওয়াতে রোজাও করতে পারছেন না। তা নিয়েও কিছুটা মন খারপ তার।
আরেক বৃদ্ধের দেখা মিললো নামাজরত অবস্থায়। নামাজ শেষে অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা ওই বৃদ্ধাশ্রমবাসী জানালেন, স্ত্রী মারা গেছেন ৫ বছর আগে। ২ ছেলে ৩ মেয়ের সবাই যে যার সংসার নিয়ে ব্যস্ত। বাবার খোঁজ নেয়ার কোন সময় নেই তাদের।
ইফতারির কথা বলতেই বিষণ্ণ হয়ে পড়েন ওই বৃদ্ধ। নিজের ব্যবহৃত মোবাইল ফোনটি দেখিয়ে বলেন, ‘আমি আমার ছেলে-মেয়েদের সেহেরি ইফতারের খবর নেই সবসময়। শুধু আমার খবর নেয়ার সময় নেই কারও। আগে স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে ইফতার করতাম। এখন নিবাসের মেস থেকে যে ইফতারি দিয়ে যায় তাই খাই।’
‘এখন আর কেউ ইফতারির আগে অফিস থেকে ফেরার সময় ফোন করে বলে না বাবা, জিলাপি আনবা, হালিম আনবা। কেউ বলেনা বাবা অারেকটু মুড়ি নাও।’
বৃদ্ধাশ্রমের নিচতলায় সিড়ির কাছে দেখো মেলে আরেক বৃদ্ধার। হাঁটুর পুরানো ব্যথায় কাতর এই বৃদ্ধা। রোজা রেখে নিজের ইফতার নিজেই কিনতে গিয়েছিলেন। এই বৃদ্ধার চার মেয়ে থাকেন ঢাকাতে। ব্যস্তজীবনে মায়ের খোঁজ নেয়ার সময় নেই তাদের। শুধু মাসের শুরুতেই কিছু টাকা দিয়ে দায়িত্ব সারেন তারা।
এখানে বসবাসরতদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় ফেলে আসা তাদের জীবনের স্বর্ণালি দিনের কথা। রোজা সেই দিনগুলোর স্মৃতিচারণ করতে যেয়ে চোখের পানি ফেলেছেন অনেকে। রোজার দিনের উৎসবমুখর পরিবেশ স্ত্রী-স্বামী-সন্তান নিয়ে ইফতার সেহেরির কথা বলতে গিয়ে হয়েছেন অাবেগাপ্লুত। তবুও থেমে থাকেনা কিছুই। এভাবে পার হয়ে যায় তাদের এক একটি রোজা। শুধু রমজান মাস নয়, সারাবছরই বৃদ্ধাশ্রমের দেয়ালে ঘুরে ফেরে দীর্ঘশ্বাস।
(বৃদ্ধাশ্রমে ছবি তোলায় নিষেধাজ্ঞা থাকায় প্রতীকী ছবি ব্যবহৃত হলো)