বিসিএস পরীক্ষায় লাখ-লাখ প্রতিযোগীর সঙ্গে মেধার লড়াইয়ে জিতে শিক্ষা ক্যাডারে নিয়োগ পাওয়া এবং বিসিএস না দিয়েই সরকারিকরণের তালিকাভুক্ত হয়ে ক্যাডারভুক্ত হওয়ার দাবি তোলাদের মধ্যে মর্যাদার দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে। এই দ্বন্দ্বের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে ইতোমধ্যে পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি পালন করেছে বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতি এবং জাতীয়করণ (বি.সি.এস শিক্ষা ক্যাডারে আত্মীকরণ) প্রক্রিয়াধীন কলেজ শিক্ষক পরিষদ।
স্বাতন্ত্রতা রক্ষা এবং মর্যাদা সংকট কাটাতে ২০১০ সালের শিক্ষানীতিতে এ সংক্রান্ত নির্দেশনা এবং প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসন মানতে বলছেন বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারে নিয়োগ প্রাপ্তরা।
আত্মীকরণে নিজেদের মর্যাদার সংকটে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির সভাপতি সেলিম উল্লাহ খন্দকার। চ্যানেল আই অনলাইনকে তিনি বলেন,‘সরকারি চাকুরির প্রত্যেকটিখাতে নির্দিষ্ট যোগ্যতা,সরকারি বিধি-বিধান মানার বিষয় আছে। এখন আত্মীকরণের মাধ্যমে এই বিধিবিধানে নিয়োগ না পাওয়াদেরও ক্যাডারে অনুপ্রবেশ করা হয় তাহলে প্রকৃত ক্যাডাররা ক্ষতিগ্রস্থ হবে। পাশাপাশি সরকারকেও এই খাতে অরাজকতায় পড়তে হবে।’
প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসন এবং শিক্ষানীতি ২০১০ এ জাতীয়করণকৃত শিক্ষক ও কর্ম কমিশনের নিয়োগ দেয়া শিক্ষকদের সম্পর্কে বর্ণিত বিধান তুলে ধরে বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির সভাপতি বলেন,‘শিক্ষানীতির অধ্যায় ২৭ এর ৮ নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বেসরকারি কলেজ সরকারিকরণের জন্য সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকা জরুরি। এই নীতিমালায় জাতীয়করণকৃত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাকরি সংক্রান্ত বিধি-বিধান থাকবে যাতে কর্ম কমিশন কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকদের স্বার্থ সংরক্ষিত হয়।’
নিজেদের মর্যাদা সংকটের কারণেই আন্দোলন করতে হচ্ছে জানিয়ে বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির সাধারণ সম্পাদক শাহেদুল কবির চৌধুরী চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন,‘বিসিএস করে যারা ক্যাডার সার্ভিসে আসেন তাদের জন্য একটি নিয়োগ প্রক্রিয়া আছে,সংবিধান স্বীকৃত পাবলিক সার্ভিস কমিশন আছে। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য সংবিধানে বিধিমালা করার নির্দেশনা আছে। এর উপর ভিত্তি করেই ১৯৮০,৮১ সালে বিসিএস নিয়ম-নীতি জারি প্রণয়ন করা হয়েছে। এই দু’টি নিয়মের ভিত্তিতে ২৮ টি ক্যাডারে নিয়োগ দেয়া হয়।
আমরা কাউকে খাটো করছি না, ছোট করছি না। শুধু আমাদের নিয়োগের সাংবিধানিক ভীতটা অটুট রাখতে চাইছি। যে বিধিগুলো আছে সেগুলোর কোথাও আত্মীকরণের মাধ্যমে ক্যাডারভূক্ত করার কথা বলা নাই। আমরা মনে করি আত্মীকরণের মাধ্যমে তাদের ক্যাডারভূক্ত করলে সংবিধানের বাধ্যবাধকতাকে লঙ্ঘন করা হবে।’
এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের বরাত দিয়ে তিনি বলেন,‘প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসনে বলেছেন আত্মীকরণকৃত শিক্ষকদের চাকুরি বদলিযোগ্য হবে না। এর মাধ্যমে এটা বোঝা যায় যে তাদের চাকুরি ক্যাডার সার্ভিসের নয়। কারণ ক্যাডার সার্ভিসের চাকুরি বদলিযোগ্য।’
তবে বিসিএস শিক্ষকদের দাবিগুলোকে অযৌক্তিক আখ্যা দিয়ে এ দ্বন্দ্ব নিরসনে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চাইছে জাতীয়করণের মাধ্যমে বি.সি.এস শিক্ষা ক্যাডারে আত্মীকরণ প্রক্রিয়াধীন কলেজগুলোর শিক্ষকরা।
জাতীয়করণ (বি.সি.এস শিক্ষা ক্যাডারে আত্মীকরণ) প্রক্রিয়াধীন কলেজ শিক্ষক পরিষদের চেয়ারম্যান জহুরুল ইসলাম চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন,“এর আগে ১৯৭৮ সাল থেকেই সরকারিকরণ হয়েছে। ১৯৮১,১৯৯৮,২০০০ সালের বিধির মাধ্যমে আত্মীকৃত করা হয়েছে, সমমর্যাদা দেয়া হয়েছে। ক্যাডাররা ১৯৯৮ সালে মামলা করেও হেরে গিয়েছিলো। তখন শিক্ষা সচিব ছিলেন রকিব উদ্দিন এবং তৎকালীন পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সদস্য বর্তমান স্পিকারের মা নাইয়ার সুলতানা লিখিতভাবে জানিয়েছিলেন শিক্ষা ক্যাডারে কোনো নন-ক্যাডার পদ নেই। এখন বিরোধীতাকারীরা বলছেন জাতীয় শিক্ষা নীতির কথা। অথচ শিক্ষানীতি ২০১০ এ কোথাও নন-ক্যাডার লেখা নেই। এরপরও তারা এতোগুলো শিক্ষার্থীকে জিম্মি করে অনৈতিক কর্মসূচি দিচ্ছে। তারা আদালতে মামলা করেছে, তাহলে মামলা লড়ুক, আবার আন্দোলন কেন?”
বিসিএস না দেয়ায় এমনিতেও তাদের মাশুল গুণতে হয় জানিয়ে তিনি বলেন,“বিসিএস না দেয়ায় এমনিতেই আমাদের চাকুরিকাল কম। ২০০০ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমলেই ক্যাডাররা নতুন বিধি তৈরি করেছিলো। এখন একই প্রধানমন্ত্রীর আমলে তারা ওই বিধিও বাতিল করতে বলছে। আসলে তারা কী চাইছে সেটাই প্রশ্নবিদ্ধ। উল্টো আমাদের কলেজগুলোর টেবিল-চেয়ার থেকে শুরু করে গাছপালা পর্যন্ত বিক্রি করে দিয়ে আমরা পড়েছি পরিচয় সংকটে। না আমরা সরকারি,না বেসরকারি।”
আত্মীকরণে ক্যাডারভূক্ত হয়ে বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারদের সমমর্যাদায় আসতে চাওয়া শিক্ষদের এই প্রতিনিধি আরও বলেন,“তারা কী চায় সেটা স্পষ্ট নয়, আমাদের পাওয়াতেই তাদের বিরোধীতা। তারা নন-ক্যাডার করার দাবি করছে। এটা অযৌক্তিক দাবি। এই পরিস্থিতিতে আমরা প্রধানমন্ত্রীর দিকে তাকিয়ে আছি।”
দুপক্ষের এই মর্যাদার দ্বন্দ্বের মধ্যে নতুন জাতীয়করণকৃত কলেজ শিক্ষকদের ক্যাডার-বহির্ভূত রেখে ২০১০ সালের জাতীয় শিক্ষানীতি ও প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসন অনুযায়ী স্বতন্ত্র বিধিমালা জারি না করার প্রতিবাদে আজ রোববার বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের সরকারি কর্মকর্তারা সারাদেশে কর্মবিরতি পালন করেছেন। এ কর্মবিরতি আগামীকাল পর্যন্ত চলবে। সরকার তাদের দাবি মেনে না নিলে আগামীতে আরো কঠোর কর্মসূচি দেয়ার ঘোষণাও দেয়া হয়েছে।