সম্প্রতি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র র্যাগিং এর শিকার হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়েছে, এমন খবরে দেশের সচেতন মহল বিশেষভাবে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলেমেয়েদের অভিভাবকেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ ও সিনিয়রদের দ্বারা নব্য ভর্তি হওয়া ছাত্রছাত্রীদের অপহৃত তথা লাঞ্জিত হওয়ার বিষয়ে উদ্বেগ ও আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে র্যাগিং একটি অলিখিত বিষয়। র্যাগিং এর বিধান কোথাও নেই তথাপি নতুন ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের অধিকাংশই এই টার্মের সাথে পরিচিত হয়েছে। আবার এমনো দেখা গেছে ভর্তির প্রাক্কালে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অফিস র্যাগিং ও সকল ধরনের অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে নোটিশ দিয়ে থাকে। যাতে নতুন ভর্তিচ্ছুদের সাথে কেউ খারাপ আচরণ করার সাহস না দেখায়। তারপরেও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে র্যাগিং সংস্কৃতি বিলুপ্ত হচ্ছে না। ভর্তি পরীক্ষার সময় থেকে শুরু হয়ে ক্লাস শুরুর পরেও অর্থাৎ ১ম সেমিস্টার পর্যন্ত র্যাগিং নামক অপসংস্কৃতির চর্চা দেখা যায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে।
প্রশ্ন আসতে পারে, ভর্তিচ্ছু সকলেই কি র্যাগিং এর শিকার হয়? সহজ উত্তর হল, সবাই শিকার হয় না, তবে ভর্তিচ্ছু একটা বড় অংশই কোন না কোন ভাবে র্যাগিং এর শিকার হয়ে থাকে। তবে যাদের ক্লোজ সিনিয়ররা বিশ্ববিদ্যালয়ে আছে তাদের কয়েকজন হয়তো র্যাগিং নামক অপসংস্কৃতি থেকে রক্ষা পেয়ে থাকে। অন্যদিকে, র্যাগিং এর শিকার হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি বিরক্ত আসে নাই এমন ছাত্রের সংখ্যা খুবই কম পাওয়া যাবে। পূর্বে র্যাগিং এর শিকার হয়ে কেউ বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে যায়নি দেখে এ সংক্রান্ত নিউজ খুবই কম দেখা যায় নিউজফিডে। কিন্তু এ কথা অস্বীকার করার সুযোগ নেই, বিশ্ববিদ্যালয়ে র্যাগিং একটি অলিখিত বাধ্যতামূলক বিধান। এবং এটাও উল্লেখ্য, গ্রামের সহজ সরল ছেলেরা অধিক পরিমাণে র্যাগিং এর শিকার হয়ে থাকে।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এর ছাত্র হওয়ায় র্যাগিং এর সাথে আমারও যথেষ্ট পরিচয় রয়েছে। শুধু কি পরিচয়, এর বাইরেও র্যাগিং হজম করার বিষয়েও ব্যাপক অভিজ্ঞতা রয়েছে। একদিনে ৩ বার র্যাগিং এর শিকার হওয়ার পরে একটি ছেলের মানসিক অবস্থা কেমন হতে পারে ব্যক্তিক অভিজ্ঞতার আলোকেই লেখার চেষ্টা করেছি। আমি গ্রামের ছেলে, সহজ-সরল হওয়ায় আমাকে স্মার্ট বানানো বড় ভাইদের বাড়তি দায়িত্ব হয়ে পড়ে। সে বিবেচনাতেই আমাকে একদিনেই ৩ বার র্যাগ দেওয়া হয়। সেদিন বিদঘুটে অন্ধকার ছিল, বড় ভাইদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে আমাকে এক মেস থেকে অন্য মেসে নিয়ে যাওয়া হয়। সেদিনকার বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতার কথা আজও মনে হয় আমার। ভয়ে যন্ত্রনায় চোখে পানি আসার মূহুর্তে এক বড় ভাইয়ের সহায়তার কথা আজো স্মৃতিতে অমলিন। নতুন করে নামতা তৈরি করতে হয়েছিলো আমাকে, গানের সাথে সাথে নাচতেও হয়েছিলো। অথচ, নাচের সাথে কোনদিনও পরিচয় ছিল না আমার। আমার ভগ্ন রূপ দেখে বড় ভাইদের সেই কি সুখ!
এখন প্রশ্ন আসতে পারে র্যাগিং কি এবং কেন দেওয়া হয়ে থাকে? র্যাগিং হচ্ছে ৫-১০ জন শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ে নব্য ভর্তি হতে আসা শিক্ষার্থীকে নানা প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে হাসি তামাশা করা, নানাভাবে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীকে মানসিক এবং শারীরিকভাবে নির্যাতন করা। নতুন শিক্ষার্থীকে করা যে কোন প্রশ্নের উত্তর সঠিক হলেও প্রশ্নকর্তা নানাভাবে নব্য শিক্ষার্থীকে হাসির পাত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে থাকে, বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে অপমান করতেও কুন্ঠাবোধ করেন না। অর্থাৎ আপনি প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিলেও কোনভাবেই সে উত্তর তাদের কাছে টিকবে না, বরঞ্চ উত্তরের প্রেক্ষাপট নিয়ে আপনাকে আরো বেশি পরিমাণে নাজেহাল করতে পারে। আপনাকে নাজেহালেই থাকে র্যাগিং এর উদ্দেশ্য এবং সেটা যে কোন উপায়েই হয়ে থাকে।
র্যাগিং মানেই এক পাক্ষিক ভাইভা বোর্ড। সেখানে আপনার উত্তর কখনোই সঠিক হবে না। আর সব উদ্ভট প্রশ্ন করা হয় র্যাগিং বোর্ডে। আমার স্মৃতিপটে এখনো মনে আছে, ভর্তির সময় আমাকে র্যাগিং এ কি কি প্রশ্ন করা হয়েছিলো। প্রথম প্রশ্নটা ছিল এমন: ঢাকা থেকে গোয়া কতদূর? আমি সঠিক উত্তর দিলেও কোনভাবেই তারা সেটা মেনে নেয়নি, বরঞ্চ সঠিক উত্তর দিলে ভিন্ন প্রেক্ষিত নিয়ে আলোচনা করে থাকে। পরে আরো সব উদ্ভট প্রশ্ন করা হয়েছিলো র্যাগিং এর সময়। যেগুলো এখানে আনতে শ্লীলহীণতার অবকাশ থাকতে পারে, কিন্তু মানসিকভাবে মারত্নক প্রভাব ফেলেছে। তবে র্যাগিং এর পরে আপ্যায়নের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। বিষয়টা এমন, আঘাত করে মলম লাগিয়ে প্রলেপ দেওয়ার প্রচেষ্টা মাত্র।
র্যাগিং এর পরে একজন নব্য ভর্তি হওয়া ছাত্রের মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। শিক্ষাজীবনের শুরুতেই এমন একটা বাজে ধাক্কার কারণে স্বাভাবিক কার্যক্রমে নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি হয়। সিনিয়রদের উপরে অন্তরে প্রোথিত ক্ষোভ সারাজীবন বয়ে চলে। নিজে যেমন অপসংস্কৃতির স্বীকার হয়ে থাকে ঠিক তেমনি পরবর্তীতে নতুনদেরকেও র্যাগিং সংস্কৃতির সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। এমন ও হয়েছে, কিছু কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে র্যাগিং বিশেষজ্ঞ থাকে। খুব স্মার্ট ছেলেদের র্যাগ দিয়ে সহসাই কিভাবে পরাস্থ করতে হয় তার জন্য একটি গ্রুপ রেডি করাই থাকে। খুবই হাস্যকর বিষয় র্যাগিং বিশেষজ্ঞদের বিশেষ রকমের চাহিদা বেড়ে যায় ভর্তি পরীক্ষার সময়ে।
আবার অনেকে র্যাগিং কে সিনিয়র জুনিয়রদের মেলবন্ধন হিসেবে আবিষ্কার করে থাকে। কিন্তু এ রকম র্যাগিং খুব কমই হয়ে থাকে। যেখানে জুনিয়রের পরিচয় নিয়ে আপ্যায়ন করে সিনিয়রদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। সেখানে কোন ধরনের নোংরা প্রশ্নবাণে জর্জরিত হতে হয় না ভর্তি হতে আসা শিক্ষার্থীকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মকানুন, পড়াশোনা এবং অন্যান্য বিষয়ে শিক্ষার্থীদেরকে অবগত করা হয়ে থাকে। এ রকম সম্পর্কের পরিণতি পরবর্তীতে আরো আশাব্যঞ্জক হয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যয়নকালিন সময়ে।
র্যাগিং কে কিভাবে প্রতিরোধ করা যায়, কিভাবে এ অপসংস্কৃতির মোড়ক থেকে নতুন ছেলেমেয়েদের দূরে রাখা যায় সে ব্যাপারে প্রত্যেককেই নিজ নিজ জায়গা থেকে সচেতন ও মানবিক গুণসম্পন্ন হতে হবে। র্যাগিং এর সংস্কৃতি বন্ধে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের গৃহীত কোন পদক্ষেপই কাজে আসবে না যতক্ষণ না পর্যন্ত সিনিয়র ছাত্ররা এর বিরুদ্ধে সোচ্চার না হবে। যদি একটি সেশনের কেউই র্যাগিং এর শিকার না হয়ে থাকে তাহলে হলফ করে বলা যায় পরের সেশন থেকে কেউই র্যাগিং এর শিকার হবে না। কারণ, এমনো দেখা গেছে কেউ একবার র্যাগিং এর শিকার হলে পরবর্তীতে তার ভেতরে জুনিয়রদেরকে র্যাগিং দেওয়ার প্রবণতা কাজ করে থাকে। তাই একটা সেশন র্যাগিং ব্যতীত ভর্তি হলে পরবর্তীতে র্যাগিং এর অপসংস্কৃতি থেকে সহজেই সকলে বের হয়ে আসতে পারবে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)