জনপ্রিয়তায় আইপিএলের পরই বিপিএলের অবস্থান- এমন দাবী করে থাকে বিপিএল গভর্নিং কাউন্সিল। তুলনাটা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে নানা সময়, বিশেষ করে যখন টি-টুয়েন্টি লিগটি ঘিরে নানামুখী বিতর্ক ডালপালা মেলে। মাঠ ও মাঠের বাইরে গত আসরের বড় কয়েকটি বিতর্ক পাশ কাটিয়ে পঞ্চম আসরের শুরুটা অবশ্য ছিল পরিচ্ছন্ন। কিন্তু সময় যত গড়িয়েছে, এবারের বিপিএলেও বিতর্কের আঁচড় লেগেছে পাল্লা দিয়েই। ঘরের টুর্নামেন্টে দেশিদের সুযোগ কম আর মিরপুরের উইকেটের ধরণ নিয়ে সমালোচনা যখন তুঙ্গে, তখনই আবার সবচেয়ে বড় বিতর্কটা হচ্ছে আম্পায়ারিংয়ের মান নিয়ে।
বুধবার মিরপুরে গ্রুপপর্বের শেষ দুটি ম্যাচেই দেখা গেছে বাজে আম্পায়ারিংয়ের বেশ কয়েকটি নজির। ঢাকা ডায়নামাইটসের ১৩৭ রান তাড়া করতে নেমে ৪৩ রানে হারে রংপুর রাইডার্স। ম্যাচের গুরুত্বপূর্ণ সময়ে বড় দুটি সিদ্ধান্ত যায় হারা দলটির বিপক্ষে। মূলত তাতেই হার ত্বরান্বিত হয় দলটির! এদিন সুযোগ পেয়ে দারুণ ব্যাটিং করছিলেন জনসন চার্লস। বিপদের মুখে তার ব্যাটেই তাকিয়ে ছিল রংপুর। থিতু হয়ে যাওয়া এ ব্যাটসম্যানকে যে বলটিতে এলবিডব্লিউ দিলেন আম্পায়ার নাদির শাহ, সেটির পর তার ক্রিকেটীয় জ্ঞান নিয়েই প্রশ্ন তুলছেন অনেকে! ওই বলটি লেগস্টাম্পের অনেকটা বাইরেই পিচ করেছিলেন ঢাকার পেসার আবু হায়দার রনি।
রংপুরের আরেক টপঅর্ডার ব্যাটসম্যান শাহরিয়ার নাফীসের আউট নিয়েও রয়েছে জোর বিতর্ক। ব্যাট ছুঁয়ে বল উইকেটরক্ষকের গ্লাভসে গেলেও ঠিকঠাক জমাতে পারেননি জহুরুল। গ্লাভসে নিয়ন্ত্রণ নেয়ার আগেই বলের একটি অংশ মাটি স্পর্শ করেছিল। আউটের আবেদন করেন জহুরুল ও ঢাকার ফিল্ডাররা। সফট সিগন্যাল আউট দিয়ে ফিল্ড আম্পায়ার টিভি আম্পায়ার মনিরুজ্জামানের কোর্টে বল ঠেলে দেন শেষ সিদ্ধান্তের জন্য। টিভি আম্পায়ার রিপ্লে দেখার পরও আউটই ঘোষণা করেন। ম্যাচটি জিতে ঢাকা এলিমিনেটর এড়িয়ে সেরা দুইয়ে থেকে প্রথম কোয়ালিফায়ারে খেলা নিশ্চিত করে।
রংপুর রাইডার্সের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ইসতিয়াক সাদেক জানিয়েছেন, ম্যাচের তিনটি আউটের ব্যাপারে বিপিএল গভর্নিং কাউন্সিল ও বিসিবির কাছে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ জানাবেন তারা। আলোচিত দুটি আউটের সঙ্গে রংপুরের ইনফর্ম ব্যাটসম্যান মোহাম্মদ মিঠুনের এলবিডব্লিউর সিদ্ধান্তের ব্যাপারে আম্পায়ারের দিকে অভিযোগের তীর তাদের।
সন্ধ্যার পরের ম্যাচে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সের করা ১৭০ রান তাড়া করতে নেমে সিলেট সিক্সার্স শুরুতেই আম্পায়ারের ভুল সিদ্ধান্তের বলি হয়! তখন পাকিস্তানি ওপেনার রিজওয়ানের উইকেট হারায় তারা। ম্যাচের দ্বিতীয় ওভারের শেষ বলে মেহেদী হাসানের অফস্পিনের মুখে সুইপ খেলার চেষ্টা করেন ডানহাতি ব্যাটসমান। রিজওয়ানের ব্যাটের কানায় লেগে বল আঘাত হানে প্যাডে। আম্পায়ার মনিরুজ্জামান প্রথমে মাথা ঝাকিয়ে নটআউট ঘোষণার মতো ভাব প্রকাশ করলেও বোলারের জোর আবেদনের মুখ এলবিডব্লিউর সিদ্ধান্ত দিয়ে দেন।
আম্পায়ারের এমন ভুল দেখে সামাজিক মাধ্যম ফেসবুক সাবেক ক্রিকেটার ও সংগঠক আমির বাবু লিখেছেন, ‘কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্স দলের আন্ডারএইজ ক্রিকেটার স্পিনার মেহেদী হাসান ব্যাট এন্ড প্যাড মিসিং দি লেগ স্টিক বলে যেভাবে আম্পায়ারকে আপিলে প্রভাবিত করে আউট পেয়ে যে মনোভাব প্রকাশ করলেন, তা তাকে মানায় না। তিনি বড় দলে খেলেন সেই মনোভাবটাই ফুটে উঠলো। আধুনিক প্রযুক্তির দিনে দুর্বল আম্পায়ারিং। ব্যাট শো করে বোকার মতো মাঠ ত্যাগ করলেন সিলেট সিক্সার্সের ওপেনার রিজওয়ান।’
বোলার মেহেদীর বেলায় উল্টো ঘটনাও আছে। এবারের বিপিএলেই নিজের প্রথম ম্যাচের প্রথম ওভারে খুলনার এ স্পিনার পেতে পারতেন রংপুর রাইডার্সের ওপেনার ক্রিস গেইলের উইকেট। আম্পায়ারের ভুল সিদ্ধান্তে থেকে বঞ্চিত হন সেসময়। পরিষ্কার এলবিডব্লিউ থেকে বাঁচেন ক্যারিবীয় ব্যাটিংদানব।
আরও কয়েকটি ম্যাচে মারাত্মক ভুল সিদ্ধান্ত দিতে দেখা গেছে ফিল্ড আম্পায়ারদের। যা প্রভাবিত করেছে ম্যাচের গতিপথ! সবচেয়ে বিতর্কিত ঘটনাটি ঘটেছে চট্টগ্রাম পর্বে। যে ঘটনায় বিতর্কিত হয়েছেন টিভি আম্পায়ারও। রংপুর রাইডার্সের বিপক্ষে সিলেট সিক্সার্সের পেসার কামরুল ইসলাম রাব্বিকে ৭ বলে ওভার শেষ করতে হয়েছিল! ফিল্ড আম্পায়াররা বল গুনতে ভুল করায় তৃতীয় আম্পায়ারের সহায়তা চান রাব্বি। ফিল্ড আম্পায়ার মাহফুজুর রহমান ও রেনমোরে মার্টিনেজ তৃতীয় আম্পায়ার গাজী সোহেলের শরণাপন্ন হলেও ভুল সংশোধন করা যায়নি। রাব্বিকে ৭টি সঠিক বলের ওভার করতে হয়েছে।
পরে বিপিএল গভর্নিং কাউন্সিল সূত্রে জানা গেছে, প্রযুক্তির সহায়তা নিয়ে বল চেক করার সুযোগ থাকলেও টিভি আম্পায়ার সেটি না করে ফিল্ড আম্পায়ারদের জানিয়ে দেন আরও একটা বল বাকি এবং নির্দেশনা আসে ওভারটা তাড়াতাড়ি শেষ করার ব্যাপারে।
আসরে বাজে আম্পায়ারিং নিয়ে বিদেশি ক্রিকেটাররাও প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন। রংপুরের হয়ে খেলতে আসা নিউজিল্যান্ডের কিংবদন্তি ক্রিকেটার ব্রেন্ডন ম্যাককালাম বুধবারের ম্যাচ শেষে বলে যান, ‘আমার মনে হয়েছে আম্পায়ারিং আরও ভাল হওয়া উচিত। এরকম উইকেটে সিদ্ধান্ত আপনার পক্ষে না গেলে বড় মূল্য দিতে হয়। জনসন চার্লস যেমন আজ খুব ভাল খেলছিল, বিশেষ করে কয়েক ম্যাচ বসে থাকার পরও। সাকিব এমনি শেষদিকে যেমন ব্যাট করেছে, চার্লস আজ শেষ পর্যন্ত খেলতে পারত।’
শাহরিয়ার নাফীসের আউট নিয়েও বলেছেন ম্যাককালাম, ‘ব্যাটিংয়ে আমার মনে হয়েছে কিছু সিদ্ধান্ত হয়ত আমাদের পক্ষে যেতেই পারতো।’
শুক্রবার থেকে শুরু হচ্ছে ফাইনালে ওঠার লড়াই (প্লে-অফ রাউন্ড)। বড় ম্যাচের কথা বিবেচনা করে আম্পায়ারিংয়ের মান বাড়াতে বলেছেন ম্যাককালাম, ‘আমার মনে হয় সামনের বড় ম্যাচে চাপের সময় আম্পায়ারদের মানের দিকে একটু খেয়াল রাখা উচিত। এখানে অনেক লোক খেলা দেখছে, পুরো দেশজুড়ে। প্রত্যেকটা দলেরই প্রচুর সমর্থক। আমাদের নিশ্চিত করতে হবে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে যাতে ধারাবাহিকতা ঠিক থাকে।’