দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর শিক্ষকরা নিজেদের বেতন ও সেই অনুযায়ী অন্যান্য আমলাদের সাথে নিজেদের মর্যাদা যাতে অষ্টম বেতন কাঠামো অনুযায়ী বজায় থাকে তার জন্য আন্দোলন করছে। কিছু দিন আগেই তারা ঘণ্টা তিনেকের কর্ম বিরতি পালন করেছে এবং এর পর দাবি আদায় না হলে আরও বৃহত্তর আন্দোলনের কথা ভাবছে বলে জানান দিয়েছে। বর্তমানে তারা ফুল টাইম কর্ম বিরতির দিকে যাচ্ছে! এ সবই তারা করছে চমৎকার গণতান্ত্রিক উপায়ে। নতুন বেতন কাঠামো অনুযায়ী নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য তারা আন্দোলন করতেই পারে। তবে সবচাইত উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে এই আন্দোলনে সব মতের শিক্ষক এক হয়ে গেছেন।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সমর্থিত কিংবা নীল সাদা দলের সকল শিক্ষক এক হয়ে একই প্ল্যাটফর্মে আন্দোলন করছে। তাদের আন্দোলনটির বিষয়ে নিশ্চয়ই সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষ ভেবে দেখবে। কারন শিক্ষকরা যে খুব কম বেতনে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াচ্ছে এই বিষয়ে তো কারো দ্বিমত থাকার কথা নয়। তবে এই আন্দোলনের ফলে বেশকিছু বিষয় আসলে সামনে চলে আসছে যা নিয়ে বিস্তর আলোচনা হতে পারে।
দেশের সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা এক হয়েছেন এটি তো অবশ্যই আনন্দের সংবাদ। তবে ব্যাপার হচ্ছে, তারা তাদের নিজেদের বেতন ও মর্যাদার জন্য এক হয়েছেন। এই শিক্ষকদের বেতন-ভাতা আসে দেশের খেটে খাওয়া মানুষগুলোর ট্যাক্সের টাকায়। দরিদ্র শ্রমিক থেকে শুরু করে কৃষক, দোকানী ও অতি সাধারণ মানুষদের ট্যাক্সের টাকায় তাদের বেতন আসে। এই কৃষকরা যখন ন্যায্য মূল্যে সার পাওয়ার জন্য আন্দোলন করে তখন দেশের শিক্ষিত এই শ্রেণীর মানুষগুলোকে একসাথে কথা বলতে দেখা যায় না; দেশে যখন পোশাক শ্রমিকরা বেতন না পেয়ে ঈদের দিন পর্যন্ত না খেয়ে আন্দোলন করে তখন তাদের একসাথে হয়ে ওই আন্দোলনের সাথে শামিল হতে দেখা যায় না। তারা তখন ব্যস্ত থাকে নিজেদের রাজনৈতিক পরিচয় এবং যে যার মতো করে এই সব বিষয়কে ব্যাখ্যা করতে; যেখানে নিজেদের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিই হয়তো প্রাধান্য পায়। অথচ এই কৃষক, শ্রমিকের পরিশ্রমের ট্যাক্সের টাকায় এই শিক্ষিত শ্রেণীর বেতন ভাতা আসে!
এখন শিক্ষকরা প্রশ্ন করতে পারে আমাদের এতো দায় পড়লো কেন! সরকারি আমলারাও তো তাদের ট্যাক্সের টাকায় বেতন পায়, তাদেরও তো দায় আছে। এই প্রশ্ন আরো বেশি প্রাসঙ্গিক মনে হওয়ার কারণ হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা দাবী করেছে আমলারা নিজেদের বেতন ও মর্যাদা ঠিক রেখে তাদের মর্যাদা কয়েক ধাপ কমিয়ে দিচ্ছে! অর্থাৎ আমলাদের প্রতি একধরনের ক্ষোভের বিষয়টি আসলে সামনে চলে আসছে।
এই ক্ষেত্রে কোনটি সঠিক ও কোনটি সঠিক নয়, সেটিও হয়তো সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষ নির্ধারণ করবে। তবে প্রশ্ন যদি হয় আমলারা কেন কৃষক, শ্রমিকদের আন্দোলনের সাথে শামিল হয় না; তখন অবশ্য বিষয় ভিন্ন। সরকারি আমলাদের নানা রকম বিধী নিষেধ মেনে চলতে হয়ে। তারা চাইলেই সরকারের বিরোধিতা কিংবা যে কোন আন্দোলনে শামিল হতে পারে না। এটি কেবল বাংলাদেশে নয়, পৃথিবীর অনেক দেশেই সম্ভব না। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ক্ষেত্রে সম্ভব। প্রথমত তাদের কাজই হচ্ছে নিজেদের জ্ঞান ও চিন্তাকে কাজে লাগিয়ে নতুন কিছু সৃষ্টি করা গবেষণার মাধ্যমে; এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় গুলো স্বায়ত্তশাসিত। অর্থাৎ তারা বেশীরভাগ ক্ষেত্রে নিজেদের সিদ্ধান্ত নিজেরাই নিতে পারে এবং সরকারের কাছে তাদের দায়বদ্ধতা থাকলেও সেটি কঠোর কিছু নয়। মানে হচ্ছে তারা চাইলেই সরকারের নানান কর্মকাণ্ডে গঠনমূলক সমাচলনা করতে পারে, যে কোন আন্দোলনে শামিল হতে পারে। কৃষক, শ্রমিকদের নানান দাবী আনাদ্যের ক্ষেত্রে কিছু শিক্ষক হয়তো ব্যক্তিগত পর্যায়ে নিজেরা শামিল ঠিকই হন কিন্তু সকল শিক্ষক নিজেদের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গীর ঊর্ধ্বে উঠে এক হওয়ার দৃষ্টান্ত তো খুব একটা দেখা যায় না। অথচ যখন নিজেদের বেতন ও মর্যাদার প্রশ্ন উঠলো তখন ঠিকই এরা এক হয়ে গেলো।
শিক্ষকদের গবেষণার বিষয়টিও এখানে গুরুত্বপূর্ণ দিক। বলা হচ্ছে শিক্ষকদের উচিত নিজেদের বিভিন্ন গবেষণা প্রজেক্টে যুক্ত হওয়া। এবং নিজেরাই এই সব প্রজেক্টের জন্য ফান্ড সংগ্রহ করবে। শিক্ষকদেরও এই ক্ষেত্রে দাবি হচ্ছে সরকার থেকে তো গবেষণার জন্য কোন ফান্ড’ই দেয় না তেমন। যা দেয়া হয় সেটি নাম মাত্র। এটিও আসলে অস্বীকার করা কোন উপায় নেই। তবে এই ক্ষেত্রেও প্রশ্ন থেকে যায়। সরকারের উপরই কেন নির্ভর করে থাকতে হবে। পৃথিবীর প্রায় সব ভালো ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা নিজেরাই নানান বেসরকারি সংস্থা থেকে শুরু করে, ইন্ডাস্ট্রি ও এনজিওগুলো থেকে গবেষণা ফান্ড সংগ্রহ করে থাকে। তাহলে আমাদের শিক্ষকরা সেটা পারছে না কেন? তারা হয়তো বলতে পারে বাংলাদেশে তো এর সুযোগ কম। এটিও অবশ্যই অস্বীকার করা উপায় নেই। সুযোগ কম হলেও একদম নেই তা তো না, এছাড়া শুধু বাংলাদেশ কেন আন্তর্জাতিক অনেক প্রতিষ্ঠান হয়েছে যেখানে আপনি যদি ভালো পরিকল্পনা জমা দিতে পারেন, যেটি বিজ্ঞান সম্মত এবং পদ্ধতিগত ভাবে অনেকটা নির্ভুল তাহলে তারা আপনার প্রজেক্টে ফান্ড দিবে। আর সুযোগ তো নিজেদের কাজের মাধমেই করে নিতে হয়। এর জন্য প্রয়োজন নিজেদের যোগ্য করে গড়ে তুলা। আমাদের শিক্ষকরা নিজদের সত্যিই যোগ্য করে গড়ে তুলছে কিনা সেই প্রশ্নও কিন্তু সামনে চলে আসে। শিক্ষকদের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়া এবং বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে পড়ানোর বিষয়টি তো সব সময়ই আলোচনায় চলে আসে।
কিছুদিন আগেই সরকারের এক প্রভাবশালী মন্ত্রীকে বলতে শুনলাম, শিক্ষক কেন একটি ছাত্র ছাত্রসংগঠনের মিটিং কিংবা আলোচনা সভায় থাকছে! একজন মন্ত্রী পর্যন্ত এতে নাখোশ হয়েছে! যিনি নিজেই রাজনীতি করেন! অর্থাৎ শিক্ষকরা যদি মনে করে এই ধরনের রাজনীতিতে জড়িয়ে তারা বিভিন্ন প্রশাসনিক পদ বা অন্যান্য বস্তগত সুবিধা আদায় করে নিতে পারবে, তাহলে আসলে অনেক ক্ষেত্রেই মূল কাজ থেকে সরে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। যেটি অতি মাত্রায় দেখা যায় বাংলাদেশে। এখন শিক্ষকরা এই ক্ষেত্রেও প্রশ্ন তুলতে পারেন এই বলে, আমাদের যেই বেতন দেয়া হয়, তাতে এই সময়ে পরিবার নিয়ে চলতে সত্যিই সমস্যা হয়ে যায়। এটিও আসলে অস্বীকার করার উপায় নেই যে অনেকেই হয়তো এই কারনে একটু বেশি টাকা উপার্জনের কথা ভেবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে পড়ায়! তবে প্রশ্ন হচ্চে, শিক্ষকদের কাজ তো কেবল পড়ানো না, গবেষণাও করা। তারা কি গবেষণা আদৌ করছে কিংবা করলে সেটি কতটুকু মৌলিক গবেষণা!
দেশে শিক্ষকদের পাবলিকেশনের ক্ষেত্রে দেখায় যায় এটি মূলত পদোন্নতির একটি বিষয়! পদন্নতির জন্য প্রকাশনা লাগবে, তাই সেটি করা। সব ক্ষেত্রে না হলেও বেশীরভাগ ক্ষেত্রে এটিই বাস্তবতা। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে বেশীরভাগ ক্ষেত্রে কোন দিক নির্দেশনাও দেয়া থাকে না। দেখা যায় যে কোন ধরনের একটি জার্নালে পাবলিকেশন করে সংখ্যা বর্ধন করার একটা প্রতিযোগিতাও চলে! অথচ পৃথিবীর বেশীরভাগ ভালো বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে একটা আলদা দিক নির্দেশনা দেয়া থাকে ঠিক কোন ধরনের জার্নালে প্রকাশ হলে সেটি গ্রহণ করা হবে এবং কোনটির স্কেল বা মান কি হিসেবে ধরা হবে। এই যেমন জার্নালের ইম্পেক্ট ফ্যাক্টর একটা বড় বিষয়। এছাড়া জার্নালটি কোথায় ‘ইনডেক্সড’ সেটি বিবেচ্য বিষয়। বেশীরভাগ ক্ষেত্রে প্রচলিত অর্থে “ওয়েব অব সায়েন্স” কিংবা “স্কোপাসের” ইনডেক্সড ধারী জার্নাল গুলো পুরো পৃথিবীতে স্বীকৃত। এরা মুলত কোন জার্নালকে নিজদের ইনডেক্স এর মাঝে স্থান দেয়ার আগে সেই জার্নালটির বৈজ্ঞানিক গ্রহণযোগ্যতা, এডিটরিয়াল টিম, গবেষণা রিপোর্ট প্রকাশের ক্ষেত্রে কোন বিষয় গুলো প্রাধান্য পায় কোন সেগুলো দেখা হয় । আর এর উপর ভিত্তি করেই মূলত এই সংস্থা গুলো ইনডেক্স দিয়ে থাকে। এই দুটো ছাড়াও আরো বেশ কিছু রয়েছে, যাদেরও গ্রহণ যোগ্যতা রয়েছে। এই জন্য অনেক ক্ষেত্রে ভালো বিশ্ববিদ্যালয় গুলো বলে দেয়, তুমি যদি ওই ইনডেক্সধারী কোন জার্নালে তোমার গবেষণা কর্ম প্রকাশ করো তবেই কেবল সেটি গ্রহণযোগ্য হবে তোমার প্রমোশন কিংবা একাডেমীক ও রিসার্চ ক্রেডেন্সিয়ালে। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর অবশ্য এই ক্ষেত্রে কোন বাধ্যবাধকতা নেই। যার কারনে শিক্ষকদের মাঝে যে কোন একটা কিছু লিখে অতি সাধারণ মানের কোন জার্নালে টাকার বিনিময়ে পাবলিকেশন করে নিজেদের প্রকাশনার সংখ্যা ভারি করার প্রবণতা রয়েছে।
বাংলাদেশের বেশীর ভাগ শিক্ষক এমন কি জানেনও না স্বীকৃত জার্নাল গুলোতে প্রকাশ করতে টাকা লাগে না যদি না আপনি ওপেন এক্সেস করতে চান। অনেকে এও জানে না “ওপেন এক্সেস” আর “ক্লোজ এক্সেস” কি! ভালো জার্নালের কিছু ওপেন এক্সেস আছে। অর্থাৎ যে কেউ এক্সেস করতে পারে। গুগলে সার্চ দিলেই আপনি ফ্রি’তে পেয়ে যাবেন। আর ক্লোজ এক্সেসের ক্ষেত্রে যদি আপনার প্রকাশিত আর্টিকেল’টি পড়তে হয় আপনার বিশ্ববিদ্যালয়কে ওই জার্নালটির তালিকাভুক্ত হতে হবে কিংবা আপনার নিজেকে। সেই ক্ষেত্রে এই তালিকাভুক্তির জন্য আপনাকে টাকা গুনতে হবে কিংবা আপনার বিশ্ববিদ্যালয়কে। আপনি যদি মনে করেন আপনার লেখা ক্লোজ এক্সেস না হয়ে ওপেন হবে, সেটা সম্পূর্ণই আপনার ইচ্ছা! তাহলেই কেবল আপনি নিজ থেকে টাকা দিবেন, নইলে নয়। এটি আপনার চয়েস। পৃথিবীর বেশীরভাগ বিশ্ববিদ্যালয় গুলো সাধারণত ভালো জার্নাল গুলোতে সাবস্ক্রাইব থাকে। যার কারনে আপনি যদি সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বা ছাত্র হন, তাহলে আপনি এমনিতেই ফ্রি’তে আর্টিকেল গুলো পড়তে পারবেন। তাই নিজ থেকে টাকা খরচ করে ওপেন এক্সেসে প্রকাশনার দরকার পড়ে না। তবে বাংলাদেশের শিক্ষকদের ক্ষেত্রে যেটা হয়, ইনারা কোন রকম ইনডেক্সড নেই এই রকম জার্নালে টাকার বিনিময়ে আর্টিকেল প্রকাশ করে থাকে। অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে এই প্রকাশনা গুলো বিশ্ববিদ্যালয় গ্রহণও করে।
মৌলিক গবেষণা তাই তেমন একটা দেখা যায় না। এখন প্রশ্ন হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় গুলো গবেষণা কর্মের ক্ষেত্রে কোন নীতি নির্ধারণ করছে না কেন? এমন তো না শিক্ষকরা জানে না এই বিষয় গুলো। এদের অনেকেই তো পৃথিবীর বিভিন্ন ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করে এসছেন, গবেষণা করেছেন এমনকি ভালো ভালো প্রকাশনাও রয়েছে। এর উত্তর দুই রকম হতে পারে। এক হচ্ছে তারা চায় না এমন কোন কঠিন নিয়ম চালু করতে যাতে তাদের সব সময় কঠিন পরিস্থিতির মাঝ দিয়ে যেতে হবে। ভালো গবেষণা করতে হলে এর পেছনে সময় দিতে হবে। সেই সময় হয়তো তারা দিতে চায় না। অন্যান্য কাজকেই হয়তো তারা প্রাধান্য দেয়। তাই নিজেরাই হয়তো এই ধরনের একটা নীতি তাই করে রেখেছে।
দ্বিতীয় কারন, যেটিকেই হয়তো শিক্ষকরা বড় কারন বলবে, কারন নিজেরা গবেষণা করতে চায় না বা গবেষণার বাহিরে রাজনীতি বা অন্য কোথাও পড়ানোকে যে তারা প্রাধান্য দিতে চায় সেটি তো আর তারা স্বীকার করতে চাইবে না। যা হোক, দ্বিতীয় কারনটি হচ্ছে, গবেষণা করার জন্য তো তাদের সরকার থেকে তেমন কোন ফান্ড দেয়াই হয় না। তাহলে তারা মৌলিক গবেষণা করবে কিভাবে? এটি আসলে এক দিক থেকে ঠিকই আছে। বিশেষ করে ন্যাচারাল সায়েন্স কিংবা প্রযুক্তিতে আসলে একটা ল্যাব চালানো কিংবা মেশিন কেনা থেকে শুরু করে আনুসঙ্গিক বিষয় গুলোতে অনেক খরচের ব্যাপার থাকে। তাই তারা হয়তো শেষ পর্যন্ত পেড়ে উঠে না। এই ক্ষেত্রেও আসলে আগের ব্যাপারটি প্রযোজ্য। তাদের উচিত হবে কোন শিল্প কারখানা কিংবা আইটির ক্ষেত্রে আইটি ইন্ডাস্ট্রির সাথে যোগাযোগ করে সেই আনুযায়ি গবেষণা পরিকল্পনা লেখা যাতে তারা ফান্ড দিতে রাজি হয়। এ ছাড়া অন্তর্জাতিক সংস্থা গুলোর দিকেও নজর দেয়া উচত। তবে প্রশ্ন হচ্ছে সোশ্যাল সায়েন্স কিংবা বিশেষ করে যারা মানবিক শাখায় গবেষণা করে তাদের তো খুব বেশি অর্থের প্রয়োজন হয় না। বলছি না প্রয়োজন হয় না, অবশ্যই প্রয়োজন হয়, এই যেমন কেউ যদি ফিল্ড ওয়ার্ক করতে যায়, তাহলে সেখানে যাওয়া, থাকা-খাওয়া, কিংবা কেউ যদি কোন সফট ওয়ার ব্যবহার করে সেটার খরচও আছে। তবে এই ক্ষেত্রে প্রশ্ন হচ্ছে যারা ফিল্ড ওয়ার্ক করে না, কেবল সেকেন্ডারি সোর্সের উপর ভিত্তি করে গবেষণা করে; তাদের তো লাইব্রেরী ওয়ার্ক করলেই চলে। তারা কেন তাহলে গবেষণা করতে পারছে না? এই ক্ষেত্রে তো তেমন কোন ফান্ডের দরকার হয় না। হয়তো হয়, কিন্তু সেটা এমন কোন অর্থ না, যার জন্য আটকে থাকতে হবে। লাইব্রেরীতে বই না থাকলে, বই হয়তো কিনতে হয় কিংবা আজকাল অনলাইনেও অনেক সময় ই-লাইব্রেরী আছে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অনেক ক্ষেত্রেই সেই ই-লাইব্রেরীর এক্সেস থাকে। সেখান থেকে চাইলেও হয়তো নতুন নতুন বই, কিংবা ভালো ভালো জার্নালের নতুন প্রকাশনা গুলো পাওয়া সম্ভব আর এর উপর ভিত্তি করে যারা কেবল সেকেন্ডারি সোর্সের উপর গবেষণা করে তারা তো ভালো গবেষণা দাড় করিয়ে ফেলতেই পারে। সেটি কেন তাহলে তারা করছে না? এই ক্ষেত্রেও আসলে তারা বলতে পারে, বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর নতুন বই প্রতিনিয়ত কেনার টাকা নেই কিংবা ভালো ভালো জার্নাল গুলোর এক্সেসের টাকাও বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর নেই; তাই তারা সে গুলো ব্যাবহার করতে পারে না। আর সেই জন্য ভালো গবেষণাও সম্ভব হয় না। এটিও অস্বীকার করা কোন উপায় নেই।
আসলে বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর গবেষণা ফান্ড অবশ্যই থাকা উচিত। সেটা সরকার থেকে হোক কিংবা শিক্ষকরা নিজেরাই সেটার ব্যবস্থা করুক। শিক্ষকদের বেতন ও মর্যাদা বাড়ানোর যেই দাবী সেটি নিয়ে নিশ্চয়ই সরকার ও যথাযথ কতৃপক্ষ ভেবে দেখবেন। তবে শিক্ষকদেরও নিজেদের দায় রয়েছে আজ এই অবস্থায় পৌঁছানর পেছনে। দেশের শ্রমিক, কৃষক যাদের ট্যাক্সের টাকায় বেতন আসে তাদের জন্য সবাই এক না হতে পারলেও নিজেদের প্রয়োজনে ঠিকই এক হওয়া গেলো। বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর কাঠামোগত সমস্যা, হল, পরিবহন, ছাট-ছাত্রীদের সমস্যা, যৌন নিপীড়নের মতো ঘটনা গুলোতে তারা এক হতে পারে না। কিন্তু নিজেদের প্রয়োজনে ঠিকই পারলো। এভাবে করে আর যাই হোক মর্যাদা বৃদ্ধি করা কতোটা সম্ভব সেই প্রশ্ন কিন্তু ঠিকই উঠবে। ইউরোপ, আমেরিকায় ইংরেজিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেলায় একটা কথা ব্যাপক ভাবে প্রচলিত আছে “পাবলিশ ওর প্যারিশ” (publish or perish!) অর্থাৎ হয় ভালো কোন জার্নালে গবেষণা প্রকাশনা করতে হবে নয়তো চাকরি খোয়াতে হবে। ইউরোপের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়েই শিক্ষকদের চাকরি পুরোপুরি স্থায়ী নয়। প্রতি বছর তাদের গবেষণা কর্মের হিসেব দিতে হয়। আবার এমনও আছে, প্রতি পাঁচ বছর পর পর সেই হিসেব করে যদি দেখা যায় তাদের প্রকাশনা আপডেটেড হয়নি, তাহলে চাকরি চলে যাবার নজিরও রয়েছে। তাই তারা গবেষণা কর্মে মনযোগী হয়। বাংলাদেশে অবশ্য এই বিষয় চালু নেই। একবার শিক্ষক হয়ে যেতে পারলে গবেষণা করুক আর নাই করুক, আপডেটেড হউক আর না হউক, চাকরি ঠিকই থেকে যাবে।
অষ্টম বেতন কাঠামো অনুযায়ী শিক্ষকদের বেতন ও মর্যাদার যে দাবি সেটি হয়তো সঠিক দাবি এই অর্থে, যে বেতন তারা পায় সেটি দিয়ে আসলে এই সময় সংসার চালনো কঠিন; তাই সরকারের উচিত হবে দাবিটি বিবেচনায় নেয়া। তবে শিক্ষকদের নিজেদের দাবি আদায়ের আন্দোলনের সাথে সাথে নিজেদের কিভাবে আরো সমুন্নত করা যায়, সেই দিকটিও ভাবতে হবে। নিজেদের অধিকার আদায়ে তারা এক হয়েছে, যেটি ভালো একটি দিক; তবে দেশের প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক থেকে শুরু করে সকল শিক্ষকদের বেতন ও মর্যাদার প্রশ্নেও যদি তারা এক হয় এবং দাবির প্রতি সোচ্চার হয় এবং সেই দাবির প্রতি দল মতের ঊর্ধ্বে উঠে মতামত প্রকাশ করতে পারে,তাহলে হয়তো ব্যাপারটি আরো বেশি সার্বজনীন দেখাবে। দেশের সাধারণ মানুষের ট্যাক্সের টাকায় তাদের বেতন-ভাতা দেয়া হয়; তাই সাধারণ মানুষের প্রতি তাদের যে দায় রয়েছে সেটি যেন তারা ভুলে না বসে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)