দর্জি দোকানি বিশ্বজিৎ কোন রাজনৈতিক দল করতেন না। তিনি ছিল নিরস্ত্র এবং নিরীহ। এই হত্যাকাণ্ডটি পূর্বপরিকল্পিত না হলেও হামলাকারীদের উন্মত্ত আক্রমণেই বিশ্বজিতের মৃত্যু হয়েছে বলেই হাইকোর্টের দেয়া রায়ের পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে।
কোনো রাজনৈতিক দলের নাম উল্লেখ না করে রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, ছাত্র রাজনীতি তার গৌরব ধরে রাখতে পারছে না। অস্ত্র এবং মাদক বর্তমান ছাত্র রাজনীতিতে প্রকাশ্য বিষয়। ফলে ছাত্র রাজনীতির নামে তারা চাঁদাবাজি, হত্যা, খুনসহ বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িত হয়। মাদক এবং অস্ত্রের প্রভাবে কোন কোন সময় ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে জড়িতরা হিংস্র, ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে।
কিছু রাজনৈতিক নেতা এ ব্যাপারে প্রণোদনাও দিয়ে থাকে। তারা মনে করে এতে তাদের রাজনৈতিক পরিচিতি আরো সমৃদ্ধ হবে। এমন একটা সিস্টেম দাঁড়িয়ে গেছে যে, মিছিলে লোক বাড়ানোর জন্য সাধারণ শিক্ষার্থীদের বাধ্য করা হয়। অনেক সময় আবাসিক শিক্ষার্থীরা হলের সিট ধরে রাখতে মিছিলে বা কর্মসূচিতে আসতে বাধ্য হয়।
যদি সাধারণ শিক্ষার্থীরা দলীয় কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ না করে তবে তাদের নির্যাতনের শিকার হতে হয়। এরকম ঘটনাও দেখা গেছে যে, পরীক্ষার হলে নকল করতে না দেওয়ায় দায়িত্বরত শিক্ষককে মারধর করা হয়েছে। এটি ছাত্র রাজনীতির জন্য অশনি সংকেত। কারণ তারাই ভবিষ্যতে জাতীয় রাজনীতিতে নেতৃত্ব দিবে।
পর্যবেক্ষণে আরো বলা হয়, সাক্ষ্য এবং ভিডিও চিত্রে বিশ্বজিতের শরীরে একাধিক আঘাতের উল্লেখ থাকলেও মামলার সুরতহাল, ময়না তদন্তের প্রতিবেদনে একটি মাত্র আঘাতের কথা এসেছে। তবে প্রতিবেদন দু’টিতে আঘাতের স্থান নিয়ে গড়মিল রয়েছ।
আদালত পর্যবেক্ষণে বলেন, একটি অস্বচ্ছ তদন্ত সমাজকে বিপর্যয়ের মধ্যে ফেলতে পারে। এবং সমাজে এ ধরনের অপরাধ করার ক্ষেত্র প্রস্তুত করে দিতে পারে। ফলে ন্যয়বিচারের সার্থেই এই দুটি (সুরতহাল এবং ময়নাতদন্ত) বিষয়ে অনুসন্ধান হওয়া প্রয়োজন।
যারা বা যিনি সুরতহাল এবং ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করেছেন তারা তাদের কর্তব্য পালন করতে গিয়ে কোনো ধরনের অবহেলা বা গাফিলতি করেছেন কিনা সেটিও অনুসন্ধানের দাবি রাখে।
রাজধানীর পুরান ঢাকায় নিহত দর্জি দোকানি বিশ্বজিৎ দাস হত্যা মামলায় বিচারিক আদালত ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগের যে ৮ জন নেতাকর্মীকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন তার মধ্যে ৬ জনকে রেহাই দিয়ে অন্য সাজা দিয়েছেন হাইকোর্ট। তবে দুই জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখা হয়েছে।
রোববার বিচারপতি মো. রুহুল কুদ্দুস ও বিচারপতি ভীষ্মদেব চক্রবর্তীর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এই রায় ঘোষণা করেন।
রায়ে মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখা হয়েছে- রফিকুল ইসলাম শাকিল ও রাজন তালুকদারের। আর মৃত্যুদণ্ড থেকে খালাস পেয়েছেন- সাইফুল ইসলাম ও কাইয়ুম মিঞা টিপু।
মৃত্যুদণ্ড থেকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে- মাহফুজুর রহমান নাহিদ, এমদাদুল হক এমদাদ, জি এম রাশেদুজ্জামান শাওন ও মীর মো. নূরে আলম লিমন।
এছাড়াও বিচারিক আদালতের দেয়া যাবজ্জীবন থেকে খালাস পেয়েছেন- এএইচএম কিবরিয়া ও গোলাম মোস্তফা।
রায়ের বিরুদ্ধে আবেদন না করায় বিচারিক আদালতে যাবজ্জীবনপ্রাপ্ত বাকি ১১ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বহাল রাখা হয়েছে। তারা হলেন, খন্দকার ইউনুস আলী, তারেক বিন জোহর, আলাউদ্দিন, ওবায়দুল কাদের, ইমরান হোসেন, আজিজুর রহমান, আল আমিন শেখ, রফিকুল ইসলাম, মনিরুল হক পাভেল, কামরুল হাসান ও মোশাররফ হোসেন।
গত ১৭ জুলাই এই মামলার ডেথ রেফারেন্স ও আসামিদের করা আপিল শুনানি শেষে রায়ের জন্য ৬ আগস্ট দিন ধার্য করা হয়।
২০১৩ সালের ১৮ ডিসেম্বর বহুল আলোচিত এই হত্যা মামলায় ৮ জনকে মৃত্যুদণ্ড ও ১৩ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন ঢাকার চার নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক এবিএম নিজামুল হক। এরপর হত্যা মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামীদের ডেথ রেফারেন্স হাইকোর্টে আসে। সেই সঙ্গে মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে আপিল করে আসামীরা।
ঢাকার চার নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের দেয়া রায়ে মৃতুদণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন- রফিকুল ইসলাম শাকিল, মাহফুজুর রহমান নাহিদ, এমদাদুল হক এমদাদ, জি এম রাশেদুজ্জামান শাওন, সাইফুল ইসলাম, কাইয়ুম মিঞা টিপু, রাজন তালুকদার এবং মীর মো. নূরে আলম লিমন।
এদের মধ্যে রাজন তালুকদার ও নূরে আলম পলাতক। বাকি ছয়জন কারাগারে আছে।
আর যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্তরা ছিলেন- এএইচএম কিবরিয়া, ইউনুস আলী, তারিক বিন জোহর তমাল, গোলাম মোস্তফা, আলাউদ্দিন, ওবায়দুর কাদের তাহসিন, ইমরান হোসেন, আজিজুর রহমান, আল-আমিন, রফিকুল ইসলাম, মনিরুল হক পাভেল, মোশাররফ হোসেন ও কামরুল হাসান।
ওই রায়ে তাদের প্রত্যেককে ২০ হাজার টাকা করে অর্থদণ্ড করা হয়।
ঢাকার চার নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের দেয়া রায়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পাওয়া ১৩ জন হলেন- এ এইচ এম কিবরিয়া, গোলাম মোস্তফা, খন্দকার ইউনুস আলী, তারেক বিন জোহর, আলাউদ্দিন, ওবায়দুল কাদের, ইমরান হোসেন, আজিজুর রহমান, আল আমিন শেখ, রফিকুল ইসলাম, মনিরুল হক পাভেল, কামরুল হাসান ও মোশাররফ হোসেন। এদের মধ্যে এস এম কিবরিয়া ও গোলাম মোস্তফা কারাগারে আছে। বাকি ১১ জন পলাতক।
২০১৩ সালের ৫ মার্চ ছাত্রলীগের ২১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেন মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। ২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর ১৮ দলের অবরোধ কর্মসূচি চলাকালে রাজধানীর পুরান ঢাকার ভিক্টোরিয়া পার্কের সামনে নির্মমভাবে খুন হন বিশ্বজিৎ দাস।