চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

বিমান ছিনতাই চেষ্টা: প্রশ্ন অনেক

ঢাকা থেকে দুবাইগামী বিমান ছিনতাইয়ের চেষ্টা, বিমানের দ্রুত অবতরণ এবং নিরাপদে সব যাত্রীর নেমে যাওয়ার পরে কমান্ডো অভিযানে অভিযুক্ত ব্যক্তির নিহত হওয়ার বিষয় নিয়ে সরকারের ভাষ্যের সাথে গণমাধ্যমেরে খবর এবং নিহত ব্যক্তির ফেসবুক প্রোফাইলের মিল খুবই কম। ফলে এই ঘটনার রহস্য জানতে কিছু প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করা জরুরি। তদন্তকারীরাও নিশ্চয়ই এই উত্তরগুলো জানার চেষ্টা করছেন।

এরই মধ্যে নিহত যুবকের পরিচয় মিলেছে। রোববার ঘটনার সময় তার নাম বলা হচ্ছিলো মাহাদি। কিন্তু এখন জানা যাচ্ছে তার আসল নাম পলাশ। বাড়ি নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও উপজেলার পিরিজপুর গ্রামে।গ্রামের বাইরে পলাশ অবশ্য নিজেকে মাহাদী নামেই পরিচয় দিতেন।

প্রেমে ব্যর্থ হয়ে তিনি বিমান ছিনতাইয়ের মতো দুর্ধর্ষ কাজ করেছেন বলে সরকারের তরফে প্রাথমিকভাবে জানানো হলে এ নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় বেশ হাস্যরসের সৃষ্টি হয় এবং অনেকেই এরকম মন্তব্য করেছেন যে, নাটকের স্ক্রিপ্ট ভালো হয়নি। পরে বাংলা চলচ্চিত্রের নায়িকা শিমলার নাম আসে। এখন দেখা যাচ্ছে যে, শিমলার সাথে আসলেই ওই নিহত যুবকের সম্পর্ক ছিল; যদি তার ফেসবুক প্রোফাইলটি ফেক বা ভুয়া না হয়।

সেই প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে আমরা সংক্ষেপে দেখে নিতে পারি, নিহত যুবকের বাবা সাংবাদিক ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কী বলেছেন?পলাশের বাবা মুদি দোকানি পিয়ার জাহান সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, পলাশ সোনারগাঁয়ের তাহেরপুর মাদ্রাসা থেকে দাখিল পাস করে সোনারগাঁ ডিগ্রি কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হয়েছিলেন। এরপর আর পড়াশোনা করেনি। গত ২২ ফেব্রুয়ারি পলাশ তার বাবাকে জানান, তিনি দেশে থাকবেন না, দুবাই চলে যাবেন। পিয়ার জাহানের দাবি, পলাশ তাদের অবাধ্য সন্তান। এর আগেও বিদেশে যাওয়ার কথা বলে অনেক টাকা নষ্ট করেছেন।

চিত্রনায়িকা শিমলাকে নিয়ে গত ১০ মাস আগে পলাশ বাসায় আসেন। পরে তারা জানতে পারেন তাদের বিয়ে হয়েছে। প্রথমে না মানলেও পরে পলাশের পরিবার বিয়ে মেনে নেয়। পরিবার জানাচ্ছে, এর আগে পলাশ আরেকটি বিয়ে করেন বগুড়ায়। তার একটি বাচ্চাও আছে। কিন্তু প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে তার ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। এছাড়া, এলাকায় নারী কেলেঙ্কারির একটি মামলায় পলাশ ২০ দিন জেলও খাটেন। গণমাধ্যমের অনুসন্ধান বলছে, র‌্যাবের ক্রিমিন্যাল লিস্ট বা অপরাধীর তালিকায়ও পলাশের নাম রয়েছে।

এবার তার ফেসবুক প্রোফাইলে একটু চোখ বোলানো যাক। ফেসবুকে তার নাম মাহিবি জাহান (Mahibi Jahan)। পরিচয় লিখেছেন, আইটি বিজনেস অ্যানালিস্ট। পড়াশোনা লোক প্রশাসন বিভাগ। বসবাস লিখেছেন গ্লাসগো, যুক্তরাজ্য। আর ফেসবুকে যুক্ত হওয়ার তারিখ দেখাচ্ছে জুন ২০১০।

যেখানে তার বাবা বলছেন, তার ছেলে ইন্টারমিডিয়েটের পরে আর পড়ালেখা করেননি, তিনি ফেসবুকে পরিচয় লিখেছেন আইটি বিজনেস অ্যানালিস্ট, আবার পড়াশোনা লোক প্রশাসনে। বসবাসের ঠিকানাও লিখেছেন ভুয়া। তার মানে এই ফেসবুক প্রোফাইলটি যদি নিহত পলাশেরই হয়, তাহলে শুরুতেই এই সিদ্ধান্তে আসা যায় যে, তিনি একজন মিথ্যাবাদী এবং প্রতারক।
ফেসবুকে তার সবশেষ স্ট্যাটাস দেখাচ্ছে ২৪ ফেব্রুয়ারি, যেখানে তিনি লিখেছিলেন : ‘ঘৃণা নিঃশ্বাসে প্রশ্বাসে।’এর আগে গত বছরের ২৪ ডিসেম্বর নায়িকা শিমলার সাথে একটি অন্তরঙ্গ ছবি পোস্ট করা। তার দুই মাস আগে ১২ অক্টোবর কানে মোবাইল ফোন ধরা একটি ছবি যেখানে তিনি ভুল ইংরেজিতে কিছু কথা লিখেছেন যার বাংলা এরকম: ‘বিদায় বাংলাদেশ। কিছু মানুষের জন্য দুঃখিত। পরে সবকিছু বলব। যখন আমি আমার গন্তব্যে পৌঁছাবো। শিগগিরই ফিরে আসব। আমাকে ক্ষমা করো।’ওই পোস্টে তিনি দেখাচ্ছেন, লন্ডনে যাচ্ছেন।

এর আগে ৩০ সেপ্টেম্বর শিমলাকে জড়িয়ে ধরে আরেকটি ছবি যেখানে লিখেছেন: ‘সুখে আমায় রাখবে কেন রাখো তোমার কোলে। যাকনারে সুখ জলে।’ ২৮ সেপ্টেম্বর শিমলার সাথে আরেকটি ছবি যেখানে ইংরেজিতে কিছু কথা লেখা যার তর্জমা অনেকটা এরকম: ‘ভালোবাসা আমাদের একবার স্পর্শ করতে পারে এবং একবার সারা জীবনের জন্য। যতক্ষণ না আমরা চলে যাই ততক্ষণ তাকে (ভালোবাসা) যেতে দিও না।’ এর চারদিন আগে ২৪ সেপ্টেম্বর শিমলার সাথে আরেকটা ছবি যেখানে তিনি লিখেছেন: ‘এই হচ্ছে আমার বউ যে আমার হাজারো ভুলের মাঝে, আমাকে সহ্য করে পার করে দিলো একটি বছর। দোয়া করবেন যাতে সারাটা জীবন এই পাগলিটা আর আমি একসাথে থেকে যেন মরতে পারি। বউ অনেক ভালোবাসি তোমায় আর কষ্ট দেব না। শুভ বিবাহ বার্ষিকী আদরের পুতুল বউ আমার।’ তার এই স্ট্যাটাস বলে দিচ্ছে শিমলাকে তিনি বিয়ে করেছেন ২০১৭ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর; আবারও বলছি যদি এই ফেসবুক প্রোফাইল ফেক না হয়।

নায়িকা শিমলাকে নিয়ে এই যে এত স্ট্যাটাস এবং নিহত যুবকের বাবাও জানাচ্ছেন যে, শিমলাকে তার ছেলে বিয়ে করে বাড়িয়ে নিয়ে এসেছিলেন, তখন এই ঘটনায় শিমলার বক্তব্য জানা খুবই জরুরি।কিন্তু একটি অনলাইন সংবাদপত্রের খবরে বলা হচ্ছে, শিমলা বর্তমানে দেশে নেই।

এখানে মূল যে প্রশ্নটি এখন সামনে আসছে তা হলো, ধরা যাক নায়িকা শিমলাকে তিনি বিয়ে করেছিলেন এবং দাম্পত্য জীবনে টানাপড়েন তৈরি হয়েছিল। কিন্তু তার অর্থ কি এই যে, তিনি বিমান ছিনতাইয়ের মতো ভয়াবহ ঝুঁকি নেবেন? বিমান ছিনতাই করে তিনি কী করতেন? আবার তিনি নাকি প্রধানমন্ত্রীর সাথে কথা বলতে চেয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর সাথে তার কী কথা? জীবিত থাকলে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে অনেক প্রশ্নের উত্তর জানা যেতো। কিন্তু নিহত হওয়ায় সেই পথ চিরতরে রুদ্ধ হলো।

উল্লেখ করা যেতে পারে, যেদিন এই ঘটনাটি ঘটলো, ঠিক তার আগের দিনই ফোনকলে ভারতে বিমান ছিনতাইয়ের হুমকি আসে। এরপর ভারতের সব বিমানবন্দরে বিশেষ সতর্কতা জারি করা হয় এবং প্রতিবেশী দেশগুলোর বিমানবন্দরগুলোকেও সতর্ক থাকার পরামর্শ দেয়া হয়। এই সতর্কতার পরদিনই ঢাকা থেকে দুবাইগামী বিমান ছিনতাইয়ের চেষ্টা। তাহলে ভারতের ওই সতর্কতার সাথে এই ঘটনার কি কোনো যোগসাজশ আছে? র‌্যাব বলছে যে তাদের অপরাধীর তালিকায় নিহত পলাশের নাম রয়েছে। তাহলে তার সাথে কি বড় কোনো জঙ্গিগোষ্ঠীর যোগাযোগ ছিল? এমন কি হতে পারে যে, এটা একটা বড় ধরনের পরিকল্পনার অংশ যেটি নিহত যুবক ককপিটে যেতে পারলে বাস্তবায়িত হতো? অর্থাৎ এরকমটি অস্বাভাবিক নয় যে, ওই বিমানে হয়তো তার আরও লোকজন ছিল যারা পলাশের ককপিটে ঢোকার অবধি অপেক্ষায় ছিল এবং ঢুকতে পারলে তার সঙ্গীসাথীরা স্বরূপে আবির্ভূত হতো? এর সবই ধারণা এবং ক্রিটিক্যাল থিংকিংয়ের অংশ। কিন্তু যেহেতু অপরাধী নিহত হয়েছ, ফলে এখন এর রহস্য ভেদ করা প্রায় অসম্ভব।তবে নিহত ব্যক্তির সাথে নিশ্চয়ই মোবাইল ফোন ছিল। তিনি সর্বশেষ কাদের সাথে কথা বলেছেন, ধরা পড়ার আগ মুহূর্তে কাদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেছিলেন তা জানা খুবইসহজ। তার সাথে কি ব্যাগ ছিল? থাকলে সেখানে কী আছে—এসব প্রশ্নের উত্তর জানা গেলে রহস্য ভেদ করা যাবে।

এই ঘটনায় আরও কিছু প্রশ্ন এরই মধ্যে উত্থাপিত হয়েছে যে, বিমান বন্দরের অতি উচ্চ নিরাপত্তা ব্যূহ ভেদ করে একজন লোক কী করে পিস্তল নিয়ে বিমানে উঠলেন যদি সেটা খেলনাও হয়। বিমান প্রতিমন্ত্রী অবশ্য বলছেন, নিহত যুবক পকেটে বা ব্যাগে পিস্তল নিয়ে বিমানে উঠেছিলেন কি না তা এখনও নিশ্চিত নয়। যদি তাই হয় তাহলে ভেতরে থেকে কেউ তাকে অস্ত্র সরবরাহ করেছে? তার পরিচয় কী? নাকি বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা এতই দুর্বল যে একজন লোক পিস্তল নিয়েও বিমানে উঠে যেতে পারে! এই ঘটনা সারা বিশ্বে বাংলাদেশের বিমানবন্দরের ভাবমূর্তি যে ভয়াবহ সংকটের ভেতরে ঠেলে দিলো, তা কিভাবে সামলানে যাবে?

তবে সিরিয়াস একটা বিষয় নিয়ে এইসব আলোচনার ভেতরে মানুষ তার স্বভাবজাত রসিকতা করতেও ভোলে না। যেমন ফেসবুকে অনেকে প্রখ্যাত কবি হেলাল হাফিজের একটা কবিতা ‘ভালোবেসে কেউ যদি খুনি হতে চান তাই হয়ে যান, উৎকৃষ্ট সময় কিন্তু আজ বয়ে যায়’—এই লাইন লিখে নিহত ‘প্রেমিক’ মাহাদী ওরফে পলাশের প্রতি সমবেদনা জানাচ্ছেন। প্রশ্ন হলো তিনি কি আসলেই বিমান ছিনতাই করে ইতিহাস গড়তে চেয়েছিলেন? অথবা তার স্ত্রীকে দেখাতে চেয়েছিলেন, ভালোবাসর জন্য তিনি কী না করতে পারেন!

কথা হচ্ছে মানুষ এই আজগুবি গল্প বিশ্বাস করবে নাকি নিহত পলাশের সাথে বড় কোনো অপরাধী চক্রের যোগসাজশ ছিল কি না সেটি খুঁজে বেরকরার দাবি জানাবে? কারণ প্রাথমিকভাবে সরকারের তরফে তাকে মানসিক ভারসাম্যহীন বলা হলেও তার ফেসবুক প্রোফাইল, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে থাকা ট্র্যাক রেকর্ড এবং খোদ তার পরিবারের ভাষ্য একেবারেই ভিন্ন। তাতে নিহত যুবক কোনোভাবেই মানসিক ভারসাম্যহীন ছিলেন না। বরং তিনি বড় কোন গেম প্ল্যানের অংশ ছিলেন, সেটি খুঁজে বের করাই মূল কাজ।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)