বিরাজনীতিককরণের ওয়ান ইলেভেনের সরকার বাংলাদেশ বিমানকে সরকার হতে আলাদা করে কোম্পানীতে রূপান্তর করে। সেই হতে সরকারের নিয়ন্ত্রণ মুক্ত থেকে বাংলাদেশ বিমান পরিণত হয় অনিয়ম দুর্নীতির আখড়ায়।প্রধানমন্ত্রীকে বহনকারী বিমানে যান্ত্রিক গোলযোগ সৃষ্টি করে তার প্রাণনাশের চেষ্টা, প্রধান মন্ত্রীর খাদ্যদ্রব্যে অনাকাঙ্ক্ষিত বস্তুর উপস্থিতি, নিয়োগে অনিয়ম, দুর্নীতিসহ অসংখ্য অভিযোগ পত্রিকার শিরোনাম হয়।
এব্যাপারে কিছু পত্রিকার শিরোনাম উল্লেখ করা যেতে পারে। ১লা নভেম্বর, ২০১৬ দৈনিক যুগান্তর শিরোনাম করেছে: ছয় বিমান বন্দরের ৩৮ মেগা প্রকল্পে দূর্নীতি/ ফাইল তলব করেছে দুদক/ কয়েক কোটি টাকার অনিয়ম। ১৮ডিসেম্বর, ২০১৬ ইং তারিখের দৈনিক যুগান্তর শিরোনাম করেছে: বিমানে ভয়াবহ নিয়োগ দুর্নীতি/ জাল সার্টিফিকেট ও ভুয়া নিবন্ধনে চাকরি/ বাতিল হতে পারে সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সকল পরীক্ষা। ২০ডিসেম্বর, ২০১৬ দৈনিক কালের কন্ঠ শিরোনাম করেছে: বেহাল বিমান/ তদন্তে কাউকে দায়ী করেনা বিমান/ এবার রাষ্ট্রপতির বিমানেও বিপত্তি/ এক কর্মকর্তা বরখাস্ত/ সিন্ডিকেট ভাঙ্গার উদ্যোগ/ ‘সরকার হতে আলাদা হওয়ার জন্যই বিমানের এই দুরবস্থা/ বিমানের বিভিন্ন দপ্তরে লোকবল নিয়োগেও সরকারের কোন ভূমিকা নেই/ মন্ত্রীর নির্দেশনার কোন গুরুত্ব নেই বিমান কর্তৃপক্ষের কাছে।
১৮ ডিসেম্বর, ২০১৬ দৈনিক যুগান্তরে লিখেছে: বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সে ভয়াবহ নিয়োগ দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া গেছে।সম্প্রতি জুনিয়র সেলস অফিসার (জিএসও) পদে নিয়োগ পাওয়া প্রার্থীদের কাগজপত্র যাচাইয়ে বেরিয়ে এসেছে বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য। ইতিমধ্যে চূড়ান্ত নিয়োগ পাওয়া ২জনের চাকরি বাতিল করা হয়েছে। সন্দেহের তালিকায় থাকায় অন্তত ১০ জনকে এখনও নিয়োগ পত্র দেওয়া হয়নি। অভিযোগ, বিমানের এমপ্লয়মেন্ট, প্রশাসন ও মার্কেটিং শাখার অন্তত ১০ জন দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার একটি সিন্ডিকেট আন্ডারহ্যান্ড ডিলিং করে প্রার্থীদের নিয়োগ দেয়। এবিষয়ে জানতে চাইলে বিমানের পরিচালক মার্কেটিং ড.সফিকুর রহমান বলেন, জুনিয়র সেলস অফিসার পদে চুড়ান্ত নিয়োগ পাওয়া দীলিপ চক্রবর্তী (রোল:১১৩৪১) নামে একজন প্রার্থীর নিয়োগ ইতিমধ্যে বাতিল করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে আবেদনের সময় জাল কাগজপত্র জমা দেয়ার প্রমান পাওয়া গেছে। চূড়ান্ত নিয়োগ পেতে বিভিন্ন ধাপে কমপক্ষে ৪টি পরীক্ষায় অংশ নিতে হয়। একজন অসাধু আবেদনকারী এতগুলো ধাপ পেরিয়ে কিভাবে চুড়ান্ত নিয়োগ পেলেন-এই প্রশ্নে ড. সফিকুর রহমান বলেন, এ নিয়ে শিগগিরই একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে।
‘২০ ডিসেম্বর, ২০১৬ তারিখের কালের কন্ঠ পত্রিকা লিখেছে, একের পর এক অঘটনের জন্ম দেয়া বাংলাদেশ বিমানের ভেতরে সক্রিয় থাকা সিন্ডিকেট ভাঙতে সংস্থাটি ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় নতুন বছরের শুরু থেকেই বিমানে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে পারে বলে মন্ত্রণারয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। সূত্রমতে, শ্রমিক সংগঠনের দৌরাত্ম্য বন্ধ করতেও কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। এইসব সংগঠনের যেসব নেতা বা কর্মচারী তদবির বাণিজ্যে লিপ্ত তাদের তালিকা প্রণয়নের কাজ শুরু করেছে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ‘যে বিমান মন্ত্রণালয়ের অধীনে নয়, যার কর্মকর্তা, কর্মচারী মন্ত্রীর কাছে জবাবদিহিতা করতে বাধ্য নয়, যার জনবল নিয়োগেও মন্ত্রণালয়ের কোন ভূমিকা নেই সেই বিমানের ব্যাপক পরিবর্তন আনবে মন্ত্রণালয়! এ উদ্যোগ অনর্থক নয় কি? অনিয়ম, দুর্নীতি নিয়ে কিছুদিন পরপর তদন্ত কমিটি গঠিত হয় কিন্তু বছরের পর বছর পেরিয়ে যায় তদন্ত রিপোর্ট আলোর মুখ দেখেনা। এ বিষয়ে ২০ ডিসেম্বর,২০১৬ তারিখের কালের কন্ঠ পত্রিকার একটি প্রতিবেদনে লিখেছে, গত বছর ২৯ ফেব্রুয়ারি বিমানের পরিচালনা পর্ষদের বৈঠকে একটি এয়ারক্রাফট থেকে ৬১ কেজি সোনা উদ্ধারের তদন্ত প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়। প্রধানমন্ত্রী’র কার্যালয় হতে এ ঘটনা তদন্ত করার জন্য বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। মন্ত্রণালয় তদন্ত করার নির্দেশ দেয় বিমানকে।
বিমান এ ঘটনা তদন্ত করার দায়িত্ব দেয় তৎকালীন মহাব্যবস্থাপক আতিক সোবহানকে। অথচ এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধেই সোনা চোরাচালানে জড়িত থাকার অভিযোগ ছিল। স্বাভাবিকভাবেই সেই তদন্তে দায়ীদের চিহ্নিত করা হয়নি। বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয় থেকে প্রশ্ন তোলা হয় যার বিরুদ্ধে অভিযোগ তাকেই কেন তদন্ত কমিটির প্রধান করা হল? ‘এভাবে বারবার তদন্ত কমিটি হয় কিন্তু এর মাধ্যমে কাজের কাজ কিছুই হয়না। যে বিমান নিয়ে এত তোলপাড় সে বিমানে চাকরিরতরা বেতন নেয় দৈনিক ভিত্তিতে। সেজন্যই দায়বদ্ধতা কম থাকে। অনিয়ম দুর্নীতি করে চাকরি ছেড়ে দিলে এমন কি এসে যায় তাদের? বিমানের মতো পর্যটনেও দৈনিক ভিত্তিতে চাকরি করছে অনেকেই। এ মন্ত্রনালয়টি যেন কেবলই কাগজে কলমে। এরকম সাক্ষীগোপাল মন্ত্রনালয় রেখে কী লাভ? শিক্ষা,স্বাস্থ্য,অর্থ, স্বরাষ্ট্রসহ বাকি সব মন্ত্রণালয়েরই সংশ্লিষ্ট দপ্তরে নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। সেসব মন্ত্রণালয়ের অধীনে চাকুরিরতরা মন্ত্রণালয়ের অধীনে তথা সরকারের অধীনে। ব্যতিক্রম বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়। এখানে কেউ সরকারি, কেউ বেসরকারী। যেমন কেউ স্থায়ী সরকারি বেতন ভুক্ত আবার কেউ অস্থায়ী দৈনিক মজুরি ভুক্ত।
বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়কেও অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের মত নির্বাহী ক্ষমতা সম্পন্ন করা উচিত। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলে জানা গেল, ১৭ জুন ক্যাজুয়েল কার্গো হেল্পার পদে নিয়োগের লিখিত পরীক্ষা হয়ে গেল। এই নিয়োগে বিমান মন্ত্রীর ন্যুনতম কোন ভূমিকা নেই। চাকরি প্রার্থীদের ব্যাপারে মন্ত্রীর দপ্তর হতে কোন ডিও লেটার ও সুপারিশও আসেনি। অথচ চাকরি প্রাপ্তদের মধ্যে কেউ অনিয়ম দুর্নীতি করলে এর দায়ও বর্তাবে মন্ত্রীর উপর। যে বিএফসিসি কর্তৃক প্রধানমন্ত্রী’র খাদ্য মেনুতে অনিয়মের জন্ম দেয় সেই বিএফসিসি’র জনবল নিয়োগেও মন্ত্রীর নির্দেশনা রক্ষিত হয়না। ক্যাজুয়েল হিসাবে ১০ জন জুনিয়র অপারেশন এসিসট্যান্ট রয়েছে। বিমান মন্ত্রী ভারপ্রাপ্ত জি এম জামাল উদ্দীন ও এম ডি মোসাদ্দেক হোসেনকে বলেন, একই পদে ১০জন চাকুরিরত ক্যাজুয়েল রেখে আরও ১০ জন ক্যাজুয়েল নিয়োগ দেয়া ঠিক নয়। তাদের স্থায়ী করে পরে নতুন নিয়োগ দেন।
কিন্তু তারা মন্ত্রীর নির্দেশনা না মেনে আরও ১০ জনকে নিয়োগ দিয়ে দেয়। বিমানের প্রতিটা নিয়োগেই এমনটি ঘটছে। এমন কর্তৃত্বহীন মন্ত্রণালয়ের প্রয়োজনীয়তা নিয়েও প্রশ্ন অনেকের। এই অবস্থা চলতে থাকলে বিমানমন্ত্রী বদল হবে কিন্তু বিমানের বিশৃঙ্খলা ক্রমশ বাড়তেই থাকবে। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির যথেচ্ছাচার বিমানকে আরও ভয়াবহ অবস্থার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। চলছে নিয়োগ বাণিজ্য। প্রতিটি নিয়োগের পেছনেই লাখ লাখ টাকার লেনদেন হয় ও সেই সাথে নিয়োগ পায় দায়িত্বজ্ঞানহীন, অসৎ ও ক্ষতিকর শ্রেনীর লোকেরা। যারা জন্ম দিয়ে যেতেই থাকবে নিত্যনতুন অঘটন। খোদ মন্ত্রীরই কর্তৃত্ব নেই যেখানে সেখানে মন্ত্রীর কর্মকর্তা কতোটা প্রাসঙ্গিক। মন্ত্রীর রদবদলে দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীর কর্মকর্তারাও বদল হয়। অনেকসময় দেখা যায় এসব কর্মকর্তাদেরও অনেককেই এয়ারপোর্টভিত্তিক বিভিন্ন ব্যবসা ও নিয়োগ বাণিজ্যের সিন্ডিকেটে জড়িয়ে যেতে। তাদের কাউকে কাউকে খোদ মন্ত্রীর সুপারিশের বিরোধিতা করার কথাও শোনা যায়। মন্ত্রীর কথায় কাজ হয় না, মন্ত্রীর কর্মকর্তার কথায় কাজ হয় এমন চমকপ্রদ ঘটনাও ঘটে। কারণ এসব কর্মকর্তারা সিন্ডিকেটে মিশে যায়। বিমানের মূল নিয়ন্ত্রক শক্তিই হল এসব সিন্ডিকেট। অথচ তাদের উচিত মন্ত্রীর কর্তৃত্বকে প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করা।
বিমানমন্ত্রী যেন কেবলই দোষের নিয়তি। ২০০৯ সালে মহাজোট সরকারের বিমান ও পর্যটন মন্ত্রী জি এম কাদের বিমান মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীকে বিমান পরিচালনা বোর্ডের চেয়ারম্যান করার জন্য প্রধান মন্ত্রীর কাছে সার সংক্ষেপ পাঠিয়েছিলেন। গত বছর বিমানের সাবেক চেয়ারম্যানের কথিত পালক পুত্রের প্রভাব বিস্তার ও সোনাচোরাচালান সম্পৃক্ততার বিষয়ে পত্রিকায় অনেক লেখালেখি হয়েছে। কিন্তু বিমানে এসব অভিযোগের কোন বিচার হয়না।২০ ডিসেম্বর, ২০১৬ দৈনিক কালের কন্ঠে শিরোনাম ছিল, বিমান ঢেলে সাজানোর নির্দেশ প্রধান মন্ত্রীর। এতে লিখেছে, গতকাল সোমবার সচিবালয়ে মন্ত্রীসভা বৈঠক শেষে প্রধানমন্ত্রী বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন এবং একই মন্ত্রণালয়ের সচিব এস এম গোলাম ফারুকের সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকে এ নির্দেশনা দেন। যেখানে মন্ত্রীর কোন কর্তৃত্বই নেই সেখানে প্রধানমন্ত্রী’র নির্দেশনা কিভাবে পালন করবে মন্ত্রী।
সমস্যার মূলে হাত দিলে সবার আগে বিমানকে মন্ত্রণালয়ের অধীনে নেয়া সঙ্গত নয় কি? বিমান মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বিমানের সমস্যার সমাধান করতে হলে এর মূলে হাত দিতে হবে।বিমানের মূল সমস্যা হচ্ছে এর পরিচালনা পর্ষদ।বিমানের জন্য সংসদ বা সংসদের বাইরে জবাবদিহি করতে হয় মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীকে। অথচ মন্ত্রী বিমান পরিচালনা পর্ষদের কেউ নন। বিমান পরিচালনায় মন্ত্রীর কোন ধরনের অংশগ্রহণ নেই। এই সুযোগে বিমান পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান তার মতো করে বিমান চালান। এই সুযোগটি কাজে লাগান পর্ষদের অন্য সদস্যরাও। বিমান ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তারাও মন্ত্রীকে পাশ কাটিয়ে চলেন। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বিমান মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী উপস্থিত থাকেন, না থাকলেই নয় হিসেবে। আর এমন পরিস্থিতিতে বিমান ব্যবস্থাপনা ভেঙ্গে পড়েছে। বিমানের এই অচলাবস্থা দুর করতে হলে আগে মন্ত্রণালয়ের অধীনে নেয়ার ঘোষণা দিতে হবে। অতঃপর মন্ত্রণালয়কে ঢেলে সাজানোর নির্দেশনা দিতে হবে। না হয় নির্দেশনা কেবল মুখে ও কাগজে কলমেই থেকে যাবে বাস্তবতার মুখ দেখবে না কোনদিন।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)