পদ্মাসেতু প্রকল্পে দুর্নীতির ষড়যন্ত্র থাকার ব্যাপারে বিশ্বব্যাংকের অভিযোগের কোনো প্রমাণ পাননি কানাডার আদালত। দীর্ঘ বিচারিক প্রক্রিয়া শেষে মামলার তিন আসামিকে খালাস দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে কানাডীয় গণমাধ্য। শুক্রবার কানাডার কয়েকটি পত্রিকার প্রতিবেদনে বলা হয়, ফোনে আড়ি পেতে সংগ্রহ করা যে তথ্যের ওপর ভিত্তি করে প্রসিকিউশন মামলা সাজিয়েছিল, তাকে গাল–গল্প ও গুজব বলে ছুড়ে ফেলেছেন বিচারক। অথচ এই অভিযোগ তুলেই ২০১২ সালে উক্ত প্রকল্প থেকে ঋণ বাতিল করেছিল বিশ্বব্যাংক। শুধু তাই নয়, স্বীয় পদ থেকে অভিযুক্তদের সরিয়ে দেয়ার পরেও পদ্মাসেতু প্রকল্পে আরো কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংস্থাকে ঋণ প্রদান না করতে তারা প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে প্রভাবিত করেছিলো। তাদের এই কর্মকাণ্ডের ফলে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। উপরোক্ত রায়ের ফলে বাংলাদেশের ওপরে পড়া সেই ‘কলঙ্কতিলক’ উঠে গেলেও বিশ্বব্যাংকের এই কর্মকাণ্ডের ফলে বাংলাদেশের যেই অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে তার কোনো ক্ষতিপূরণের বিষয় আদালতের রায়ে উঠে আসেনি। আমরা মনে করি, বিষয়টি শুধু সরকার কিংবা নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। বাংলাদেশ যখন বিভিন্ন ক্ষেত্রে অন্য অনেক দেশকে ছাড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে, তখন আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ একটি সংস্থার এমন সিদ্ধান্ত ছিল রাষ্ট্রীয়ভাবে বাংলাদেশকে হেয় প্রতিপন্ন ও তাদের শর্তানুযায়ী না চলায় প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে ‘শায়েস্তা’ করার শামিল। কেননা বাংলাদেশের প্রকৃত বন্ধু হলে সংস্থাটি কখনোই পুরো প্রকল্প থেকে সরে যেত না, বরং আলাপ-আলোচনা এবং যাবতীয় পদক্ষেপের মাধ্যমে ‘দোষী’দের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে উদ্যোগী হতো। কিন্তু তারা সেটা না করে পুরো প্রকল্প থেকেই সরে গেছে, পাশাপাশি অন্যদেরকেও সরিয়ে নিয়েছে। একটি প্রকল্প থেকে অন্যদের সরিয়ে নেওয়ার বিষয়টি তাদের অনধিকার চর্চা এবং ঋণের নামে বিভিন্ন দেশে সংস্থাটির নির্লজ্জ মোড়লিপনার উদাহরণ। তাই আমরা মনে করি, আন্তর্জাতিক বিশ্বে মানহানির বিষয়ে এখন বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে বিশ্বব্যাংকের কাছে ক্ষতিপূরণ আদায়ের জন্য আন্তর্জাতিক আইনানুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিৎ। কারণ, মিথ্যা অভিযোগ এনে আন্তর্জাতিক বিশ্বে বাংলাদেশের ইমেজ নষ্ট করার অধিকার তাদেরকে কেউ দেয়নি। একইসঙ্গে আমরা বলতে চাই, বিশ্বব্যাংকের মূল অভিযোগ ছিল তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রীর ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ‘সাকো’কে নিয়ে। সংস্থাটির অভিযোগ ছিল, পরামর্শক নিয়োগে ঘুষের ৩৫ মিলিয়ন ডলার যোগাযোগমন্ত্রীর এই ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে লেনদেনের পরিকল্পনা করেছিলেন অভিযুক্তরা। আমরা মনে করি, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের দায়িত্বশীল পদে থেকে এমন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত থাকার কারণেই দেশের একজন মন্ত্রীর বিরুদ্ধে তারা খুব সহজেই অভিযোগ তুলতে পেরেছে। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়টি ফলাও করে প্রচার হওয়ায় দেশ-বিদেশের মানুষও সহজেই অভিযোগটি ‘বিশ্বাসযোগ্য’ বলেই মনে করেছে। তাই রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের দায়িত্বশীল পদে থেকে সংশ্লিষ্ট লাভজনক পদে থাকার বিষয়টি কতোটুকু যৌক্তিক সেই বিষয়টিও সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে ভেবে দেখার সময় এসেছে। দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে এই বিষয়টি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা উচিৎ বলেও আমরা বিশ্বাস করি। পাশাপাশি ভবিষ্যতে যাতে আর কেউ এমন অভিযোগে কিংবা অন্য কোনো অজুহাতে বাংলাদেশের সুনাম ক্ষুণ্ণ করতে না পারে সেই বিষয়টিও সরকারকেই নিশ্চিত করতে হবে। একইসঙ্গে কানাডীয় আদালতের রায় যেন ভবিষ্যৎ দুর্নীতির পাইকারি সনদ না হয়ে যায় সেদিকেও সরকারকে খেয়াল রাখতে হবে।