চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

বীর উত্তম কাদের সিদ্দিকী কেন অসত্য বিক্রি করেন?

কৃষক-শ্রমিক-জনতা লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি বঙ্গবীর খ্যাত কাদের সিদ্দিকী বরাবরই বিতর্কিত কথার তুফান তুলতে ভীষণ পছন্দ করেন। প্রায়শই তিনি এই কাজটি করেন গণমাধ্যমের খোরাক হন। তার অনেক বক্তব্যেই যেমন সত্য-মিথ্যা কিছুই মেলে না, তেমনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনারও সঙ্গতি খুঁজে পাওয়া যায় না। তবে তার বক্তব্যে বরাবরই ভীষণ রকম আত্মঅহমিকা, ঔদ্ধত্য দেখতে পাওয়া যায়। ভাবটাও এমনভাবে প্রদর্শন করেন যে তিনি যা বলছেন সেটাই সত্য ইতিহাস এবং সেটাই মেনে নিতে হবে।

সম্প্রতি সেই ধারাবাহিকতায় তিনি নতুন এক বিতর্কিত হাস্যকর গেঁজেল বক্তব্য হাজির করেছেন রাজনীতির ময়দানে। বীর উত্তম কাদের সিদ্দিকী গত ১০ মার্চ শনিবার বিকালে টাঙ্গাইল জেলার সখিপুরের নলুয়া বাছেদ খান উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে উপজেলার যাদবপুর ইউনিয়ন কৃষক-শ্রমিক-জনতা লীগ আয়োজিত জনসভায় প্রধান অতিথির বক্তৃতায় তথ্যমন্ত্রী এবং জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনুর সমালোচনা করে বলেন, ইনু যত মানুষ মেরেছে মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানিরাও তত মানুষ মারে নাই। একই জনসভায় তিনি শেখ হাসিনার উদ্দেশ্যে বলেন, তার বাপকে যারা মেরেছে তারাই এখন হাসিনার ঘাড়ে ওঠেছে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কাদের সিদ্দিকীর এই বিতর্কিত বক্তব্য নিয়ে নানাজনে নানা মত প্রকাশ করেছেন। অনেকেই মনে করছেন কাদের সিদ্দিকীর এই বক্তব্য একেবারেই অপরিপক্ক। স্রেফ হিংসা-বিদ্ধেষ, ক্ষোভ, অনুযোগ থেকেই তিনি এত নিচুমানের একটি বক্তব্য দিয়েছেন। যে বক্তব্যে ঐতিহাসিক ভিত্তি বলে কোনো কিছু নেই। এমন কী নেই সত্যের লেশমাত্রও। শুধু এই-ই নয়, কারো কারো মতে, ২৫ জানুয়ারি নাটোরের কানাইখালিতেও কৃষক-শ্রমিক-জনতা লীগের আরেকটি সভায় তিনি যে বক্তব্য দেন সেই বক্তব্যের সাথেও এটি সম্পূর্ণ স্ববিরোধী। ঐদিন বক্তব্যের এক পর্যায়ে তিনি বলেন, স্বাধীনতার পর জাসদ যা না হত্যা করেছে আওয়ামী লীগ নিজেরাই নিজেদের লোককে তার চেয়ে অনেক বেশি হত্যা করেছে।’ দুটি বক্তব্য পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বক্তব্য দুটি ভয়ংকর রকম এলোমেলো এবং উস্কানিপূর্ণ। বক্তব্যের আগা মাথা বলেও কিছু নেই।

অনেকদিন ধরেই বীর উত্তম কাদের সিদ্দীকি জাসদ নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে বক্তব্য রেখে চলেছেন এবং একই সাথে নিজস্ব কর্মকাণ্ডের মধ্যে দিয়ে তিনি ইনিয়ে-বিনিয়ে স্বাধীনতাবিরোধী সাম্প্রদায়িক শক্তির রসদ যুগিয়ে চলেছেন। কাদের সিদ্দিকী যখন টুপি পরিহিত অবস্থায় বলেন, ইনু যত মানুষ মেরেছে মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানিরাও তত মানুষ মারে নাই তখন কেউ খুশি না হলেও বিএনপি-জামাত চক্রের মানুষগুলো কিছুটা হলেও বেশ খুশি হন। এই দুই দলের অন্ধ সমর্থকেরা আবার এসব বিষয় নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ সর্বত্র খোঁচাখুঁচিও করেন।

মহান মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষ শহীদ হয়েছিল এবং হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটিয়েছিল পাকসেনা এবং এদেশের রাজাকার আলবদর আলশামস খ্যাত স্বাধীনতা বিরোধী গোষ্ঠী। কাদের সিদ্দিকী যখন বলেন, জাসদ নেতা হাসানুল হক ইনু’র  চেয়ে বেশি মানুষকে হত্যা করেছিল তখন আমার কাছে মনে হয়েছে এই মানুষটি মাথায় টুপি পরিহিত অবস্থায় সাধারণ জনগণের সামনে এতবড় মিথ্যাচার করে মুক্তিযুদ্ধটাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। এখন যে কেউই প্রশ্ন করতে পারেন কাদের সিদ্দিকী তার এই অপরিপক্ক বক্তব্য কী দিয়ে প্রমাণ করবেন? উনি যা বলেছেন এটাতো আর কথার কথাও হতে পারে না। আবার বাংলাদেশে কী এমন কোনো উন্মাদ আছে যে কাদের সিদ্দিকীর দেওয়া এই ভয়ংকর গেঁজেল তথ্য বিশ্বাস করবেন? হ্যাঁ আছে। বিএনপি-জামাতের এই প্রজন্মের বড় অংশ এরকম মিথ্যাচারকে ফুল দিয়ে বরণ করে নেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চোখ বুলালে সেটি আঁচ করা যায়। আর এই বিভ্রান্তকর বক্তব্য দিয়ে কাদের সিদ্দিকী মূলত রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে চেষ্টা করছেন। একটি মহলকে খুশিও করতে চাচ্ছেন।

বীরউত্তম কাদের সিদ্দিকী বহুদিন ধরেই জাসদ, জাসদের নেতৃবৃন্দ, বীরউত্তম আবু তাহের, ড. আনোয়ার হোসেনসহ জাসদের অনেকের বিরুদ্ধেই বহু আগে থেকেই ঢালাও বক্তব্য দিয়ে আসছেন। বক্তব্য দেওয়ার অধিকার তার আছে, তাই বলে মিথ্যার মিথ্যা বলে মানুষকে বিভ্রান্ত করে গেঁজেল বক্তব্য উপস্থাপন কী যুক্তিযুক্ত? কাদের সিদ্দিকী দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে রয়েছেন। আর হয়তো তিনি এ বিষয়টি সহ্যই করতে পারছেন না যে তার মতো নেতা থাকতে কেন হাসানুল হক ইনুরা আজ প্রভাবশালী নেতা। এ ধরনের ক্ষোভ, হতাশা থাকাই স্বাভাবিক। কিন্তু সেই হাতাশা থেকে ইতিহাস বিকৃত করা একেবারেই মানায় না।

কাদের সিদ্দিকী বহুদিন ভারতে থাকার পর ৯০ এর অভুত্থানের পর দেশে প্রত্যাবর্তন করে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় হন। কিন্তু চরম ঔদ্ধত্যের কারণে তিনি দল থেকে বহিস্কার হন। এরপর ৯৯ সালের ২৪ ডিসেম্বর কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ প্রতিষ্ঠা করেন। গামছা প্রতীক নিয়ে তিনি রাজনীতির ময়দানে সোচ্চার আছেন। কিন্তু সেই শুরু থেকেই বিতর্কিত বিভ্রান্তিকর বক্তব্য দিয়ে আসছেন। সেই বিভ্রান্তকর বক্তব্য থেকে শুধু হাসানুল হক ইনু বা রাশেদ খান মেনন নয়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও রক্ষা পান না।

বিভ্রান্তিকর বক্তব্য দেওয়ার কারণে জাতীয় সংসদেও তিনি নিন্দিত হয়েছেন। অনেকেরই হয়তো মনে থাকার কথা জামাত নিয়ন্ত্রিত দিগন্ত টেলিভিশনে সবার উপরে দেশ নামে একটি টকশো করা এবং বিভিন্ন টকশোতে অংশ নিয়ে বিতর্কিত বক্তব্য দেওয়ার কারণে গণজাগরণ মঞ্চ ২০১৩ সালে তাকে একবার ‘নব্যরাজাকার’ বলে অ্যাখায়িত করেছিল। শুধু এই নয়, তার বঙ্গবীর উপাধিও কেড়ে নেওয়ার হুমকি দিয়েছিল আন্দোলনকারীরা। দিগন্ত টেলিভিশন বন্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি ওখানে নিয়মিত অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করতেন। জামাতের মিডিয়া বন্ধন থেকে এখনও তিনি মুক্ত হননি। আর তাই দৈনিক নয়াদিগন্ত পত্রিকায় এখনও তিনি নিয়মিত লেখেন। দিগন্ত টেলিভিশন এবং দৈনিক নয়াদিগন্তের অর্থ যোগানদাতা ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর নির্বাহী সদস্য, ইসলামী ছাত্র শিবিরের প্রতিষ্ঠাতা মীর কাশেম আলী। ২০১৬ সালে মীর কাশেম আলীর ফাঁসি দেওয়া হয়। ২০১৩ সালের ৩১ আগস্ট কাদের সিদ্দিকীকে নিয়ে পার্লামেন্টে রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর ধন্যবাদ প্রস্তারের আলোচনায় অংশ নিয়ে তারই আপন বড় ভাই তৎকালীন পাটমন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকী বলেছিলেন, ‘আমি সংসদে ঘোষণা দিচ্ছি যে একাত্তরে সে (কাদের সিদ্দিকী) মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল সেটা ছিল জীবন রক্ষার জন্য, বঙ্গবন্ধুর আদর্শের জন্যে বা দেশের মানুষের মুক্তির জন্যে নয়। ৭৫-এ যে অস্ত্র তুমি হাতে নিয়েছিলে তা প্রতিরোধের জন্য নয়, তোমার জীবনরক্ষার জন্যে। ‘তোমাকে ধিক্কার, তোমাকে ধিক্কার।’

বীরউত্তম কাদের সিদ্দিকীর বিভ্রান্তিকর তথ্য উপস্থাপন, ঔদ্ধত্য, দুর্নীতি নতুন কিছু নয়। হয়ত যতদিন বেঁচে আছেন ততদিন তিনি এগুলো করবেন। কিন্তু একাত্তরের যুদ্ধের ময়দানের এতবড় একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার স্ববিরোধী বিভ্রান্তকর অসত্য বক্তব্য দেওয়া একেবারেই মানায় না। আপনার মুখে অসত্য উচ্চারণ শোভা পায় না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জিয়াউর রহমানকে নিয়ে সম্প্রতি যে মন্তব্য করেন আপনি সে বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন ‘নাউযুবিল্লাহ। এমন ডাহা মিথ্যা কথা বলেন কীভাবে?’ জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে দেওয়া বক্তব্যকে আপনি বলেছেন ডাহা মিথ্যা। আর আপনি প্রকাশ্য সভায় বললেন, ‘ইনু যত মানুষ মেরেছে মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানিরাও তত মানুষ মারে নাই।’ দয়া করে বলবেন এ কোন ধরনের মিথ্যাচার? মুক্তিযুদ্ধের পর বঙ্গবন্ধুর পায়ের কাছে আপনি অস্ত্র সমর্পণ করেছিলেন সত্য, চেতনাটুকু নয়। আর এ কারণেই একটি গোষ্ঠীকে খুশি করার নিমিত্তে আপনি যা ইচ্ছে তাই বলছেন।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)