বুদ্ধিজীবীদের দায়হীনতার ভূত থেকে মুক্ত হওয়ার আহ্বান জানিয়ে প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক বলেছেন, পরিস্থিতি আজ এতই বদলে গেছে যে, দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণি- বিশেষ করে শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী অংশ এখন এক নিরুদ্ধশ্রোত, সম্ভাবনাহীন, বহির্গমন পথরুদ্ধ মৃত্যুকূপে আটকে গেছে।
শনিবার বাংলা একাডেমিতে ‘সমাজে বুদ্ধিজীবীর দায়’ শীর্ষক ৭ম জ্ঞানতাপস আব্দুর রাজ্জাক গুণীজন বক্তৃতায় এসব কথা বলেন তিনি।
শিক্ষিত বুদ্ধিজীবীসহ সাধারণভাবে একটা সুস্থিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশের বাস্তব ভিত্তি ও বাস্তব শর্তগুলো নষ্ট হচ্ছে উল্লেখ করে হাসান আজিজুল হক বলেন, এরফলে, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান সর্বক্ষেত্রেই আমরা দেখতে পাচ্ছি সংকট আমূল, অনুর্বরতা সর্বব্যাপী ও অপ্রতিকার্য। পাকিস্তানি আমলে জাতিগত শোষণ ও নিপীড়নটা এত অসহনীয়ভাবে প্রত্যক্ষ ছিল যে, উঠতি মধ্যবিত্ত শ্রেণি নিজ শ্রেণির বিকাশের স্বার্থেই প্রতিবাদী ভূমিকা গ্রহণ করতে পেরেছিল, গণতান্ত্রিক সংগ্রামে অংশ নিয়েছিল। কিন্তু পরিস্থিতি আজ বদলে গেছে।
‘‘উনিশ শতকের বাংলায় উৎপাদন প্রণালীর বিকাশ ঘটেনি বা ভিন্নতর বণ্টনব্যবস্থার ভিতর দিয়ে নতুন সমাজ গড়ে ওঠেনি, পরিবর্তন যা ঘটেছিল ইংরেজের উপনিবেশী স্বার্থেই। পঞ্চাশের দশকে ভাষা আন্দোলনকে সর্বব্যাপী পরিবর্তন ও সার্বিক মুক্তি-আন্দোলনের দিকে নিয়ে যেতে পারতেন বিপ্লবী রাজনীতিকরা। কিন্তু তারা তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচিকে সেই পথে পরিচালিত করতে পারেননি।
স্বাধীনতার কয়েক বছরের মধ্যে সাম্রাজ্যবাদী পুঁজির প্রয়োজনে আমাদের সমাজে ভাঙন-প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায়। বিশ্বায়ন ও বাজার অর্থনীতির যুগে সাম্রাজ্যবাদী পুঁজির দাপট বর্তমানে এমনি প্রকাণ্ড আকার নিয়েছে যে, মধ্যবিত্ত শ্রেণির একাংশ সরাসরি তার কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। সেই অংশ এখন নানারকম বহিরাগত পুঁজির সেবায় থেকে আত্মসেবায় রত। বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী শ্রেণির বড় অংশ তা-ই। এদের কাজে লাগাচ্ছে বহু গবেষণা প্রকল্পে; বহু সাহায্য সংস্থায় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে, আমলাতন্ত্র থেকে এরা এসে জুটেছেন।”
এক ঘণ্টার দীর্ঘ বক্তৃতায় তিনি আরো বলেন, ‘দেশের শিক্ষিত শ্রেণি সমাজ, উৎপাদন ও কায়িক শ্রম থেকে বিচ্ছিন্ন। সাধারণ মানুষের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ ক্ষীণ, একে অপরের ভাষা বোঝে না। সমাজজীবনের এই শূন্যতার জন্যই আমাদের দেশের শিক্ষিতদের জ্ঞানচর্চা, জীবিকার্জনের অছিলা ছাড়া আর কিছু নয়। ফলে, তারা নতুন ও আধুনিক চিন্তাধারার জন্ম দিতে পারেন না।’
‘‘সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থায় চলছে অধঃপতন! বিশ্ববিদ্যালয়ের শতকরা অধিকাংশ শিক্ষার্থী বই-পুস্তক, পুঁথি-গ্রন্থের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখেন না। এমনকি নোট বইও পড়েন না। এই পরিস্থিতির পেছনে একটা বড় কারণ দেশের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে পঠিত জ্ঞানের ৯৫ শতাংশ ইংরেজি ভাষার দুর্গে বন্দী। স্বাধীনতার পর আমাদের প্রথম কাজটিই ছিল, প্রধানত ইংরেজি ভাষা থেকে আমাদের ভাষায় অনুবাদের মধ্য দিয়ে জাতীয় জ্ঞানকাণ্ড সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা, আর সেটাকে একটা চলন্ত প্রক্রিয়ায় রূপ দেয়া। এই কাজ করার জন্য দশ বছর, বিশ বছর মেয়াদি একটি জাতীয় কর্মসূচি গ্রহণ করা ছাড়া অন্য কোনো উপায় ছিল না।
এ কাজের কেন্দ্র হতে পারত বিশ্ববিদ্যালয় বা বাংলা একাডেমির মতো প্রতিষ্ঠান; এগিয়ে আনতে পারতো নানা সরকারি-বেসরকারি সংস্থা, উঁচু পর্যায়ের জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলো। দেখা যাচ্ছে সে রকম কিছুই হয়নি। পাশাপাশি আরেকটা পথ ছিল ইংরেজি ভাষার বইগুলোর মানের সঙ্গে টেক্কা দিয়ে বাংলা ভাষাতেই মৌলিক গ্রন্থ রচনা করে উচ্চশিক্ষায় আমূল পরিবর্তন নিয়ে আসা। স্বাধীনতার পরে বিপর্যস্ত অর্থনীতি, মুমূর্ষু কৃষি বা শিল্পক্ষেত্রে যেমন জরুরি ব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়োজন ছিল, এটা তার চেয়ে এক তিল কম নয়। আমাদের শিক্ষাবিদ-নীতিপ্রণেতারা সেই ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেননি। ফলে, নানা বিদ্যা অর্জনের বেলায় আজ আমাদের মুখ্য ভূমিকা ঋণগ্রহীতার। স্বাধীনতার পরে পাঁচটি যুগ কাটিয়ে দিলেও আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আজো প্রাণপণ নিষ্ঠায় নির্বিচারে পশ্চিমা জ্ঞানবুদ্ধি আমদানি করতে বাধ্য হচ্ছে।’’
বক্তব্যের শুরুতে অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক সম্পর্কে হাসান আজিজুল হক বলেন, ‘তিনি ছিলেন আমাদের সময়ের বিদ্যাসাগর। বিদ্যাসাগর যেমন একা হাতে ঊনবিংশ শতকের বাংলায় দ্রোহ, জ্ঞান ও প্রজ্ঞার আলো জ্বেলে সমাজকে পথ দেখিয়েছিলেন- বিংশ শতকের ঢাকা শহরেও যেন এই চিরকুমার পণ্ডিত তাই করে গেছেন।’
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন জাতীয় অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান। স্বাগত বক্তৃতা করেন জ্ঞানতাপস আব্দুর রাজ্জাক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক ড. আহরার আহমদ এবং হাসান আজিজুল হকের জীবনকীর্তির মূল্যায়ন করে সংক্ষিপ্ত প্রবন্ধ পাঠ করেন কালি ও কলম-এর সম্পাদক আবুল হাসনাত।
জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের স্মরণে আয়োজিত এই বক্তৃতামালায় এর আগে বক্তৃতা করেছেন অধ্যাপক রেহমান সোবহান, বদরুদ্দীন উমর, অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, ড. রওনক জাহান, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ও ড. আকবর আলি খান।