আজ বিশ্ব মা দিবস। পৃথিবীর সকল ‘মা’কে জানাই শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন। প্রত্যেক মা সন্তানের কথাবার্তা ও আচরণ দেখেই তাদের সব অনুভূতি বুঝতে পারেন। আমার নিজের মা ও এর ব্যতিক্রম নয়।
পৃথিবীতে আমাদের সবথেকে আপন ও কাছের মানুষ হচ্ছে মা। কাজী কাদের নেওয়াজ তাই মাকে কেন্দ্র করে ছড়া লিখতে গিয়ে যথার্থই বলেছেন, ‘মা কথাটি ছোট্র অতি জেনে রেখ ভাই, তাহার চেয়ে মধুর নাম ত্রিভুবনে নাই’।
‘মা কে নিয়ে যত উক্তি’র মধ্যে বলা হয়েছে, ‘মা জননী চোখের মনি, অসীম তোমার দান, খোদার পরে তোমার আসন আসমানের সমান, ত্রিভুবনে তোমার মত হয় না কারো মান।’
বিশ্বে সমাজবিজ্ঞান বলেন আর স্বাস্থ্যবিজ্ঞান অথবা পারিবারিক বিজ্ঞান বলেন, এ তিনটি ক্ষেত্রেই একসাথে কাজ করেন একজন মা। নিঃসন্দেহে এগুলো পৃথিবীর জটিলতম প্রকল্পগুলোর অন্যতম প্রকল্পের বিষয় হওয়া সত্ত্বেও মায়ের এই পেশায় নেই কোনো বেতন, নেই কোনো নির্দিষ্ট ছুটি। আর এই প্রকল্পে একটি বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুর পরিচর্যা করেও একজন মা তাঁর সন্তানকে আদর-স্নেহ-ভালোবাসা দিয়ে পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলেন। বিজ্ঞানের এই গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলোতে সেবা দেয়ার পরও তাঁর নেই কোনো নির্দিষ্ট পদবী। এজন্য শুধু ‘মা’ শব্দটিকেই আমার কাছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ পেশা বলে মনে হয়।
আমরা বিনিময়ে মা’কে কখনো কিছু দিতে না পারলেও আজ মা দিবসে এটুকু অন্তত বলতে পারি ‘মা’ আমি তোমাকে ভালোবাসি। ভালোবাসি তোমার আঁচল। আবার খোঁজ-খবরও নিতে পারি। এটি শুধু এই বিশেষ দিবস উপলক্ষে নয় সব সময়ই আমরা চাইলে বলতে পারি। এতে করে একদিকে তাদের আত্নার প্রশান্তি যেমন বেড়ে যায় অন্যদিকে সন্তানের প্রতি তাদের আস্থার জায়গাটিও আরো প্রশস্ত হয়।
সত্যি কথা বলতে আমি আমার মাকে প্রায়ই বলি, মা, I live in the heart of you. তখন বলেন, I am also live in your heart. তখন মুহূর্তের মধ্যে যেন দুনিয়ার সব ক্লান্তি-অবসাদ দূর হয়ে স্মরণে আসে সেই ছোটবেলায় শোনা মায়ের গান, ‘মা বিনে বান্ধব নাইরে, মা বিনে বান্ধব নাইরে, ভব সংসার জুড়িয়া; ভেবে দেখ কি করছো সেই মায়ের লাগিয়া।’
একমাত্র সন্তানের মুখে হাসি ফুটাতে পারলেই মায়ের অন্তর যেন খুশীতে নেচে উঠে। জন্মের পর সন্তানের মুখের ‘মা’ ডাক শোনা যেন মায়ের কাছে পৃথিবীর যেকোন সুর থেকে তা উত্তম। মায়েরা সন্তানের সাফল্য দেখে নিজের জীবনের চূড়ান্ত সাফল্যের আনন্দ লাভ করে। তাই, জীবনে চলার প্রতিটি পদক্ষেপে মায়ের কাছে যেমন দোয়া চাওয়া জরুরী তেমনি বিভিন্ন সময় মাকে উপহার দেয়া, মাকে সাথে নিয়ে উন্মুক্ত বাতাসে ঘুরতে বের হওয়া, পার্কে, নদী বা সমুদ্রের তীরে সংক্ষিপ্ত ভ্রমণে নিয়ে যাওয়া যায়।
আবার মা যদি ভ্রমণ প্রিয় না হন যেদিক তাঁর ভালো লাগে সেদিকটাতে সন্তান হিসেবে মাকে গুরুত্ব দেয়া চাই। হতে পারে সেটা মায়ের কোন প্রিয় খাবার, কোন বিশেষ উপহার, কাউকে খুশি করানোর ব্যাপার, কোন কথা শোনা এবং সে কথাটি রাখা, ছাদ বাগান করে দেয়া এবং সেখানে রকমারি ফুল-ফল চাষ বা শাক-সবজি ইত্যাদির চাষাবাদ ও উৎপাদন।
একটি বিষয় চিন্তা করে দেখুন, সারা বিশ্বের যেখানেই যান না কেন মায়ের কোলের চেয়ে শান্তি কোথাও খুঁজে পাবেন না। তাইতো মহান আল্লাহ সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ পবিত্র কুরআনে বলেছেন, মা-বাবার সাথে ভালো ব্যবহার করো। যদি তোমাদের কাছে তাদের কোন একজন বা উভয় বৃদ্ধ অবস্থায় থাকে, তাহলে তাদেরকে (রাগ বা বিরক্ত হয়ে) “উহ্” পর্যন্তও বলো না এবং তাদেরকে ধমকের সুরে জবাব দিয়ো না বরং তাদের সাথে মর্যাদা সহকারে কথা বলো। আর দয়া ও কোমলতা সহকারে তাদের সামনে বিনম্র থাকো এবং দোয়া করতে থাকো এই বলে; হে আমার প্রতিপালক! তাদের প্রতি দয়া করো, যেমন তারা দয়া, মায়া, মমতা সহকারে শৈশবে আমাকে প্রতিপালন করেছিলেন। [সুরা বনী ইসরাইল, আয়াত: ২৩-২৪]
আহলে সুফফার অন্যতম সদস্য ও সর্বাধিক হাদিস বর্ণনাকারি সাহাবি হযরত আবু হোরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সা.) এর কাছে এসে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আমার উত্তম সাহচর্যের সর্বাধিক অধিকারী কে? তিনি বলেন, তোমার মা। তারপর কে? তিনি বলেন, তোমার মা। আবারও প্রশ্ন করলেন এরপর কে? তিনি বলেন, তোমার মা। লোকটি পুনরায় প্রশ্ন করে জানতে চাইলেন তারপর কে? তিনি বলেন, তোমার বাবা [ সহীহ বুখারী ও মুসলিম]
আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেন, আর আমি মানুষকে তার মা-বাবার সাথে সদাচরণের নির্দেশ দিয়েছি। তার মা তাকে কষ্টের পর কষ্ট করে গর্ভেধারণ করেছে। তার দুধ ছাড়ানো হয় দু’বছরে। নির্দেশ দিয়েছি যে, আমার (আল্লাহর) প্রতি এবং তোমার মা-বাবার প্রতি কৃতজ্ঞ হও। [সূরা লুকমান, আয়াত:১৪]
আরেকটি কথা মনে পড়ে গেল, সেটি হচ্ছে, যাদের এই দিবসে মা নেই তারা কি করবেন। আসলে মায়েদের কোন বিশেষ দিবস হয় না। সুতরাং, শুধু মা দিবসে নয় যেকোন সময় যদি কেউ মায়ের জন্য দোয়া করে, মায়ের আত্নীয় স্বজনের সাথে সম্পর্ক ভালো রাখে, আল্লাহর রাস্তায় দান করে, এবারের রমজানে সেটিই হতে পারে সন্তানের পক্ষ থেকে মায়ের মুক্তির একান্ত পাথেয়।
সবশেষে বলব, শুধু মা দিবসকে কেন্দ্র করে নয় আমরা সবসময় মায়ের কাছে যত বেশি বিনীত হবো এবং মায়ের জন্য দোয়া করবো, ততবেশি আল্লাহ আমাদের ওপর সন্তুষ্ট হবেন। মা দিবসে সৃষ্টিকর্তার কাছে এই প্রার্থনা করেই শেষ করছি, পৃথিবীর সবার ‘মা’ সুস্থ ও দীর্ঘজীবী হয়ে সুখে-শান্তিতে বেঁচে থাকুক।