চীনে শেয়ারবাজারে ধসে বিশ্বব্যাপী যে প্রতিক্রিয়া তাতে বাংলাদেশে এখনই নেতিবাচক প্রভাব না পড়লেও অর্থনীতিবিদরা দীর্ঘমেয়াদে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। একই কারণে তেলের দাম কমে আরব দেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হলে বাংলাদেশের জনশক্তি বাজারে কি প্রভাব পড়তে পারে, তাও হিসাবে রাখতে বলেছেন তারা। তবে এসব কারণে টাকার অবমূল্যায়ন হলে বাংলাদেশের রপ্তানি-নির্ভর অর্থনীতির লাভই হবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
আশংকা এবং আশংকার বিপরীতে আস্থার কারণ হিসেবে স্মরণে আনা হচ্ছে সাত বছর আগের বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দাকে।
তখন ২০০৮। বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমে এসেছিলো ৩০ ডলারে। সেবারের ধাক্কাটা অনেক সময় পরে এসেও ঠিক কাটিয়ে উঠতে পারেনি কিছু আরব দেশ। এখন আবার কমছে বিশ্ববাজারে তেলের দাম। ক্রমাগত কমতির দিকে থাকলে আবারও অস্থিরতার মধ্যে পড়বে মধ্যপ্রাচ্য, শুরু হতে পারে কর্মী ছাটাই। মধ্যপ্রাচ্যেতো বাংলাদেশের অনেক মানুষের কর্মস্থল। তাই প্রশ্ন উঠছে: সেখানে অস্থিরতা কি বাংলাদেশের উপরও প্রভাব আনবে?
অন্যদিক শেয়ারবাজার ধসের কবলে পড়া চীন অবকাঠামোগত আর ম্যানুফ্যাকচারিং অনেক পণ্য ও উপাদানের রপ্তানিকারক। সেক্ষেত্রে তাদের অর্থনৈতিক ধস কি প্রভাব ফেলবে বাংলাদেশের অবকাঠামো উন্নয়নে? যে বাংলাদেশে আবার অবকাঠামোগত অনেক বিষয়েই চীনের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।
মন্দার প্রেক্ষাপটে টাকার অবমূল্যায়নও আসন্ন মনে করা হচ্ছে। এতে রপ্তানিকারকরা খুশি হলেও আমদানিকারকদের বেশ চিন্তায় পড়তে হবে।
তবে এসব কিছু নিয়ে এখনই চিন্তার কোনো বিষয় নেই বলে মনে করছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দীন আহমেদ। তবে তিনি বলছেন, দীর্ঘমেয়াদে চিন্তা করতেই হবে।
‘প্রবাসী আয় অর্থনীতির একটি বড় অংশ। কিন্তু সেটার কতো অংশই বা মধ্যপ্রাচ্যের উপর নির্ভরশীল! মধ্যপ্রাচ্য থেকে আমাদের যে পরিমাণ বৈদেশিক আয় হয় সেই পরিমাণটা খুব বেশি না। সেক্ষেত্রে খুব বেশি চাপ আসবে বলে আমি মনে করি না। তবে দীর্ঘমেয়াদে আমাদের তো ভিন্ন কিছু চিন্তা করতেই হবে,’ বলে মনে করেন তিনি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর বলেন: একটা সময় তারা কর্মী ছাটাইও করতে পারে। সেক্ষেত্রে অন্য সমাধানটাও ভেবে রাখতে হবে। এক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোকে আরো বেশি মনিটর করতে হবে। কোথা থেকে টাকা আসছে, কোথা থেকে কম; সেসব দেখতে হবে। তাহলে এই সমস্যা থেকে বের হয়ে আসা সম্ভব।
তেলের দাম কমার কারণে আরব দেশগুলোর অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার যে শংকা, সেই তেলের দাম কমার বিষয়টাতে অবশ্য আন্তর্জাতিক রাজনীতি আছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ হোসেন জিল্লুর রহমান। বললেন, তেল যেহেতু আমাদের আমদানিপণ্য, তাই দাম কমলো মানেই বাংলাদেশ অনেকটা স্বস্তি পেলো। আমেরিকা এবং সৌদি আরব এখন তেলের দাম কমিয়ে ইরান ও রাশিয়ার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এগিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করছে। এতে কেবল অর্থনৈতিক কারণ নয়, বরং আন্তর্জাতিক রাজনীতিও আছে।
একইভাবে চীনের শেয়ার বাজার ধসে প্রকৃত প্রভাবের পাশাপাশি রাজনৈতিক কারণে কৃত্রিম প্রভাবও থাকতে পারে বলে আশংকা করছেন অনেকে।
কিন্তু সে কারণে বাংলাদেশকে আশংকিত না হতে বলছেন ড. সালেহউদ্দীন আহমেদ। তার মতে, বাংলাদেশের অর্থনীতি এতোটা ভঙ্গুর নয়। আবার বাংলাদেশের শেয়ার বাজারও তেমন এক্সপোজড না। সুতরাং সেভাবে প্রভাব আসবে না।
তার সঙ্গে একমত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান। তিনি বলেন: তাদের শেয়ার বাজার ধস আন্তর্জাতিক অর্থনীতির দুর্বলতা প্রকাশ করে। এখন সেটা শুধু চীনের বিষয় নয়। তবে এখনই বাংলাদেশে তেমন কোনো প্রভাব না ফেলবে না।
তারপরও বিশ্ব অর্থনীতিতে যে প্রভাব পড়বে, পরোক্ষভাবে তা বাংলাদেশকেও প্রভাবিত করবে বলে মনে করেন তিনি।
আর টাকার অবমূল্যায়ন হলে তাকে ইতিবাচকভাবেই দেখবেন এই দুই অর্থনীতিবিদ। তারা বলেন, কখনো কখনো রপ্তানিকারকদের দিকে ইতিবাচক নজর দিতে হবে। তাদের উপর থেকে চাপ কমলে সেটা তো দেশের জন্যই দরকারি। রপ্তানি বাড়লে দেশও লাভবান হবে।
তবে সবকিছুর পরও বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার ছেড়ে দিয়ে বা কিনে রেখে অর্থনীতি যে স্থির রেখেছে বা রাখছে, সেটা বেশ প্রশংসনীয় বলেই তারা মনে করেন।
তারা বলেন: দেশের উইনার-লুজারদের ভারসাম্য রক্ষা করার দিকে নজর দিতে হবে। তাহলে অন্যদের জন্য যেটা বড় সমস্যা আর বাংলাদেশের জন্য ছোট প্রভাব, সেটা মোকাবেলা করা সহজ হবে।