বিশ্বকাপ ফুটবলকে বলা হয়ে থাকে ‘গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’। সারাবিশ্বের সেরা সব ফুটবল শক্তিকে নিয়ে মাসব্যাপী এবারের যে আয়োজন বসেছিল রাশিয়াতে, বর্ণিল ও ঘটনাবহুল সেই বিশ্বকাপের সফল সমাপ্তি হয়েছে।
দ্বিতীয়বারের মতো বিশ্বকাপ জিতে নিয়েছে ফ্রান্স, আর ফাইনালে না জিতলেও কোটি মানুষের ভালোবাসা ও মনোযোগ কেড়েছে ক্রোয়েশিয়া। রাশিয়ার বিভিন্ন ভেন্যুতে এই বিশাল ক্রীড়াযজ্ঞ কোনো ধরণের অপ্রীতিকর ঘটনা ছাড়াই শেষ করতে পেরেছে ফিফা ও স্বাগতিক রাশিয়া। সেজন্য তারা বিশেষ ধন্যবাদ পাবার দাবিদার।
স্বাগতিক রাশিয়া আর সৌদি আরবের উদ্বোধনী ম্যাচ থেকে শুরু করে ফ্রান্স-ক্রোশিয়ার ফাইনাল পর্যন্ত ছিল নাটকীয়তা আর ভরপুর উত্তেজনা। গতবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন জার্মানির প্রথম রাউন্ডে বিদায়, আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল-স্পেনের একে একে বিদায়ের মধ্যে দিয়ে জমে উঠেছিল বিশ্বকাপ। নবীন আইসল্যান্ডের প্রথম বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ, কোনো রকম মনোযোগে না থাকা রাশিয়ার কোয়ার্টার ফাইনালে চলে যাওয়া, বেলজিয়ামের চমকপ্রদ নৈপূণ্য আর ক্ষুদ্র জাতির লড়াকু ক্রোয়েশিয়া ছিল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে।
এবারের বিশ্বকাপে বরাবরের মতো বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের মিলনমেলা বসেছিল। অনেকদিন লোকচক্ষুর আড়ালে থাকা সৌদি যুবরাজ উদ্বোধনী ম্যাচে রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের পাশে বসে খেলা উপভোগ করে গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছেন, খেলা চলাকালীন তাদের নানা মুহূর্তও সবার নজর কেড়েছে। তবে ক্রোয়েশিয়ার প্রেসিডেন্ট কোলিন্দা গ্রাবার কিতারোবিচ এবারের বিশ্বকাপে সবচেয়ে আলোচিত ব্যক্তিত্ব। সাধারণ বিমানে রাশিয়া গমন, মাঠে ম্যাচ চলাকালীন বাঁধাহীন উচ্ছাস, ড্রেসিংরুমে খেলোয়াড়দের সঙ্গে নৃত্য আর ফাইনাল ম্যাচে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টকে চুম্বন করে আলোচনায় ছিলেন তিনি। সর্বোপরি তার দারুণ ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ পুরো বিশ্ব।
জাতিগত রাজনৈতিক উত্তাপও ছিল এবারের বিশ্বকাপে। ইরানকে ফুটবল সামগ্রী দিতে যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানির মানা করা, সুইজারল্যান্ডের কয়েকজন খেলোয়াড়দের সার্ব গণহত্যার বিরুদ্ধে প্রতীকি উদযাপন, ইউক্রেনের পক্ষে ক্রোয়েশিয়া খেলোয়াড়ের মন্তব্য আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছে।
ব্রাজিলের তারকা খেলোয়াড় নেইমার জুনিয়ারের ফাউল পরবর্তী কর্মকাণ্ড যেমন আলোচনার জন্ম দিয়েছে, তেমনি প্রত্যাশার চাপ পূরণ করতে না পারা আর্জেন্টাইন তারকা মেসির ব্যর্থতা কষ্ট দিয়েছে কোটি দর্শককে। গতি দানব লুকাকু, তরুণ প্রতিভা এমবাপ্পে, নিজ নিজ দলের সফল নিউক্লিয়াস হ্যাজার্ড-মদ্রিচদের ফুটবল নৈপূণ্যে মুগ্ধ সারাবিশ্ব।
ফুটবল মাঠের গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল-প্রেক্ষাপট বিচারে প্রযুক্তির ব্যবহার আর উল্লেখযোগ্য সংখ্যক আত্মঘাতি গোল সবার মনোযোগ কেড়েছে। প্রথম দিকের কিছু ম্যাচ ড্র হলেও যতই সময় গড়িয়েছে প্রতিটি ম্যাচ হয়ে উঠেছিল আকর্ষণীয়। গোলের খেলা ফুটবলে প্রতিটি ম্যাচেই ছিল উল্লেখযোগ্য সংখ্যক গোল। গোলের সংখ্যা আরও বাড়তো যদি না প্রাচীরের মতো নৈপূণ্য প্রদর্শন করতেন বিভিন্ন দলের গোলকিপাররা।
বিশ্বকাপ শুরুর আগে বিভিন্ন গণমাধ্যমে এর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে নানা শঙ্কা ছিল, তা পুরোপুরি মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। গ্যালারিতে এক ম্যাচে আর্জেন্টিনার সমর্থকদের ও অন্য আরেকটি ম্যাচে ব্রাজিল সমর্থকদের উশৃঙ্খলতা, রাশিয়ার খেলোয়াড়দের ড্রাগস নেবার গুজব আর ফাইনাল ম্যাচে পুতিনবিরোধী গোষ্ঠীর কয়েকজনের মাঠে নেমে আসা ছাড়া কোনো নেতিবাচক কিছু লক্ষ্য করা যায়নি। এতোবড় ফুটবলযজ্ঞে এগুলো খেয়াল না করার বিষয় বলেই আমাদের মনে হয়েছে। বরং উদাহরণ হয়েছে ম্যাচ শেষে জাপান ও সেনেগাল সমর্থকদের গ্যালারি পরিস্কার করার দৃশ্য। দ্বিতীয় রাউন্ডে হেরে গিয়েও ড্রেসিং রুম সাফ-সুতরো করে জাপানি খেলোয়াড়রাও অনন্য দৃষ্টান্ত রেখেছেন। তাদের সবাইকে আমাদের অভিনন্দন।
পরবর্তী ‘গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’ বসতে যাচ্ছে কাতারে ২০২২ সালে। সে পর্যন্ত বর্ণিল ও ইতিবাচক এই ফুটবল ধারা বজায় থাকুক। ফুটবলের জয় হোক।