আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীক নিয়ে একাদশ সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হওয়া ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বিরোধী দলের আসনে বসা প্রসঙ্গে বলেছেন- না, আমরা ১৪ দলেই আছি।
মেননের মতোই ১৪ দল হতে নির্বাচিত হয়েছেন জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু ও জেপির চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মঞ্জু। তাদের দল থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্যরাও দশম সংসদে সরকারি দলের আসনেই ছিলেন। তার আগে নবম সংসদেও সরকারি দলের আসনে ছিলেন এই দলগুলোর নেতারা। তখন শেখ হাসিনা জোট শরিক দলগুলোর মধ্য হতে টেকনোক্র্যাট কোটায় মন্ত্রীও করেছিলেন সাম্যবাদী দলের দিলীপ বড়ুয়াকে।
আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর দল জাতীয় পার্টির (জেপি) মহাসচিব শেখ শহিদুল ইসলাম সরাসরিই বলেছেন, তারা বিরোধী দলে যাবেন না এবং অন্যদেরও বিরোধী দলে যাওয়ার সুযোগ নেই। শেখ শহীদুল ইসলাম আরও বলেন, মহাজোট থেকে যারা নৌকা মার্কায় নির্বাচন করেছে, তাদের বিরোধী দলে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আর্টিকেল ৭০ অনুযায়ী বিরোধী দলে গেলে তাদের সংসদ সদস্য পদ বাতিল হয়ে যাবে৷
গণতন্ত্রে সরকার দল ও বিরোধী দল দুটোই জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত হওয়ার রীতি৷ দশম সংসদ হতে বিরোধী দল নিয়ে শুরু হয়েছে এক ধোঁয়াশা৷ বিএনপি ও ২০ দল নির্বাচন বর্জন করে সরকার দল ও বিরোধী দল দুটোর একটিও হতে পারলো না৷ সরকারে গেল মহাজোট৷ অতঃপর মহাজোটের জাতীয় পার্টির(এরশাদ) এর চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ হলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ দূত ও এরশাদ পত্নী জাতীয় পার্টির নেতা রওশন এরশাদ হয়ে গেলেন বিরোধী দলীয় নেতা৷ আবার জাতীয় পার্টির (এরশাদ) কয়েকজন সাংসদ মন্ত্রীও হয়েছিলেন৷ দশম সংসদে জাতীয় পার্টির সাংসদরা সরকার ও বিরোধী দল দুটোর অধীনেই ছিলেন৷ একাদশ সংসদ নির্বাচনে বিএনপি, ২০ দল ও ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচনে অংশগ্রহণ করায় বিরোধী দল হওয়ার একটা প্রত্যাশা ছিল৷ কিন্তু নির্বাচনী ফলাফলে বিএনপি, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও ২০ দল মিলে আসন পেল ৮টি৷তাছাড়া এই ৮ আসনে তারা সাংসদ হিসাবে শপথ ও নেয়নি৷ নির্বাচনটিতে দৃশ্যমান দুটো পক্ষ ছিল মহাজোট ও ঐক্যফ্রন্ট৷
মহাজোটে ছিল আওয়ামী লীগ, ওয়ার্কার্স পার্টি, জাতীয় পার্টি (এরশাদ), জাসদ (ইনু) ও জাতীয় পার্টি (মঞ্জু)৷ এই দলগুলো জাতীয় পার্টি(মঞ্জু) ছাড়া সকলেই নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে অংশ নিয়েছে৷ একসাথে নির্বাচন করে নির্বাচন পরবর্তী ফলাফলের পর মহাজোটের নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগ মহাজোটের শরীক জাতীয় পার্টিকে (এরশাদ) মন্ত্রীসভায় না নিয়ে বিরোধী দল হতে দিল৷ সে মোতাবেক বিরোধী দলীয় নেতা হয়ে গেলেন প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এরশাদ৷ এক্ষেত্রে প্রশ্ন জাগে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত পদটি কবে ও কখন অকার্যকর হলো?
আওয়ামী লীগ ১৪ দলের শরীক দলগুলোকে নির্বাচনে জিতিয়েছে সমর্থন দিয়ে ও নৌকা মার্কা দিয়ে৷ তারা বিরোধী দল হলে তাদের বিরোধী দলীয় নেতা হবে কে? তবে কি তারা বিরোধী দলীয় নেতা এরশাদের নেতৃত্বে সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করবে? নাকি ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাসদ (ইনু)ও জাতীয় পার্টির মতো নিজ দলীয় বিরোধী দলীয় নেতা নির্বাচন করবে৷ এক সংসদে কয় বিরোধী দলীয় নেতা হতে পারে? বিরোধী দল হয়ে ওঠায় কি কেবলই সরকারি নির্দেশনা জনগণের ও সংশ্লিষ্ট দলের ইচ্ছা অনিচ্ছার কোন মূল্য নেই? নইলে যেসব শরীক দল সরকারে থাকতে চায় তাদের কেন বিরোধী দলের দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে?
জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ৮ সাংসদ যদি সংসদ সদস্য হিসাবে শপথ নিতেন তারা নিশ্চয়ই এরশাদকে বিরোধী দলীয় নেতা মেনে সংসদে যেতেন না৷ নাকি তখন তাদেরও আলাদা বিরোধী দলীয় নেতা থাকতো? নাকি অধিক সংখ্যক সংসদ সদস্যই বিরোধী দলীয় নেতা হয়ে ওঠার মানদণ্ড? সেক্ষেত্রে কি কারও সমর্থন অসমর্থনের কোন মূল্য নেই? প্রশ্নটা সংসদীয় রাজনীতির বিদগ্ধজনদের প্রতিই রইলো৷
বিরোধী দল প্রসঙ্গে একসময়ের সরকার প্রধান ও বিরোধী দলীয় প্রধান বেগম খালেদা জিয়া আদালতে দুদকের আইনজীবী মোশারফ হোসেন কাজলের, ‘আপনারাতো এখন বিরোধী দলে নেই’ উক্তির পরিপ্রেক্ষিতে বলেছেন, বিরোধী দল শুধু পার্লামেন্টের ভেতরে থাকলেই হয় না, বাইরে থাকলেও হয়৷ আবার এখন দেখি, বিরোধী দল সরকারের সঙ্গে থেকেও হয়৷ যারা জনগণের জন্য কথা বলে, তারাই বিরোধী দল৷ বিরোধী দল নিয়ে নানা মতের সমন্বিত নির্যাস নিয়ে একটি স্পষ্টতর মানদণ্ড ঠিক করে দেয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ নয় কি?
২০১৮ সাল পর্যন্ত নির্বাচনে অংশগ্রহন ও বর্জনের দিক বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় ১৯৮৬ সালে আওয়ামী লীগ অংশ নিলেও বিএনপি বর্জন করে৷ ১৯৮৮ সালের নির্বাচন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয়েই বর্জন করে৷ ১৯৯১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও বামদল সকলই অংশগ্রহণ করে৷ ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারীর নির্বাচন বর্জন করে আওয়ামী লীগ৷২০১৪ সালে নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি৷১৯৮৮ সালে নির্বাচন বর্জন করে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুই দলই৷ অতঃপর এই দুই দল কি বিরোধী দল হিসাবে সামরিক শাসন বিরোধী গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেয়নি? এরশাদের আমলে সরকারি মদদে গঠিত বিরোধী দল ছিল আ স ম আব্দুর রব নেতৃত্বাধীন সম্মিলিত বিরোধী দল৷ এবারও কি আওয়ামী লীগের বাইরের সব দল নিয়ে যেমন জাতীয় পার্টি (এরশাদ), ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ (ইনু), জাতীয় পার্টি (মঞ্জু)কে নিয়ে সম্মিলিত বিরোধী দলের মতো বিরোধী দল হতে চলেছে? সেদিনের বিরোধী দল গ্রহণযোগ্যতা পায়নি যদি এবারেও তার পুনরাবৃত্তি ঘটে তা কি গ্রহণযোগ্যতা পাবে? আর জনগণ কি এসব দলকে বিরোধী দল হিসাবে ভোট দিয়েছে? নির্বাচনে ভোট নেয়ার সময় একদিকে থেকে নির্বাচনের পরে অন্যদিকে ঘুরে যাওয়া কি গণতান্ত্রিক রীতি সম্পন্ন হয়?
বিরোধী দল কি তবে দুই ধরনের হচ্ছে মহাজোট শরীকরা সরকারি বিরোধী দল ও ২০ দল, ঐক্যফ্রন্ট বেসরকারি বিরোধী দল? বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলের সংসদ সদস্যরা সরকার দলের সাংসদ না হলে কেঊ সংসদে যেতে চায় না৷ এই রীতিটা আওয়ামী লীগ বিএনপি দুই দলের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য৷ সবাই সরকারি সাংসদ হতে চায় বিরোধী সাংসদ নয়৷কিন্তু বিরোধী দল ছাড়া গণতন্ত্র না হলে জাতীয় সংসদ হয় কী করে? সংসদীয় গণতন্ত্রে বিরোধী দলের সাংসদদের কাজ হলো সরকার দলের ভুলত্রুটি তুলে ধরা৷ সরকার যাতে দেশ ও জনগণের স্বার্থবিরোধী কোন আইন পাশ করতে না পারে সে ব্যাপারে সোচ্চার হওয়া৷ জাতির প্রত্যাশা সরকারি, বেসরকারি ও গৃহপালিত বিরোধী দল নয় প্রত্যাশা গণতান্ত্রিক নৈতিকতাসম্পন্ন সত্যিকারের বিরোধী দল৷
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)