রাষ্ট্রীয় এমন গুরত্বপূর্ণ পদে থেকে গণভবন বা বঙ্গভবনে বসেও যতটুকু সহজ ভাবে কথা বলতে পারতেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিষয়টির ব্যাখা ও প্রেক্ষাপট নিয়ে ফেসবুকে লিখেছেন লেখিকা অদিতি ফাল্গুণী গায়েন।
‘যেভাবে নিজের স্বজন হারানোর ব্যাথা চেপে রেখে কী স্বাভাবিকভাবে বিভিন্ন সভা সেমিনারে বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন।তাকে দেখে কখনও মনে হয়না তিনি রাষ্ট্রনায়িকা’, শেখ হাসিনার প্রতি মুগ্ধ হয়ে এমনটিই লিখেছেন অদিতি।
অদিতি ফাল্গুণী তার স্ট্যাটাসে লিখেছেন, সম্ভবত: বাংলা একাডেমিতে বছর খানেক চাকুরির সুবাদেই এক মাসের ভেতর দু/দু’টো রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বক্তৃতা দিতে দেখলাম। ওনাকে এর আগে চাক্ষুষ দেখেছিলাম সেই ১৯৮৭ সালে। তখন মাত্র ঢাকায় এসেছি আমরা মফস্বল থেকে। তখনো স্কুলে পড়ি। একুশে ফেব্রুয়ারীর সকালে শহীদ মিনারে ফুল দিতে গিয়ে হঠাৎ দেখি পাশেই ‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ’ লেখা ব্যানার থেকে সাদা আর আকাশী নীল রঙের একটি শাড়ি পরা, শ্যামলা ও ছিপছিপে আর হাসিমুখের চশমা পরা এক নারী আমাদের দিকে তাকিয়ে। তখন তাঁর বয়স বোধ করি চল্লিশের মত। আরো বহু আগে ১৯৮১ সালে পাবনায় যখন বাবা কাজ করেন, তখন শেখ হাসিনা মাত্রই দেশে এসে পাবনায় এসেছিলেন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ড. কামাল হোসেনের পক্ষে প্রচারণা অভিযান চালাতে। ওনার বয়স তখনো ৩৫ হয়নি। কাজেই কামাল হোসেনই দাঁড়িয়েছিলেন। গেছিলাম বাবা আর বড় বোন কাবেরীর হাত ধরে। রাজনৈতিক বক্তৃতা কিছুই বুঝি নি বা বোঝার বয়স ছিল না। নির্বাচনী জনসভায় আমার মনোযোগ ছিল বাদাম, আচার আর আইসক্রিমের দিকে। সেগুলো খেয়ে-দেয়ে হাসি মুখে ফিরেছিলাম।
তা গত ১লা ফেব্রুয়ারি বইমেলা উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রথম প্রধানমন্ত্রীকে দেখলাম একদম পেছনের সারিতে বসে আর গতকালও তাঁকে দেখলাম খামারবাড়ির কৃষিবিদ ইনস্টিটিউটের শেষের দিকের সারিতে বসে। খুবই অবাক হয়ে দেখলাম ১লা ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠানেও যেমন একটি সাদা খোল এবং লাল পাড়ের জামদানি পরে এবং বলতে গেলে কোন প্রসাধন ছাড়াই উপস্থিত হয়েছিলেন, গতকাল আরো সাদা-সিধে একটি ধূসর রঙের জামদানি (ইস্ত্রি করা ছিল কি শাড়িটা?) পরে তিনি উপস্থিত। মুখে কোনই প্রসাধন নেই। বইমেলার উদ্বোধনীতে হাল্কা একটু প্রসাধন তবু বোধ করি ছিল। বইমেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে কি যে সহজ ভাবে একটা পর্যায়ে বলা শুরু করলেন,যেমন আমার বাসার আমার বড় বোন কখনো কখনো বলে ‘বাবা আমাদের প্রতিদিন দশটা টাকা দিতেন হাত খরচের জন্য তখন ত’ সেই টাকাতেই নানা কিছু পাওয়া যেত, টাকা জমিয়ে আমরা বই কিনতাম’ এমন সহজ ভাবে বলা!
তিনি আরও লিখেছেন, গতকাল আমি আরো বিষ্মিত হলাম। জীবনে দু:খ কম পান নি, এক রাতে বাবা-মা-ভাই-ভ্রাতৃবধূ সব হারিয়েছেন, ১/১১-এর সময় জেলে থেকেছেন, আবার সাফল্যও অনেক তাঁর। পিতৃহত্যার বিচার করেছেন, বিডিআর বিদ্রোহ দমন করেছেন, যুদ্ধাপরাধের বিচার হয়েছে, জিডিপি বৃদ্ধি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ বেড়েছে, বাংলাদেশ মধ্যবিত্ত আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে, ভারতের সাথে ছিটমহল চুক্তি বা মিয়ানমারের সাথে সমুদ্র বিজয় হয়েছে। আবার সমালোচনাও অবশ্যই অনেক আছে তাঁর সম্পর্কে। কিন্ত গতকাল যাঁকে দেখলাম তাঁকে কোন ‘কঠোর রাষ্ট্রনায়িকা’ মনে হলো না তো! কান্নায় ভেজা গলা। খুব সাদা-সিধে বাচনভঙ্গী। তাঁর ভাইয়েরা সব নিহত। একাই পুত্র-কন্যার সব দায়িত্ব পালন করতে করতে পিতৃঋণ শোধ করে যাচ্ছেন, পিতৃকৃত্য করে যাচ্ছেন! এনার নামেই এত মন্দ কথা? এত বিচার করি আমরা তাঁর প্রতি পদে পদে? বললেন একটি যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশে তিন বছর কি সব কিছু গড়ার জন্য যথেষ্ট ছিল? সত্যি কথাই। বঙ্গবন্ধু তো কোন সময়ই পান নি।
বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, দল হিসেবে আওয়ামী লীগ অবশ্যই বিচারের উর্দ্ধে নয়। ছাত্রলীগের নানা সময় নানা কাজ দলের সমর্থক বা শুভনুধ্যায়ীদেরও ক্ষুদ্ধ করে। বাসায় এসে বঙ্গবন্ধুর ‘কারাগারের রোজনামচা’ উল্টাতে উল্টাতে অবাক হয়ে যেতে হচ্ছিল। বারো বছর যে মানুষ জেলখানায় কাটান তার পক্ষেই এমন বই লেখা সম্ভব। জেলখানায় কয়েদিদের নানারকম ভাগ, মামলার কত রকম স্তর-বিন্যাস,যে কোন সমাজতত্ত্ববিদের গভীর আগ্রহ ও অধ্যয়ণের বিষয় হতে পারে। হঠাৎই একটি বিষয় মনে পড়ে কৌতুক বোধ হলো। শৈশবে ‘রুশ ইতিহাসের কথা ও কাহিনী’তে রুশ বীর সুভোরভকে নিয়ে একটি অধ্যায়ে পড়েছিলাম। সুভোরভ সেনাবাহিনীর বড় অফিসার। কিন্ত সাধারণ সৈন্যদের সাথে এক টেবিলে খান, রাতে যুদ্ধের সময় তাদের সাথে এক বিছানায় ঘুমান, বুট জুতো ক্ষয়ে গেলে সেই জুতোর ভেতর সাধারণ সৈন্যদের মতোই খড় ভরে নেন। এক এলিট পরিবারের এবং সমপদমর্যাদার অফিসারের খুব আত্মা জ্বলে গেল। সুভোরভ কেন সাধারণ সৈন্যদের ভেতর এত জনপ্রিয়? তা’ সেও সুভোরভের মতই জল দেওয়া, ট্যালটেলে পাতলা বাঁধাকপির স্যুপ খাওয়া শুরু করলো। খড়ের বিছানায় ঘুমানো শুরু করলো। কিন্ত সে ত’ সুভোরভ না। সুভোরভের আগুন বা দীপ্তি সে কোথায় পাবে? দু’দিন পরেই ঐ খাবার বা ঐ বাঁধাকপির স্যুপ কি শীতের ভেতর খড়ের বিছানা তার ত’ আর সহ্য হয় না। এদেশে হাইব্রিড রাজনীতিবিদদের দল বিএনপি সঙ্গত কারণেই বিলুপ্তির পথে। আওয়ামী লীগে যে প্রচুর শয়তান বা লুটেরা নেই তা’ নয়। তবে, অদ্ভুতভাবে এই দলটিতে আজো অনেক নিঃস্বার্থ, মৌন কর্মী-সমর্থক,শুভনুধ্যায়ী আছেন এবং তারা ডান-বাম সবার কাছ থেকে গালি খেয়েও জীবনভর খড়ের বিছানায় শুয়ে পাতলা বাঁধাকপির স্যুপ খেয়ে যেতে পারেন। হাসিমুখেই। আবার অনেক বামপন্থীকে দেখেছি বিদেশে বা ঢাকা শহরেই স্বচ্ছন্দ, সুখী জীবনে জীবনপাত করে দিতে। তারা এক মধ্যবিত্ত হয়ে আর এক মধ্যবিত্তের সাথেই মিশতে পারে না তারা সর্বহারার বিপ্লব করবে? বিপ্লব গাছে ধরে?
তিনি আরও লিখেছেন, আমার এই ছোট্ট লেখক জীবনেই ‘হাইব্রিড রাজনীতিবিদে’র মতোই ‘হাইব্রিড’ লেখকও আমি কিছু দেখেছি। আগে-পরে কোন পরম্পরা নেই। হঠাৎ অভ্যুদয় এবং তারপর হঠাৎই নিঃশব্দ হয়ে যাওয়া। জীবনের নানা সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের ধান্দা থাকে এদের। বিদেশে বড় চাকুরি, উচ্চ শিক্ষা বা ডিগ্রি অর্জন, ফ্ল্যাট,গাড়ি, ঘর-সংসার নিয়ে জমজমাট সাথে এক মুঠো সাহিত্য বা এক চিমটি বামপন্থাও কিন্ত আছে। ফ্রাঙ্কফুর্ট বা কোপেনহেগেন কি শিকাগোতে বসে মাউস নাড়িয়ে রামপাল বা রূপপুরের পক্ষে ক্লিক করতে কি সুবিধা! এই দেশে বসবাস করা দিন দিন যে কোন সুস্থ মানুষের জন্য কি পরিমাণ অবিরল রক্তক্ষয়ী এক যুদ্ধ হয়ে উঠেছে তা’ কি আমি নিজেই জানি না? কিন্ত যুদ্ধটা বা সংশপ্তকের লড়াইটাও ঐখানে। না পারলে এই কঠিন রাস্তা ত’ তোমার জন্য নয় বা কোনদিন ছিলও না!
স্ট্যাটাসে অদিতি ফাল্গুণী লিখেছেন, মানুষ শেখ মুজিব বা মানুষী শেখ হাসিনার হাজারটা দোষ-ত্রুটি নিশ্চয় আছে। কিন্ত প্রিয় এলিট বামপন্থীরা, বারো বছর কারাবাস ছিল আপনার? ঐ অতি খারাপ শেখ হাসিনার মতই পরিবারের সবাইকে হারিয়েছেন? উনি গণভবন বা বঙ্গভবনে বসেও যতটুকু সহজ ভাবে কথা বলতে পারেন, যে সাধারণ শাড়িটা পরে বাইরে আসেন, আপনি ‘মধুর ক্যান্টিন’ বা ‘ছবির হাটে’ বসে তাঁর থেকে বেশি ‘ভাব’ দেখান না তো? তাঁর থেকে বেশি আত্মগম্ভীরতা নেই তো আপনার? হাইব্রিড রাজনীতিবিদ, সাহিত্যকর্মী বা সংস্কৃতিকর্মী কোনটাই বেশি দিন স্থায়ী হবার নয় বলেই মনে হয়!